Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

স্বাধীনতা সংগ্রামী, ছিলেন মন্ত্রীও

যে সব সংখ্যালঘু নেতা দেশভাগের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন আব্দুস সাত্তার। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তিনি বিধানচন্দ্র রায়ের মন্ত্রীসভায় শ্রমমন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন। লিখছেন সোমনাথ ভট্টাচার্য১৯২৮ সালের মার্চে ব্রিটিশ সরকার ‘সাইমন কমিশন’ গঠন করলে সেই কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ঢেউ ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।

আব্দুস সাত্তার।

আব্দুস সাত্তার।

শেষ আপডেট: ১৮ অগস্ট ২০১৯ ০১:২৭
Share: Save:

স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে কালনার যোগ অতি প্রাচীন। বিশ শতকের প্রথম দিকে কালনায় যে সব আশ্রম গড়ে উঠেছিল তার মধ্যে বেশ কয়েকটি আশ্রম ছিল স্বদেশী আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। কালনার ‘জ্ঞানানন্দ আশ্রম’-এ বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীর জীবন কেটেছিল। কালনায় পা পড়েছিল নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর মতো মানুষেরও। এই কালনারই বৈদ্যপুরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী ও প্রাক্তন মন্ত্রী আব্দুস সত্তার। ১৯১১ সালের ৩ মার্চ কালনার বৈদ্যপুর পঞ্চায়েতের টোলা গ্রামে আব্দুস সাত্তার জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শামসের আলি মণ্ডল। আব্দুস সাত্তার মাত্র পাঁচ বছর বয়সে পিতৃহারা হন। ফলে তাঁকে প্রতি পালনের সব দায়িত্বই ছিল তাঁর মায়ের উপরে। তাঁর মা আব্দুস সাত্তারকে টোলা গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করেন। ন’বছর বয়সে বৈদ্যপুরে ‘জর্জ ইনস্টিটিউশন’ -এ (বর্তমানের ‘বৈদ্যপুর রামকৃষ্ণ বিদ্যাপীঠ’) ভর্তি হন।

সেই সময় থেকে যে মানুষদের হাত ধরে কালনায় স্বদেশী ভাবধারা ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন জিতেন্দ্রনাথ মিত্র। বৈদ্যপুরের জর্জ ইনস্টিটিউশন-এ তাঁকেই শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন আব্দুস সাত্তার। সে কালের স্বদেশী আন্দোলনকারীদের মধ্যে বাগ্মীতা ও পাণ্ডিত্যে জিতেন্দ্রনাথ মিত্রের জুড়ি মেলা ভার ছিল। সেই মানুষটির কাছেই আব্দুস সাত্তারের জাতীয়তাবোধে হাতেখড়ি। ১৯২৫ সালে গাঁধীজী যখন বর্ধমানে আসেন তখন আব্দুস সাত্তার গাঁধীজীকে দেখতে গিয়েছিলেন। গাঁধীজীর ভাষণই আব্দুস সাত্তারকে কংগ্রেস সম্পর্কে উৎসাহী করে তোলে।

১৯২৮ সালের মার্চে ব্রিটিশ সরকার ‘সাইমন কমিশন’ গঠন করলে সেই কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ঢেউ ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। সেই আন্দোলন স্পর্শ করেছিল সাতেরো বছরের এই যুবকটিকেও। তিনি হরতালে যোগ দেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে নানা ধরনের গঠনমূলক কাজেও যোগ দিয়েছিলেন আব্দুস সাত্তার। তিনি টোলা গ্রামে সমবায় সমিতি গঠন করে গ্রামের মানুষদের মধ্যে সাক্ষরতা বিস্তারের জন্য নৈশ বিদ্যালয় তৈরি করেছিলেন। প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি বর্ধমান রাজ কলেজে ভর্তি হন। রাজ কলেজে পড়ার সময় তাঁর সঙ্গে যাদবেন্দ্র পাঁজার পরিচয় হয়। মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি কংগ্রেসের সদস্যপদ লাভ করেন।

শ্রমমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিচ্ছেন আব্দুস সাত্তার (বাঁ দিকে)। তৎকালীন রাজ্যপাল পদ্মজা নাইডু (মাঝে) ও মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় (ডান দিকে)। দার্জিলিং-এর রাজভবন, ১৯৫৭। নিজস্ব চিত্র

১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হলে তিনি এই আন্দোলনে যোগ দেন। সেই সময়ের বিভিন্ন জনসভায় বক্তৃতা দিতেন আব্দুস সাত্তার। জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি ইংরেজ সরকারের রোষে পড়েন। আব্দুস সাত্তারের বক্তৃতা দেওয়ার উপরে ইংরেজ সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ১৯৩০ সালের ৩০ জুন ইংরেজ সরকারের সেই নির্দেশিকা অমান্য করে আব্দুস সাত্তার বৈদ্যপুর রথতলার মাঠে বক্তৃতা দিতে শুরু করলে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। কারামুক্তির পরে আব্দুস সাত্তার আইএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তার পরে কলকাতায় পড়াশোনার জন্য ভর্তি হন। সেখানে পড়ার সময়ে তিনি ফের ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। সেখানে ছাত্র আন্দোলন করার অপরাধে তাঁকে ব্রিটিশ সরকার কারারুদ্ধ করে। হিজলি জেলে বন্দি থাকার সময় আব্দুস সাত্তারের সঙ্গে সেই সময়ের বেশ কয়েক জন কংগ্রেস নেতার পরিচয় হয়। তাঁরা হলেন, প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ, প্রফুল্লচন্দ্র সেন, ক্ষুদিরাম মোদক, ভূপেন্দ্রনারায়ণ সেনগুপ্ত প্রমুখ। হিজলি জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে তিনি কলকাতায় ফিরে সিটি কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। ১৯৩৬ সালে সাত্তার সাহেব ‘বঙ্গীয় কংগ্রেস কমিটি’ এবং ১৯৩৭ সালে ‘নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি’-র সদস্যপদ লাভ করেন।

১৯৩৮ সালের ২৯ এপ্রিল আব্দুস সাত্তার নূরউন্নেসাকে বিবাহ করেন। আব্দুস সাত্তারের স্ত্রী নূরউন্নেসাও স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর স্বামীকে নানা ভাবে সহায়তা করেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই নূরউন্নেসার পরিবারে মুক্ত সংস্কৃতির চর্চার রেওয়াজ থাকায় তিনি দেশাত্মবোধক বই পড়ায় অভ্যস্ত ছিলেন। বিয়ের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আব্দুস সাত্তারকে ব্রিটিশ সরকার গ্রেফতার করে। সেই সময় প্রায় দু’বছর জেলে কাটাতে হয়। ১৯৪০ সালে জেল থেকে মুক্তির পরে আব্দুস সাত্তার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন পাশ করে বর্ধমান আদালতে ওকালতি শুরু করেন। তবে কর্মজীবনেও বিপদ তাঁর পিছু ছাড়েনি। ওকালতি শুরুর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ফের কারারুদ্ধ হন। এর পরে নানা অন্দোলনের মধ্যে দিয়ে কাটল কয়েকটি বছর। দেশভাগ ও স্বাধীনতার সময় এগিয়ে আসতেই ফের রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হল। সেই সময় যে সব সংখ্যালঘু নেতা দেশভাগের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন আব্দুস সাত্তার। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তিনি বিধানচন্দ্র রায়ের মন্ত্রীসভায় শ্রমমন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন।

স্বাধীনতা অন্দোলনের পাশপাশি, পত্রিকা সম্পাদনার মাধ্যমে দেশপ্রেমের প্রচারের কাজেও আব্দুস সাত্তারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তিনি প্রথম জীবনে ‘বর্ধমানের কথা’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। এই পত্রিকার মাধ্যমে তিনি কংগ্রেস ও মহত্মা গাঁধীর বাণী প্রচারে উদ্যোগী হন। এই পত্রিকা ছাড়াও তিনি ‘বর্ধমানের বাণী’, ‘দেশের ডাক’, প্রভৃতি পত্রে নিয়মিত লেখালেখি করতেন। সেই সময় বেশ কয়েকটি স্কুল প্রতিষ্ঠার সঙ্গেও তিনি জড়িয়েছিলেন। মঙ্গলকোটের ‘নওদাপাড়া জুনিয়র হাই স্কুল, সিঙ্গি গ্রামের ‘কাশীরাম দাস স্মৃতিপাঠাগার’, বেড়ুগ্রামের ‘বান্ধব বিদ্যাপীঠ’, গোপালপুরের ‘বান্ধব বিদ্যালয়’ প্রভৃতি স্থাপনের সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়ে রয়েছে। ১৯৬৫ সালের ২৯ জুলাই চিত্তরঞ্জন হাসপাতালে এই মানুষটির জীবনাবসান হয়। তাঁর প্রয়াণে শোকপ্রকাশ করেছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেন।

লেখক কালনার ইতিহাস গবেষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Abdus Sattar Politics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE