Advertisement
E-Paper

অন্ধকার গুহাটা না থাকলে এ উজ্জ্বল দীপ্তি কি পেতাম

দীর্ঘ-দীর্ঘ পথ অতিক্রান্ত, মানবজাতির অস্তিত্বের অনেকটা গভীরে চলে গিয়েছে এ সভ্যতার শিকড়। আপাত-হানাহানির আড়ালে অভিন্ন মানবাত্মা আজও জাগ্রত, সদাজাগ্রত।

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৮ ০০:৩৭
শত-সহস্র বাধা সরিয়ে আলো পৌঁছে গেল গভীর, দুর্গম পর্বতকন্দরে। ছবি: রয়টার্স।

শত-সহস্র বাধা সরিয়ে আলো পৌঁছে গেল গভীর, দুর্গম পর্বতকন্দরে। ছবি: রয়টার্স।

অখণ্ডতা, অভিন্নতা, বিশ্বজনীনতার একটা আবহ তৈরি হতে দেখা গেল। আজকাল এমন অবকাশ বোধ হয় সচরাচর জন্ম তৈরি হয় না। ভাষা ভিন্ন হতে পারে, সংস্কৃতি ভিন্ন হতে পারে, বিশ্বাস ভিন্ন হতে পারে, গাত্রচর্মের বর্ণে বা শরীরের আকারে ফারাক থাকতে পারে, কিন্তু দিনের শেষে বা সকালের শুরুতে এ মহাপৃথিবীর প্রত্যেক প্রান্তের প্রতিটি মানুষই যে এক অভিন্ন মানবজাতির অঙ্গ, সে উপলব্ধি ক্রমেই মলিনতার গহ্বরে হারিয়ে যেতে থাকে যেন এ যুগে। ঠিক এমন একটা সময়ে আপ্তবাক্যসম এক কাব্যাংশ প্রমাণ করল যে, তাতে নিহিত উপলব্ধি অমোঘ। আলো উৎসারিত হল অন্ধকারের উৎস হতেই। তাইল্যান্ডের অন্ধকার এক গুহায় কিছু একটা ঘটে গেল। তাতেই প্রজ্জ্বলিত হল বিশ্বমানবতার আলো। শত-সহস্র বাধা সরিয়ে সে আলো পৌঁছে গেল গভীর, দুর্গম পর্বতকন্দরে। গোটা ফুটবল দল নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল। খোঁজ মিলল যখন, তখন অনেকগুলো দিন কেটে গিয়েছে অনাহারে, অনিদ্রায়, অরক্ষিত দশায়। দুর্গম গুহা আচমকা জলোচ্ছ্বাসে অগম্য প্রায়। ফলে প্রকৃতির হাতে বন্দি ১৩ জন। ১৫ দিন অতিবাহিত ভয়ঙ্কর বন্দিদশায়। উদ্ধার করা যাবে আদৌ? নাকি গুহান্তরাল থেকে ভেসে আসা ক্ষীণ আর্তি ক্ষীণতর হতে হতে বিলীন হয়ে যাবে পঞ্চভূতে? খুব বড় প্রশ্নচিহ্ন তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু উজাগর মৃত্যুর মুখে জেগে উঠল বিশ্বমানবতা। গোটা পৃথিবী যেন একাত্ম হয়ে গেল লহমায়। এ গ্রহের নানা প্রান্ত থেকে উদ্ধারকারী দল পৌঁছল তাইল্যান্ডে। প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে অবিশ্বাস্য লড়াই দিয়ে অগম্য হয়ে ওঠা পর্বতকন্দর থেকে একে একে উদ্ধার করে আনা হল প্রত্যেককে।

কারা হারিয়ে গিয়েছিল গুহায়? বিশ্বকাপের কোনও ফুটবল দল? না। তা হলে? তাইল্যান্ডের জাতীয় ফুটবল দল? না, তা-ও নয়। নিখোঁজ হয়েছিল নেহাতই স্থানীয় স্তরের খেলোয়াড়রা, নিখোঁজ হয়েছিলেন কোচ। গোটা পৃথিবীর কাছে পরিচিত হওয়া দূরের কথা, গোটা তাইল্যান্ডের কাছেও পরিচিত নয় এই দল। কিন্তু ১৩টা মানুষ আটক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে, এ খবর চাউর হওয়া মাত্র গোটা পৃথিবী এক হয়ে গেল প্রার্থনায়, একাত্ম হয়ে গেল জলমগ্ন গুহায় আটকে পড়া ১৩টা প্রাণের সঙ্গে। ১৫ দিন আটকে থাকা একটা দলকে উদ্ধার করার জন্য অভিযান শুরু। তখনও আমরা কেউ জানি না, অভিযান সফল হবে কি না। শুধু প্রার্থনায় একাত্ম। মাঝপথে মৃত্যু হল এক উদ্ধারকারীর, আশার আলো যেন ক্ষীণ হয়ে এল। উদ্ধারকারীই পৌঁছতে পারছেন না, এমনই অগম্য হয়ে উঠেছে গুহা! উদ্ধার তা হলে মিলবে কী ভাবে? আশঙ্কার উদ্রেক হল মনে। কিন্তু তিন দিনের রুদ্ধশ্বাস লড়াই শেষে উদ্ধার প্রত্যেকে। লড়াইটা আক্ষরিক অর্থেই রুদ্ধশ্বাস হয়ে উঠেছিল। গোটা পৃথিবী যেন শ্বাস ধরে রেখে তাকিয়ে ছিল অচেনা গুহাটার দিকে, চোখ রেখে চলেছিল সংবাদমাধ্যমে। সফল অভিযানের চূড়ান্ত খবরটা আসতেই উল্লাসের করতালি শোনা গেল যেন পৃথিবীর প্রতিটা প্রান্ত থেকে। হানাহানি, শাসানি, বিস্ফোরণ, ক্ষেপণাস্ত্র, পরমাণু বোমা, সন্ত্রাস, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, সাম্প্রদায়িকতা, উগ্র জাতীয়তাবাদ, খন্ড জাতীয়তাবাদ, প্রাদেশিকতা, খুন-জখম, ধর্ষণের এই পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে যখন দিশাহারা লাগে, সভ্যতার পরিণতির কথা ভাবতে যখন ভয় হয়, ঠিক তখনই বিশ্ব-একাত্মতার এই অনন্য নজির ধরা দিল উপলব্ধিতে। বুঝিয়ে দিল, মানব সভ্যতা এত ঠুনকো নয়। দীর্ঘ-দীর্ঘ পথ অতিক্রান্ত, মানবজাতির অস্তিত্বের অনেকটা গভীরে চলে গিয়েছে এ সভ্যতার শিকড়। আপাত-হানাহানির আড়ালে অভিন্ন মানবাত্মা আজও জাগ্রত, সদাজাগ্রত।

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

আরও পড়ুন
স্নায়ুর লড়াই শেষ, উদ্ধার সব খেলোয়াড়ই

Newsletter Anjan Bandyopadhyay অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় Thailand Footballers Rescue
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy