Advertisement
০১ মে ২০২৪

ক্ষমতা লুকিয়ে রাখতে নেই

এটা কি দক্ষিণ এশিয়ায় ‘নক্ষত্র-যুদ্ধ’-এর পূর্বাঙ্ক? এই সাফল্য কি সত্যিই বড় মাপের, না কি ভোটের আগে হিসেব কষে এ নিয়ে অতিরিক্ত আড়ম্বর করা হচ্ছে?

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০১৯ ০০:০৮
Share: Save:

লোকসভা নির্বাচন শুরুর পক্ষকাল আগে, ২৭ মার্চ ভারত উপগ্রহ-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা করার ফলে তুমুল শোরগোল পড়েছে। সময় নির্বাচনের দিক থেকে দেখলে সেটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু দেশের প্রতিরক্ষার পক্ষে এই পরীক্ষার গুরুত্ব কতটা এবং কোথায়, এই শোরগোলে সেটা কিছুটা চাপা পড়ে গিয়েছে। ‘মিশন শক্তি’র তাৎপর্য ঠিক কী?

এটা কি দক্ষিণ এশিয়ায় ‘নক্ষত্র-যুদ্ধ’-এর পূর্বাঙ্ক? এই সাফল্য কি সত্যিই বড় মাপের, না কি ভোটের আগে হিসেব কষে এ নিয়ে অতিরিক্ত আড়ম্বর করা হচ্ছে? রাজনীতি সরিয়ে রেখে ব্যাপারটার মর্ম বোঝা দরকার।

প্রথম কথা হল, ‘নক্ষত্র যুদ্ধ’ ব্যাপারটা ইতিমধ্যেই বাস্তব। আমরা চাই বা না চাই, সামরিক উদ্দেশ্যে মহাকাশের ব্যবহার আগেই শুরু হয়েছে। এবং, ভারতের দু’দিকে দুই প্রতিপক্ষ, ফলে মহাকাশে বিশ্বাসযোগ্য প্রতিরোধের সামর্থ্য অর্জন না করলে চলবে না। ভারত অনেক দিন ধরেই চুপচাপ এই সামর্থ্য অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। মহাকাশের সামরিক ব্যবহারের সঙ্গে জড়িত থাকে দু’ধরনের প্রকরণ: ব্যালিস্টিক মিসাইল এবং কৃত্রিম উপগ্রহ। ব্যালিস্টিক মিসাইল নিয়ে কাজ চলছে অনেক কাল, তবে তাদের ধ্বংস করার ব্যাপারটা তুলনায় নতুন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চিন, ইজ়রায়েল বা ভারতের মতো যে সব দেশের নিজস্ব ক্ষেপণাস্ত্র আছে, তারা বেশ কিছু কাল যাবৎ ব্যালিস্টিক মিসাইল ধ্বংস করার সামর্থ্য অর্জন ও উন্নয়নে ব্রতী।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

কৃত্রিম উপগ্রহ ধ্বংস করার সামর্থ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে রূপায়িত এ-স্যাট প্রকল্পটি আসলে বৃহত্তর অ্যান্টি-ব্যালিস্টিক মিসাইল (এবিএম) প্রকল্পের অঙ্গ। যে ধরনের এবিএম-এর পরীক্ষা ভারতে চলে আসছে, এ-স্যাট চরিত্রে তাদের মতোই, কেবল এটি আরও দূরপাল্লার। ক্ষেপণাস্ত্র বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের শেষ পর্বে এবিএম সেটিকে ধ্বংস করতে পারে, কিন্তু এ-স্যাট একটি উপগ্রহকে ৩০০ কিলোমিটার ওপরেই আঘাত করতে সক্ষম। ওড়িশার চাঁদিপুরের কাছে যে এক-পর্বের (সিঙ্গল স্টেজ) ক্ষেপণাস্ত্রটি নিক্ষিপ্ত হয় এবং তিন মিনিটে নির্দিষ্ট কৃত্রিম উপগ্রহটি ধ্বংস করে, সেটির জ্বালানি ছিল সলিড বা কঠিন, সেটি ওজনে হালকা, কারণ সে কোনও অস্ত্র বহন করেনি— প্রচণ্ড গতিবেগে উপগ্রহে আঘাত করেই লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করেছে। প্রতিরক্ষা গবেষণা ও নির্মাণ সংস্থা (ডিআরডিও) এই যে ক্ষেপণাস্ত্রগুলি তৈরি করছে, তারা সম্ভবত অস্ত্র বহন করতে পারে, অস্ত্র ছাড়াও সংঘর্ষের কাজে লাগতে পারে।

এই ক্ষেপণাস্ত্রের প্রযুক্তিগত জটিলতা যতটা, তার চেয়ে বেশি জটিল হল রেডারের সাহায্যে তার লক্ষ্যবস্তুকে চিহ্নিত করা, তাকে নিশানায় আনা এবং এবিএম বা এ-স্যাটকে আঘাত করার পথে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রযুক্তিকৌশল। প্রথমে এই চালনার কাজটা করা হয় উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে, ক্ষেপণাস্ত্রটি নিশানার কাছাকাছি পৌঁছলে তার নিজস্ব সরঞ্জাম বাকি কাজটা সম্পন্ন করার দায়িত্ব নেয়।

সমালোচকরা যা-ই বলুন, মিশন শক্তি-র সাফল্য জানিয়ে দিয়েছে, ভারত এখন মহাকাশে প্রতিপক্ষের ওপর বড় আঘাত আনতে সক্ষম। এ ঘটনা আরও একটা কথা বুঝিয়ে দিয়েছে— অন্তরিক্ষে প্রতিরক্ষার জন্য নিজস্ব সামরিক প্রযুক্তির প্রসারে ভারত দৃঢ়সঙ্কল্প। এ বিষয়ে এর আগের বিভিন্ন সরকারের যথেষ্ট তাগিদ দেখা যায়নি। মনমোহন সিংহ কোনও দিনই সামরিক শক্তির ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহ দেখাননি। শোনা যায়, তিনি এ-স্যাট পরীক্ষা এবং তা জাহির করার প্রস্তাব নাকচ করেছিলেন। বাজপেয়ী সরকার পারমাণবিক বোমা ফাটালেও মহাকাশে প্রতিরক্ষার কিছু কর্মসূচি শিকেয় তুলে দিয়েছিল। এই প্রেক্ষাপটে এ কথা মানতেই হবে যে ২৭ মার্চ ভারত এ বিষয়ে তার সামর্থ্য প্রমাণ করেছে। বিদেশি সংবাদমাধ্যমে এ বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে, কিন্তু সেটা বিশেষ ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না— এ রকমটা সব সময়েই হয়ে থাকে।

একটা কথা স্পষ্ট করা দরকার। যে কোনও ধরনের সামরিক সামর্থ্যই প্রদর্শন করতে হয়, তাকে লুকিয়ে রাখলে চলে না। এই কারণেই বিভিন্ন দেশ সামরিক কুচকাওয়াজের আয়োজন করে, সেনাবাহিনী নানান মহড়া দেয়, অস্ত্রের পরীক্ষা করে। এ সবের একটা উদ্দেশ্য হল অন্য দেশকে, বিশেষত প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্কেত দেওয়া যে আমরা সামরিক বলে বলীয়ান। উপগ্রহ ধ্বংস করার সামর্থ্য ভারত আগেই আয়ত্ত করেছিল কি না, সেটা অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন, কারণ পরীক্ষা করে দেখানোর আগে সেই সামর্থ্যের কোনও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছিল না।

কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা পি চিদম্বরম মন্তব্য করেছেন, উপগ্রহ-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষার কথা প্রকাশ করে দেওয়া ঠিক হয়নি, কারণ এতে দেশের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত গোপনীয় বিষয় ফাঁস হয়ে গিয়েছে। একাধিক কারণে এই যুক্তি মেনে নেওয়া যায় না। প্রথম এবং প্রধান কথা হল, আমার সামর্থ্য কতটা সেটা জানালে তবেই আমি আগাম প্রতিরোধের (ডেটারেন্স) বিশ্বাসযোগ্য ক্ষমতা অর্জন করতে পারব। প্রতিপক্ষকে যদি বিশ্বাস করাতে পারি যে আমাকে আঘাত করলে আমি প্রত্যাঘাতের সামর্থ্য রাখি, তা হলে তারা আমাকে আঘাত করার সাহস পাবে না, তাতেই সংঘাত এড়ানো যাবে। সামরিক শক্তি লুকিয়ে রাখলে এই বিশ্বাস উৎপাদন সম্ভব নয়। আর, অস্ত্র পরীক্ষা, প্রতিরক্ষার পরিকাঠামো, সামরিক ঘাঁটি ব্যাপারগুলো আজ আর পুরোপুরি গোপন রাখার উপায় নেই— স্থলে জলে অন্তরিক্ষে অহোরাত্র তীক্ষ্ণ নজরদারি চলছেই। অস্ত্র তথা সামরিক শক্তি কী ভাবে ব্যবহার করা হবে, প্রতিরক্ষার প্রধান গোপনীয় ব্যাপার বলতে এখন প্রধানত সেটাই বোঝায়। যেমন, ভারত রাফাল যুদ্ধবিমান পেয়ে যাওয়ার পরে পাকিস্তান তার সম্পর্কে বিশদ ভাবে জেনে যাবেই, যেটা তারা জানবে না তা হল, কোন পরিস্থিতিতে ভারত সেই বিমান ব্যবহার করতে চায়, ঠিক কী ভাবে ব্যবহার করতে চায়, ইত্যাদি। আসলে, সামরিক সামর্থ্য অর্জন করে তা লুকিয়ে রাখা হল অনেকটা এই রকম যে কাউকে গভীর ভাবে ভালবাসলাম কিন্তু সে কথা তার কাছে লুকিয়ে রাখলাম!

তবে কি প্রধানমন্ত্রীর দাবি ঠিক? ভারত সত্যিই মহাকাশে মহাশক্তি হয়ে উঠেছে? স্পষ্ট উত্তর: এখনও না। মানচিত্র নির্মাণ (ম্যাপিং) এবং দূরসংবেদনের (রিমোট সেন্সিং) কাজে যে সামরিক উপগ্রহগুলি ব্যবহৃত হয় সেগুলির কক্ষপথ তুলনায় নীচেই থাকে, মোটামুটি ১৬০ থেকে ২০০০ কিলোমিটার উচ্চতার মধ্যে। তাদের একটা বড় অংশ আছে ৪০০ থেকে ৯০০ কিলোমিটার উচ্চতায়। ডিআরডিও-র সূত্র অনুসারে, ভারত এখন ১০০০ কিলোমিটার উচ্চতা অবধি উপগ্রহে ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে আঘাত করার ক্ষমতা ধরে। কিন্তু বায়ুমণ্ডলের সীমার বাইরে, মাঝারি বা উঁচু কক্ষপথে থাকা উপগ্রহ তার নাগালের বাইরে। মাঝারি পর্যায়ের উপগ্রহ, যেমন যেগুলি জিপিএস সিস্টেমের কাজে লাগে, মোটামুটি ২২০০০ কিলোমিটার উচ্চতায় ঘোরে, আর জিয়োস্টেশনারি উপগ্রহ, যারা সামরিক যোগাযোগ, দূরসংযোগ, আবহাওয়া-বিজ্ঞান ইত্যাদির প্রয়োজন মেটায়, সেগুলি থাকে প্রায় ৩৬০০০ কিলোমিটার উচ্চতায়, বায়ুমণ্ডলের অনেকটা বাইরে।

অন্য দিকে, চিন খুব উঁচুতে থাকা উপগ্রহ ধ্বংস করার ক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে। আমেরিকা ও রাশিয়ার পরে তৃতীয় দেশ হিসেবে ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে ব্যালিস্টিক মিসাইল নিক্ষেপ করে তারা ৮৬৫ কিলোমিটার উপরে থাকা একটি অকেজো উপগ্রহ ধ্বংস করেছিল। তার পর থেকে চিন নাকি বেশ কিছু ক্ষেপণাস্ত্র পাঠিয়েছে, যারা বায়ুমণ্ডলের বাইরে থাকা উপগ্রহ এবং ক্ষেপণাস্ত্রকে আঘাত করতে সক্ষম। সেই তুলনায় ভারতের সামর্থ্য সীমিত, এখনও অনেক পথ যেতে হবে। বৃহত্তর অ্যান্টি-ব্যালিস্টিক মিসাইল কর্মসূচির ক্ষেত্রেও তা-ই। জাতীয় নিরাপত্তার কিছু দিকের উপর জোর দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে আকাশ-প্রতিরক্ষার প্রস্তুতিতে এখনও বিরাট ফাঁক আছে, সে জন্য পূর্বসূরিদের সঙ্গে সঙ্গে তাঁকেও দোষের ভাগী হতে হবে। আকাশ এবং মহাকাশে প্রতিরক্ষার সামগ্রিক পরিকাঠামোয়, যেমন, রেডার ব্যবস্থা, দ্রুত সতর্কতার আয়োজন, ইলেকট্রনিক যুদ্ধ, দূরসংযোগ, ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। এ-স্যাট দিয়ে এই সব ঘাটতির পূরণ সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী তাঁর নির্বাচনী কেন্দ্রে নানান পারিতোষিক বিতরণ করেছেন। দেশের সামগ্রিক আকাশ-প্রতিরক্ষার ব্যাপারে তুলনীয় আগ্রহ দেখালে ভাল হত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

EMISAT India Anti Satellite Missile
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE