Advertisement
১৬ জুন ২০২৪

উত্তরের অখ্যাত এক নদীর কথা, মুজনাই যার নাম

বর্ষায় ভয়ঙ্কর, অন্য সময় অন্নদাতা। বারে বারে যাত্রাপথ বদলে চিরঅভ্যস্ত নদী মুজনাই। এ নদীর স্রোতে মিশে রয়েছে ডুর্য়াসের ইতিহাস। লিখছেন শৌভিক রায়নদী ঘিরে তাই এই আবেগ সহজে বোঝা যায়। বৃহত্তর ও পরিচিত নদীগুলির পাশাপাশি ছোট অজানা নদীগুলির গুরুত্বও কম নয়।

উত্তরের আর পাঁচটি নদীর চেয়ে একটু আলাদা মুজনাইকে ঘিরে পর্যটন প্রসারের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে।

উত্তরের আর পাঁচটি নদীর চেয়ে একটু আলাদা মুজনাইকে ঘিরে পর্যটন প্রসারের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে।

শেষ আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০২:৪৯
Share: Save:

নদীমাতৃক বঙ্গদেশে নদীর নামে উৎসব হবে, উপন্যাস বা পত্রিকা প্রকাশ পাবে, বাস-ট্রেন বা জায়গার নাম, এমনকি মানুষের নামও নদীর রাখা হবে, সেটা খুব স্বাভাবিকই। কারণ, নদী মানে তো জীবন।

নদী ঘিরে তাই এই আবেগ সহজে বোঝা যায়। বৃহত্তর ও পরিচিত নদীগুলির পাশাপাশি ছোট অজানা নদীগুলির গুরুত্বও কম নয়। ছোট ছোট অখ্যাত এই নদীগুলির তীরে গড়ে উঠেছে জানা-অজানা কত জনপদ আর সেই জনপদের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কত ইতিহাস! এ রকমই অখ্যাত এক নদীর নাম মুজনাই। উত্তরের আর পাঁচটি নদীর চেয়ে একটু আলাদা মুজনাইকে ঘিরে পর্যটন প্রসারের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। কারণ, নদী বিশেষজ্ঞেরা নদীটিকে রহস্যময় মনে করেন। জলঢাকার বাম তীরের উপনদী হিসেবে পরিচিত মুজনাই আলিপুরদুয়ার জেলার মাদারিহাটের কাছে ভুটান পাহাড়ের দক্ষিণ ঢালে হান্টাপাড়ার উচ্চভূমি থেকে সৃষ্ট। এই অঞ্চলে বেশ কিছু নদীর খাত রয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেগুলি বর্ষাকাল ছাড়া বাকি সময় একেবারেই শুষ্ক থাকে। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে এখানে রয়েছে কয়েকটি প্রস্রবণ, যেখান থেকে অনবরত বেরিয়ে আসা জল মুজনাইকে সারাবছর সজীব রাখে। পাশাপাশি মুজনাইয়ের যাত্রাপথে বেশ কিছু নামহীন প্রবাহ মিলিত হয়ে তাকে পুষ্ট করেছে। হান্টাপাড়া অঞ্চলের এই উচ্চভূমিতে প্রস্রবণগুলির কাছেই রয়েছে প্রাচীন শিবমন্দির। ঠিক কবে প্রতিষ্ঠিত এই মন্দির, সে বিষয়ে নিশ্চিত করে জানা যায় না। প্রস্রবণ ও মন্দির ঘিরে বসন্তের শুরুতে পুজো ও মেলায় মেতে ওঠে এ অঞ্চলের জনজাতি।

মুজনাই রাঙালিবাজনা হয়ে প্রবেশ করেছে বৃহত্তর জলদাপাড়ার গভীর অরণ্যে। এখানেও তার সঙ্গে মিশেছে বেশ কিছু নামহীন প্রবাহ। জঙ্গল সফর শেষে মুজনাই দেখা দেয় জটেশ্বরের কাছে। সেখান থেকে বাঁক নিয়ে ফালাকাটার পাশ দিয়ে প্রবাহিত মুজনাইয়ের প্রবেশ কোচবিহার জেলায় শৌলমারীর কাছে। ক্রমাগত বাঁক-বদল করে করে অবশেষে মুজনাই মিলিত হচ্ছে জলঢাকার সঙ্গে আর মিলনস্থল থেকে জলঢাকা মুজনাইয়ের মিলিত প্রবাহ মানসাই নাম নিয়ে বয়ে চলেছে। অতীতে মুজনাইকে মানসাই বলা হত। এখনও মুজনাই তীরের প্রবীণেরা সেটাই বলেন। এর জন্য মুজনাইয়ের যাত্রাপথে বদল দায়ী। এক সময় মুজনাই জলঢাকা-সহ কালাপানিতে এসে পুরনো তোর্সার সঙ্গে এক হয়ে বানিয়াদহের পূর্বে রংপুরে ধরলাতে মিশত। মনে করা হয়, এই জন্যই মুজনাই এক সময় মানসাই নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু কালের গতিতে জলঢাকা তার বাম তীরের নদীটিকে অঙ্গীকৃত করে উপনদীতে পরিণত করায় মানসাই নামটি মুছে গিয়ে মুজনাই নামটি এসেছে।

সাহিত্যিক লীলা মজুমদারের লেখা এক চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে মুজনাই নদীর নাম।

ডুয়ার্সের লেখক ব্রজগোপাল ঘোষ মুজনাই সম্পর্কে অদ্ভুত তথ্য জানিয়েছেন। তাঁর বাল্যকালে তিনি তাসাটি চা-বাগানের বড়বাবু অনাথবন্ধু ঘোষ ও ডিমডিমা চা-বাগানের ফিডারবাবুকে জটেশ্বরের কাছে কালভার্ট পেরিয়ে মুজনাই নদীতে ঘড়িয়াল শিকার করতে যেতে দেখতেন। মৎস্যশিকারী এই দু’জন একদিন মাছ ধরতে গিয়ে ঘড়িয়ালদের রোদ পোয়াতে দেখেন এবং তারপর থেকে ঘড়িয়াল শিকার তাঁদের নেশা হয়ে দাঁড়ায়। উত্তরের আর কোনও নদীতে সে যুগে ঘড়িয়াল দেখা যেত বলে জানা যায়নি। অতিসম্প্রতি এক বন্যপ্রাণ চোরাচালানকারীর কাছ থেকে অতিবিরল বাতাগুর বাসকা প্রজাতির কচ্ছপ উদ্ধারের পর অনুসন্ধান করে দেখা যায়, মুজনাইয়ের এক নির্দিষ্ট জায়গায় এই প্রজাতির কচ্ছপ রয়েছে। পূর্ব ভারতের ত্রিপুরা ও অসমের দু'একটি জায়গা ছাড়া আর কোথাও এই প্রজাতি পাওয়া যায় না। মুজনাইয়ের মতো অখ্যাত নদীতে এমন জলজ প্রাণ চমকেই দেয়!

মুজনাই নামটির অর্থ কী, সে সম্পর্কে কেউ আলোকপাত করতে পারেননি। তবে এই নামে চা-বাগান আছে। সম্প্রতি চা-বাগানটি বন্ধ হয়েছে। শিশুবাড়ির কাছে মুজনাই নামের স্টেশনও রয়েছে। ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ ডুয়ার্স রেলওয়ে বীরপাড়া থেকে মাদারিহাট অবধি প্রসারিত হওয়ার সময় এই স্টেশনটির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। কিন্তু কেন তার নাম মুজনাই হল, সে বিষয়ে তথ্য নেই। সম্ভবত, মুজনাই চা-বাগান থেকে চা পাঠানোর কাজে এই স্টেশনটিই ছিল ভরসা। তাই স্টেশনের নাম মুজনাই।

আলিপুদুয়ার জেলার বাকি ব্লকগুলি অরণ্য, চা-বাগান প্রধান হওয়ায় জেলার শস্যভাণ্ডারের দায়িত্ব নিয়েছে উর্বর ফালাকাটা ব্লক আর সেই দায়িত্ব পালনে মুজনাই সহায়ক ভূমিকা নিয়েছে। লোকজীবনে, ব্রতকথায়, ভাওয়াইয়া গানে উঠে আসে মুজনাই। এ নদীতে ফালাকাটার দশমীর ভাসান উত্তরবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী নিরঞ্জন। মুজনাইয়ের তীরেই ফালাকাটায় ১৯৮০ সালে শুরু হয়েছিল শিলিগুড়ির আদলে উত্তরবঙ্গের দ্বিতীয় মুক্তমঞ্চ নাট্য-আন্দোলন। ইদানীং আয়োজিত হচ্ছে মুজনাই উৎসবও। ১৩ ভাদ্র জলঢাকা ও মুজনাইয়ের সঙ্গমে হয় নৌকো প্রতিযোগিতা।

সাহিত্যিক লীলা মজুমদার তাঁর এক চিঠিতে মুজনাই তীরের এক বালককে লিখেছিলেন, ‘নদীর নামও মুজনাই/যাত্রাপথের বুঝ নাই/সেই পথে চলেছি, বুকে বল পেয়েছি/ পরম সুখে ডাকি তোদের আয় ভাই’। সত্যিই এই নদীর 'বুঝ' নাই। ছোট্ট এই নদী বর্ষায় ভয়ঙ্কর, অন্য সময় অন্নদাতা। তার বুকে ভেসে ভুটানিরা এক সময় বাণিজ্যে আসে। বারবার খাত বদলায় এ নদী। আর পার কুলুকুলু বয়ে যাওয়ায় লিখে রাখে ডুয়ার্সের জনপদগুলির ইতিহাস।

(লেখক কোচবিহার মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mujnai River
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE