পঙ্কজ-সৌরভের পর তেমন কোনও মুখ উঠে আসেনি বাংলার ক্রিকেটে। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
খেলা কোনও দিন বঙ্গসংস্কৃতির অঙ্গ ছিল কি না, সে সম্পর্কে আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে। বিশ্ববাংলায় কোথাও বঙ্গসংস্কৃতির আয়োজন হলে, নাচ-গান, কবিতাপাঠ, সাহিত্য আলোচনা, নাটক, ঘটা করে সব কিছুই হয়। ব্রাত্য হয়ে থাকে খেলা। কোথাও আধ ঘণ্টা সময় খেলার জন্য বরাদ্দ থাকে না। বাংলা বা বাঙালির খেলাধূলার কোনও প্রামাণ্য ইতিহাস নেই।
খেলার আদিপর্ব নিয়ে কেউ কিছু লেখা লিখে গিয়েছেন বটে, কিন্তু তা থেকে বোঝা সম্ভব নয়, বাঙালি খেলায় আকৃষ্ট হল কী করে? অবশিষ্ট ভারত বাঙালিদের চেনে ফুটবল, রসগুল্লা আর মছলিপ্রিয় হিসাবে। কিন্তু ফুটবল নিয়েও আর গর্ব করার উপায় নেই। বাঙালি এখন পিছনের সারিতে চলে গিয়েছে।
খবরের কাগজে খেলার পৃষ্ঠাগুলো খুললেই আজকাল চোখে পড়ে, বিদেশ সফররত ‘বিরুষ্কা’র (বিরাট কোহালি আর অনুষ্কা শর্মার) আলিঙ্গনাবদ্ধ ছবি। জ্বলজ্বল করেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো বা লিওনেল মেসি। কখনও কখনও ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগানের খবরও দেখি। ব্যস, বাঙালি যে আর কোনও খেলা খেলে, তা কদাচিত্ টের পাই। খেলার দফতর যাঁদের হাতে, তাঁরা হয়তো ভাবেন, আর কোনও খেলায় বাঙালির তেমন সাফল্য নেই। ছাপার দরকারটা কী? এই ধ্যানধারণাটাই প্রমাণ করে, ক্রীড়াক্ষেত্রে বাঙালি যেমন আত্মবিস্মৃত জাতি, তেমনই অদূরদর্শী।
আরও পড়ুন: নববর্ষের শুভেচ্ছাই বাঙালিকে বাঁচিয়ে রেখেছে
এই শহরেরই এক জন অ্যাথলিট নর্মান প্রিচার্ড অলিম্পিক থেকে দু’টো পদক এনেছিলেন। প্রায় পঞ্চাশ বছর পর সেটা আবিষ্কার করেন ক্রীড়া সাংবাদিক অজয় বসু। অলিম্পিক রেকর্ডের বইয়ে প্রিচার্ডের পাশে দেশের নাম হিসাবে লেখা ছিল ইস্ট ইন্ডিজ। অজয় বসু অলিম্পিক কমিটির কাছে চিঠি লিখে জানতে চান, ইস্ট ইন্ডিজ দেশটা কোথায়? কমিটি উত্তর দেয়, দেশটা আসলে ইন্ডিয়া। ১৯০০ সালে প্যারিসে যখন অলিম্পিক হয়, তখনও ভারত পরাধীন। সেই কারণেই হয়তো প্রিচার্ড ভারতের প্রতিনিধি হয়ে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। এই প্রিচার্ড পরে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের হয়ে আইএফএ শিল্ডের প্রথম হ্যাটট্রিকটা করেন। একটা সময় আইএফএ-র সচিবও হয়েছিলেন।
আরও পড়ুন: বিবেকানন্দের হিন্দুত্ব না বুঝিয়ে মানুষকে তাঁর কথা সরল ভাবেই বোঝানো যেত
বাঙালির আত্মবিস্মরণের আরও নজির, মোহনবাগান ক্লাবের আইএফএ শিল্ড জয়। ১৯১১ সালে একটা নেটিভ দল হঠাত্ কী করে দুর্ধর্ষ হয়ে উঠে, একটা ব্রিটিশ দল ইস্ট ইয়র্কশায়ারকে হারিয়ে দিতে পেরেছিল, তার ফুটবলীয় বিশ্লেষণ কেউ লিপিবদ্ধ করে যাননি। একাদশে ভারতীয় ফুটবলের সেই সূর্যোদয়ের কাহিনি লিখতে বসে জানতে পেরেছিলাম, মোহনবাগান দলটায় সে বার মাত্র এগারো জন ফুটবলারই ছিলেন। অধিনায়ক শিবদাস ভাদুড়ি তাই বাধ্য হয়েছিলেন, কাঁধের হাড় সরে যাওয়া গোলকিপার হীরালাল মুখোপাধ্যায়কে ফাইনালে খেলাতে। খেলাধূলায় আজ পর্যন্ত ভারতীয়দের সেরা দশ সাফল্যের মধ্যে মোহনবাগানের এই শিল্ডজয় অবশ্যই থাকবে। কেননা, এর পরই দেশবাসীর মনে বিশ্বাসটা বদ্ধমূল হতে শুরু করে, খেলার মাঠে যদি ইংরেজদের হারানো যায়, তা হলে দেশ থেকেও তাঁদের তাড়ানো সম্ভব। এর কয়েক মাস পরেই কলকাতা থেকে ইংরেজরা রাজধানী গুটিয়ে নিয়ে চলে যায় দিল্লিতে।
গোবর গোহোর বিশ্বজয় বাঙালিকে আত্মবিশ্বাস দিল। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
বাঙালির খেলাধূলার ইতিহাসে অনেক কাহিনিই অকথিত থেকে গিয়েছে। একটাই কারণে। খেলা কখনও বাঙালির জীবনে অগ্রাধিকার পায়নি। খেলাও যে কৃষ্টির অঙ্গ, সেটা একটা শতাব্দী পেরিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও বাঙালি বুঝতে পারেনি। এক জন চিকিত্সক, আইনজীবী, গায়ক, অভিনেতা বা লেখকের সম্মান এক জন ক্রীড়াবিদকে এই ক’দিন আগেও সমাজ দেয়নি। বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের ধারণা ছিল, খেলা মানেই নিম্নজাতীয় কিছু এবং বোধবুদ্ধিহীনরাই এতে আগ্রহী। শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবীরা কেউ তাই আকৃষ্ট হননি খেলার ইতিহাস নিয়ে কিছু লেখার। স্যাটেলাইট বিপ্লবের পর এই ধারণাটা অবশ্য কিঞ্চিত বদলেছে। কিন্তু এত দেরিতে বাঙালির চৈতন্যোদয় হল যে, অন্য প্রদেশের মানুষরা তত দিনে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে।
সত্যি কথা বলতে কী, উনবিংশ শতাব্দীর আগে বাঙালির কাছে খেলা ছিল নিছক বিনোদনের অঙ্গ। ঘরে বসে সময় কাটানোর উপায়। দাবা, পাশার চল চর্যাপদের আমলে ছিল। পর্তুগিজরা এসে তাস খেলাটা বাঙালির অন্তঃপুরে ঢুকিয়ে দিলেন। একটা কথাই চালু হয়ে গেল, তাস-দাবা-পাশা, তিন সর্বনাশা। সেইসময় জলে, স্থলে আর অন্তরীক্ষে গ্রাম্য বাঙালির কিছু নিজস্ব খেলাও ছিল। যেমন, হাডুডু, কানামাছি, লাঠি আর ছোরা খেলা, দৌড়, খো খো, দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, কড়ি খেলা, এ্যাঙ্গা এ্যাঙ্গা। অন্তরীক্ষে ঘুড়ি ওড়ানো, পায়রা, বুলবুলির লড়াই। মুষ্টিমেয় বাঙালি অভিজাত অবশ্য মৃগয়ায় যেতেন, অশ্বারোহণ, মল্লক্রীড়া পছন্দ করতেন। কেউ কেউ স্বদেশি ব্যায়াম, বলরাম ব্যায়াম বা সমষ্টি ব্যায়াম মারফত্ শরীরচর্চায় ব্যস্ত থাকতেন।
বলা হয়, প্রতি দেশেই সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পালা বদলের সঙ্গে সঙ্গে খেলার প্রতি মনোভাব বা ঝোঁক বদলাতে থাকে। বাঙালির খেলাধূলার ইতিহাসেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। একদল হিন্দু বাঙালি মুসলিম শাসকদের আনুকূল্য পাওয়ার আশায় ইসলামি আদব-কায়দা, আহার-বিহার, সঙ্গীত, শিল্পকর্ম, এমনকি কোলাতেও ঝুঁকে পড়লেন। সেই সময় দাবার বদলে পাশায় আগ্রহ বেড়ে যায়। পুরুষরা অশ্বারোহণ আর অসি চালনাতে সময় দিতে থাকেন। ইংরেজ আমলে ফের ব্যাপক পরিবর্তন। দেওয়ান, মুত্সুদ্দি, বেনিয়ান, কেরানি বাঙালি ইংরেজদের অনুকরণ শুরু করেন। এই ভাবে বাঙালির জীবনে কিছু বিদেশি খেলার আগমন হল। যেমন ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, বক্সিং, ভলিবল ইত্যাদি।
বাঙালির ফুটবলপ্রীতি শুরু উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে। বাঙালিকে ফুটবল শেখানোর পিছনে শাসকদের অন্য একটা উদ্দেশ্য ছিল। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, শাসন করার জন্য শুধু রাজদণ্ডটি ব্যবহার করলেই চলবে না। নেটিভদের সঙ্গে মেলামেশা করতে হবে। এবং এর জন্য একটা মাধ্যম বের করা দরকার। ক্রীড়া ও শিক্ষা, এই দু’টি মাধ্যমেই পৌঁছে যাওয়া যাবে অভীষ্ট লক্ষ্যে। ক্রিকেট দিয়ে বাঙালিকে কাছে টানা যাবে না। ফুটবল কম খরচের খেলা। এর নেশাই ঢুকিয়ে দাও বাঙালির মধ্যে। ইংরেজদের দূরদর্শিতা বিফলে যায়নি। একটা বল পেলেই অনেক জন মিলে খেলা যায়। সহজ নিয়ম আর কম সময়ের খেলা। স্বামী বিবেকানন্দের একটা উক্তিও সেই সময় বাঙালিকে উদ্দীপ্ত করেছিল। ‘গীতা পাঠ করার চেয়ে, ফুটবল খেলা অনেক কাছে পৌঁছে দেবে ঈশ্বরের।’ বাঙালি তাই আঁকড়ে ধরেছিল আবেগমিশ্রিত খেলা ফুটবলকে।
বাঙালির কাছে ফুটবলের জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করে আইএফএ লিগে খেলার সুযোগ পাওয়ার পর থেকেই। ফুটবল মাঠে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই, মোহনবাগান কখনও ছাড়েনি। ইংরেজ আমলে লড়াইটা সীমাবদ্ধ ছিল ডালহৌসি আর ক্যালকাটা ক্লাবের সঙ্গে মোহনবাগানের। এর পর স্বাধীনতা সংগ্রাম জোরদার হতে লাগল। ইংরেজদের ক্লাব একটু একটু করে পিছনে হটতে শুরু করল। বাংলায় মুসলিম লিগের আমলে মাথা উঁচু করে দাঁড়াল মহামেডান স্পোর্টিং। টানা পাঁচ বার লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে তারা ছাপিয়ে গেল মোহনবাগানকেও। বাংলায় রাজনীতিতে মুসলিম লিগের প্রভাব কমে যেতেই উঠে এল ইস্টবেঙ্গল। দেশভাগের পর ছিন্নমূল হয়ে দলে দলে ও পার বাংলা থেকে মানুষ চলে এলেন এ পার বাংলায়। তাঁরা জড়ো হতে থাকলেন ইস্টবেঙ্গলের লাল-হলুদ পতাকার তলায়। বাংলার ফুটবলের সমৃদ্ধি ঘটল স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে, ঘটি-বাঙালের লড়াইকে সামনে রেখে।
কোনও সন্দেহ নেই, বাঙালি অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটিয়েছিল সেই সময়। সর্বভারতীয় টুর্নামেন্টগুলো…ডুরান্ড, রোভার্স, সন্তোষ ট্রফি জিতে। দু’টো এশিয়ান গেমস ফুটবল চ্যাম্পিয়ন হয়। টানা চারবার অলিম্পিক ফুটবলেও খেলার সুয়োগ পায়। কিন্তু এর জন্য যতটা কৃতিত্ব বাঙালির পাওয়া উচিত, তার চেয়ে অনেক বেশি দাবি করে এসেছে। জাতীয় দলের ওই স্বর্ণযুগে বাঙালির অবদান যত্সামান্য। এশিয়ান গেমস বা অলিম্পিক দলে কোনওবারই বাঙালি ফুটবলারের সংখ্যা চার জনের বেশি ছিল না। ভারতীয় দলে যবে থেকে বাঙালির সংখ্যা বেড়েছে, অধঃপতন শুরু হয়ে গিয়েছে সেইসময় থেকে। জাতীয় দলে বাঙালির সংখ্যা বাড়িয়ে ছিলেন কোচ প্রদীব বন্দ্যোপাধ্যায়। পাঁ-ছয় জন থেকে সেই সংখ্যাটা ১৯৮৬ সালে সোল এশিয়ান গেমসের সময় পৌঁছে যায় এগারোতে। কোরিয়ায় ভারতীয় দল সে বার মুখ থুবড়ে পড়েছিল।
শিবদাস ভাদুড়ি, উমাপতি কুমার, গোষ্ঠ পাল, শৈলেন মান্না, বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়, চুনী গোস্বামী ছাড়াও বীরপূজা পেতে পারতেন আরও কয়েক জন বাঙালি। কিন্তু তাঁরা তেমন সমাদর পাননি, কম জনপ্রিয় খেলায় যুক্ত ছিলেন বলে। তাঁদের এক জন কুস্তিগীর গোবর গোহো (তাঁর আসল নাম যতীন্দ্রচরণ গোহো)। ১৯২১ সালে আমেরিকার সানফ্রান্সিসকোতে গিয়ে গোবর গোহো বিশ্ব কুস্তিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। তিনিই প্রথম ও একমাত্র বিশ্বসেরা বাঙালি। মাঝে প্রায় একশো বছর পেরিয়ে গিয়েছে। বাঙালি পারেনি, কিন্তু অলিম্পিক থেকে পদক নিয়ে এসেছেন কুস্তিতে কে ডি যাদব, সুশীল কুমার ও ব্যাডমিন্টনে সাইনা নেহওয়াল। শক্তির খেলায় বাঙালির কোনও অস্তিত্ব আর নেই।
গত শতাব্দীর মাঝামাঝি চুনী গোস্বামী-প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে একই পংক্তিতে যে নামটা উচ্চারিত হত, তিনি ক্রিকেটার পঙ্কজ রায়। বিন্নু মাঁকড়ের জুটি হয়ে একটা বিশ্ব রেকর্ড ধরার কল্যাণে। শতাব্দীর শেষ ভাগে আর আক ক্রিকেটার সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের উত্থানে বাঙালি ফুটবলাররা ক্রমশ গ্ল্যামার হারাতে লাগলেন। শতাব্দীর মধ্যবর্তী পর্বে বাঙালি অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসে সারা ভারতে পথিকৃত্ হয়ে উঠেছিল। প্রথমে মিহির সেন, তাঁর পরে আরতি সাহা ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে এসে বাঙালি যুবসমাজের আইডল হয়ে ওঠেন। এঁদের অনেক আগে আর এক বাঙালি একটা দুঃসাহসিক অভিযান করেছিলেন। সাইকেলে তিনি বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। ইনি-ই প্রথম ভারতীয় যিনি ব্রাজিলে পা রাখেন। তাঁর নাম ব্রজেন বিশ্বাস। পর্বতারোহণেও বাঙালি উত্সাহ দেখিয়েছিল, দার্জিলিংবাসী তেনজিং নোরগের এভারেস্ট জয়ের পর। সেই পরম্পরা এখনও ধরে রেখেছেন প্রবাসী বাঙালি সত্যরূপ সিদ্ধান্ত দুর্গম কয়েকটি শৃঙ্গ জয় করে।
মাঝে মাঝে ভাবি, ইংরেজদের আমলে বাঙালি যদি ফুটবলে আকৃষ্ট না হয়ে ক্রিকেটে ঝুঁকত, তা হলে কী হত? কেউ গবেষণা করেননি, সেই সময় বাঙালি কেন ক্রিকেট থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিল? একটা সময় বাঙালির ধারণা ছিল, ক্রিকেট রাজারাজড়াদের খেলা। খরচসাপেক্ষ এবং খেলাটা সাধারণ মানুষের জন্য নয়। তা ছাড়া, আবহাওয়াজনিত কারণে, ফুটবলের মতো সারা বছর ক্রিকেট খেলা সম্ভব নয়। কুমারটুলির এক ধনী পরিবারের ছেলে পঙ্কজ রায়ই প্রথম বাঙালিকে ইডেনমুখী করে তোলেন। ক্রিকেটের জাতীয় দলে তখন মরাঠিদের প্রবল দাপট। সেই ভিড়ের মাঝে এক বাঙালি মাথা উঁচু করে টিকে আছেন, এটা গর্বের বিষয় ছিল। বাঙালি তখন মনে করত, প্রতি পদে পদে তাদের বঞ্চনা করা হচ্ছে। সুঁটে বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পরবর্তীতে সুব্রত গুহর দলভুক্তির দাবিতে ইডেনে পোস্টারও পড়েছিল।
গত শতাব্দীর গোড়ার দিকে যখন কলকাতায় ফুটবলের জনপ্রিয়তা বাড়ছে, তখন মুম্বইয়ের পার্শি সম্প্রদায়ই প্রথম ক্রিকেট নিয়ে মেতে ওঠেন। পশ্চিম ভারতে ওঁরাই প্রথম ইংরেজদের জীবনযাত্রার অনুকরণ করেছিলেন। পার্শিদের হাতে অর্থ ছিল। সারাদিন ধরে ক্রিকেট খেলার মতো সময়ও ছিল। ওদের দেখাদেখি হিন্দু আর মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষও ক্রিকেট খেলতে শুরু করেন। মুম্বই কটন মার্কেট দখল করে নিচ্ছিলেন গুজরাতি আ মুসমানরা। সেইসঙ্গে বন্দর এলাকাও। তাঁরাও ক্রিকেট টিম গড়তে শুরু করলেন। হিন্দু, মুসলিম আর পার্শি-ধর্মের ছাপ থাকায় মহারাষ্ট্রে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল ক্রিকেট। মারাঠি ব্রাহ্মণ আর বেনিয়ারা খেলাটাকে আপন করে নিলেন, শারীরিক সংঘর্ষের আশঙ্কা কম থাকায়। জন্ম হল কোয়াড্রাঙ্গুলার আর পেন্টাঙ্গুলার টুর্নামেন্টের। পরে দাঙ্গার কারণে যা বন্ধ করে দিতে হয়।
ভাবতে অবাক লাগে, অধিকতর শক্তি লাগে এমন খেলা ফুটবল, বাঙালি বেছে নিয়েছিল কেন? বাঙালি খুব শক্তিশালী জাতি ছিল, উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি
পর্যন্ত এমন কোনও নিদর্শন নেই ইতিহাসের পাতায়। মেধার দিক থেকে অগ্রগণ্য হলেও, শারীরিক দিক দিয়ে বাঙালি দলগত এমন কিছু করেনি, যা মনে রাখার মতো। সম্ভবত এই কথাটা উপলব্ধি করেই মনীষীরা বলতে শুরু করেন শরীরচর্চার কথা। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র মা ভবানীর আরাধনা করে বাঙালিকে বাহুবল বাড়ানোর পরামর্শ দিলেন। দিকে দিকে আখড়া গড়ে উঠল। গোবর গোহোর বিশ্বজয় বাঙালিকে আত্মবিশ্বাস দিল। এর তিন বছর পর এক বাঙালি পূর্ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় আর একটা দুঃসাহসিক কাজ করলেন। বিশ্বস্তরে নিজেকে যাচাই করার জন্য তিনি নিজের উদ্যোগেই চলে গেলেন অ্যান্টোয়ার্প অলিম্পিকে। তিনিই প্রথম বাঙালি, যিনি অলিম্পিকে যান। পূর্ণচন্দ্র পদক আনতে পারেননি। শতাব্দী পেরোতে চলল, আজ পর্যন্ত কোনও বাঙালিই অলিম্পিকের ব্যক্তিগত পদক পাননি। অল্পের জন্য হাত ফসকেছেন শুটার জয়দীপ কর্মকার ও জিমন্যাস্ট দীপা কর্মকার।
খেলার প্রসারে একটা সময় বাঙালির যা অবদান, তা অবিস্মরণীয়। সারা দেশে ফুটবল খেলাটাকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তো বটেই, অনেক বিদেশি খেলার সর্বভারতীয় সংগঠন তৈরি করার পিছনে বাঙালি। যেমন, বক্সিং। শক্তির এই খেলাটিকে শুধু বাঙালিদের মধ্যেই নয়, সারা ভারতেও ছড়িয়ে দিয়েছিলেন পরেশলাল রায়। এই কারণে তাঁকে ফাদার অব ইন্ডিয়ান বক্সিং বলা হয়।
এর পর বলাইদাস চট্টোপাধ্যায় বেসবল খেলাটাকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সফল হননি। আর একটা খেলার কথা বলি...ব্যাডমিন্টন। গোবর গোহোর জামাইবাবু শরত্চন্দ্র মিত্র চালু করেছিলেন ব্যাডমিন্টন। এই খেলাটি টিকে যায়। সেই সময় ব্যাডমিন্টনে বিশ্বস্তরে উঠেছিলেন মনোজ গুহ। লন টেনিস, ভলিবল,
সাঁতার থেকে শুরু করে তিরন্দাজি— এই রকম অনেক অলিম্পিক খেলার ধাত্রীগৃহ কলকাতা। লন্ডন অলম্পিকে যে ভারতীয় দলটি অংশ নিতে গিয়েছিল,
তার চল্লিশ শতাংশ সদস্যই ছিলেন বাঙালি। এখন সেটা নেমে এসেছে দুই–তিন শতাংশে। খেলোয়াড়দের মতো কর্মকর্তারাও এখন পিছনের সারিতে চলে গিয়েছেন। বছর তিরিশ আগেও ভারতীয় অলিম্পিক সংস্থায় বাঙালির যে দাপট ছিল, এখন তার কণামাত্র নেই।
একটা সময় কলকাতা ছিল খেলাধূলার তীর্থভূমি। ভিন রাজ্যের ফুটবলাররা এখানে খেলতে না পারলে জাতে উঠতেন না। কী ভাবে নষ্ট হয়ে গেল সেই সুনাম! পঁচাত্তর সালে কলকাতায় নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম তৈরি হওয়ার পর কেরল থেকে এক দল প্রতিনিধি এলেন এটা দেখার জন্য যে, খেলার পরিকাঠামো কী ভাবে তৈরি করা যায়। ফিরে গিয়ে ওঁরা স্পোর্টস অ্যাকাডেমি বানালেন। দশ বছরের মধ্যে পিটি ঊষা, সাইনি অ্যাব্রাহাম, উইলসন চেরিয়ান, ভালসাম্মার মতো আন্তর্জাতিক তারকা তুলে আনলেন মলয়ালিরা। আর আমাদের নেতাজি স্টেডিয়াম ব্যবহার করা হতে লাগল রাজনৈতিক সমাবেশের জন্য। যুবভারতীর মতো বিশাল ফুটবল স্টেডিয়াম সারা ভারতে আর একটাও নেই। অথচ ক’দিন খেলা হয় সেখানে? বা অ্যাথলেটিক ট্র্যাকে ছেলেমেয়েরা প্র্যাকটিস করার সুযোগ পায়?
বিশ্বের দরবারে গিয়েছেন, দীপা কর্মকার ছাড়া এমন কোনও জিমন্যাস্টের নাম মনে পড়ে না।
সত্যি খুব লজ্জা হয় যখন ভাবি, জাতীয় গেমসে বাংলা একটা সময় মহারাষ্ট্র, কেরল, পঞ্জাবের সঙ্গে পাল্লা দিত। এখন তালিকায় আমাদের স্থান সতেরো। মণিপুরেরও অনেক তলায়। এ বার গেমসে বাংলা হয়তো ২৪তম স্থানে শেষ করত, কিন্তু পঞ্জাবের এক বক্সারকে নামিয়ে দিয়ে সাত ধাপ উঠে এসে কোনও রকমে মুখরক্ষা করে। ইদানীং কিছু ক্রীড়াবুদ্ধুজীবী বাংলায় বসবাসকারী অবাঙালি খেলোয়াড়দেরও বাঙালি বলে চেষ্টা করেন। আমার কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু, যাঁদের সম্পর্কে বলা হচ্ছে, তাঁরা কি বাঙালি হতে রাজি? হকিতে চারটে অলিম্পিক পদক লেসলি ক্লডিয়াসের দখলে। এমন কৃতিত্ব ভারতে আর কারও আছে কি না সন্দেহ। কিন্তু ক্লডিয়াস নিজেও সম্ভবত হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন, ঘোষণা শুনে। আফশোসের কথা, ক্লডিয়াসকে চোখের সামনে দেখেও গত পঞ্চাশ বছরে বাঙালি বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখেনি। এমন সুজলা, সুফলা, শস্যশ্যামলা দেশ থেকে আর যা-ই হোক, বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বেরনো কঠিন। বেরোবেই বা কী করে? বাঙালি কোনও দিন প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করেনি। আগ বাড়িয়ে বিদেশি বা ভিন রাজ্যের আগ্রাসন ঠেকাতে যায়নি। খেলার মাঠে লড়াই করার থেকে নৃত্য–গীত–কাব্যে অধিক উৎসাহ দেখিয়েছে। খেলার দুনিয়ায় ব্যক্তি হিসাবে বাঙালি কখনও কখনও অন্যদের ছাপিয়ে গিয়েছে বটে, কিন্তু দলগত উদ্যোগে সর্বত্র মার খেয়েছে। বাঙালির ক্রীড়া সংস্কৃতি কোনও দিন গড়েই ওঠেনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy