বাঙালি এখনও পঞ্জিকা কেনে, এই কম্পিউটারশাসিত যুগেও হালখাতা করে
শিশুলালবাবু মাঝে মাঝেই বলতেন, ‘‘বোঝলা, অরা বাঙালি রাখব না। সুভাষ বোসরে মারছিল, শ্যামাপ্রসাদরে মারল, অখন সুব্রত মুখার্জিরেও (প্রাক্তন এয়ার মার্শাল) মাইরা ফালাইল। না হে, অরা বাঙালি আর রাখব না।’’
এই ‘অরা’ যে কারা, তা শিশুলালবাবু কখনও ভেঙে বলেননি। তবে তাঁর কথা শুনে বোঝা যেত, কিছু লোক বাঙালি মারার জন্যই আড়ে আড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের স্লোগানই হল, ‘বাঙালি? মার শালাকে!’ কেন তারা বাঙালিকে মারে বা মারতে চায়, তা-ও ছোটখাটো, রোগাভোগা চেহারার শিশুলালবাবু আমাদের বলেননি। তবু দেখতাম, কালীঘাটের সেই স্কুলে আর সব মাস্টারমশাইরা তাঁর কথায় সায় দিয়ে মাথা নাড়তেন। তাঁদের বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল, চার দিকে বাঙালির বিরুদ্ধে একটা গভীর ষড়যন্ত্র চলছে।
বাঙালি মাথাতোলা দিলেই ‘রে রে’ রব উঠছে চার দিকে। ব্যাপারটা যে মোটেই ও রকম নয়, তা তাঁদের বোঝাতে গিয়ে দেখেছি, তাঁরা বিশেষ গেরাহ্যি করতে নারাজ। হাল ছাড়তে হয়েছে।
আরও পড়ুন: বাঙালি হয়ে ওঠার গোড়ার কথা
জব্বলপুরে এক সাহিত্য সম্মেলনে গিয়েছি। আমাকে রাখা হয়েছিল, এক ডাকসাইটে ডাক্তারের পেল্লায় বাড়িতে। খান তিনেক বিশাল বাড়ি, নার্সিংহোম সব এক চৌহদ্দির মধ্যে। তাঁরা চাটুজ্জে, নিকষ্যি বাঙালি। ডাক্তারগিন্নি ছিপছিপে, সুন্দরী এক প্রৌঢ়া। তিনি বিয়ের আগে ‘গাঙ্গুলি’ ছিলেন। কথায় কথায় বললেন, ‘‘আমি ইলাহাবাদের মেয়ে হচ্ছি।’’ তাঁর বাংলাও খানিকটা মেড ইন ইলাহাবাদ। কারণ, তাঁর বর্তনগুলো ‘গিরে যায়’ কিংবা কুকুরগুলো খুব ‘শোর মাচায়’।
আরও পড়ুন: বিবেকানন্দের হিন্দুত্ব না বুঝিয়ে মানুষকে তাঁর কথা সরল ভাবেই বোঝানো যেত
আর এক বার অফিসের কাজে লম্বা টুরে বেরিয়ে বেলগাঁওয়ে এক চেনা ভদ্রলোকের বাড়িতে উঠেছি। তিনি সোৎসাহে আমার সঙ্গে আলাপ করানোর জন্য তাঁর কয়েক জন বাঙালি সহকর্মীকে জোটালেন। তাঁরা আমার সঙ্গে কথা বলার সময়ে প্রাণপাত করে নিজেদের বাঙালি বলে চেনাতে বাংলা বলার চেষ্টা করেছিলেন। সেই চেষ্টা যে ফলবতী হয়নি তা-ও নয়। ভাষাটা বাংলা বলে দিব্যি চেনাও যাচ্ছিল, তবে কলকাতার অবাঙালিরাও অনায়াসে তাঁদের বাংলা শেখাতে পারেন।
পরিসংখ্যান বলছে, সংখ্যার নিরিখে বাংলা হল ভারতের দু’নম্বর ভাষা, হিন্দির পরেই। এটাও ভাববার মতো কথা। হিন্দি তো চার-পাঁচটা রাজ্য জুড়ে বহাল আছে, কিন্তু বাঙালির জন্য বরাদ্দ তো একটি শীর্ণকায়, লম্বাটে ভূখণ্ড মাত্র। এত বাঙালিকে জায়গা দেওয়ার সাধ্য তো তার নেই। তাই প্রবাসযাপন না করে বাঙালির উপায়ই বা কী? আর এই নিয়েই আজ যত বখেড়া। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাঙালিদের আজ প্রবল আত্মপরিচয়ের সঙ্কট। তাঁদের নাগরিকত্বও ঘোর বিপদের মধ্যে। সম্প্রতি হাইলাকান্দিতে গিয়ে দেখেছি, গোটা অঞ্চলেই এক সর্বব্যাপী শোক ছেয়ে আছে। তাঁদের নালিশ, তাঁদের কান্না বা আবেদন-নিবেদন কোথাও পৌঁছচ্ছে না। হাসিখুশি একটি ভূখণ্ড আজ উদ্বিগ্ন, সন্ত্রস্ত, বিষাদমলিন। বাস্তুচ্যুতির ভয় যে কী সাংঘাতিক, তা ভুক্তভোগীরাই জানেন। ভিটেছাড়া হওয়াটা মানুষের দুঃসহতম ট্রাজেডিগুলোর একটি।
এক ডাকসাইটে বুদ্ধিজীবী এক বার বাঙালরাও যে বাঙালি, তা শুনে অবাক হয়ে বলেছিলেন, ‘‘বলো কী! ওরা বাঙালি! তা কী করে হয়? বাঙালি তো শুধু পশ্চিম বাংলার বামুন-কায়েত।’’ অর্থাৎ তাঁর মতে, পশ্চিমবঙ্গবাসী উচ্চবর্ণের হিন্দু ছাড়া আর কেউ বাঙালিই নয়। এই তত্ত্ব মানতে গেলে অধিকাংশ বাঙালিরই বাঙালিত্ব খারিজ হয়ে যায়। দেশভাগের যন্ত্রণা বাঙালিকেই পোহাতে হয়েছে সব চেয়ে বেশি। দেশ ছেড়ে দণ্ডক অরণ্য, আন্দামান, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নানা দুর্গম জায়গায় আশ্রয়ের সন্ধানে যেতে হয়েছে। তাদের আইডেন্টিটি বিপন্ন হয়েছে বারংবার। এক বার অত্যাচারের শিকার হয়ে দণ্ডক থেকে তারা পালিয়ে সুন্দরবনে এসে বসতি গড়তে চেয়েছিল। সেখানেও জুটেছিল লাঠি আর গুলি। মরিচঝাঁপি বাঙালি অস্মিতার এক মস্ত বড় কলঙ্ক।
২০০৪-এর শীতকালে এক বার নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস-এ মাস দু’য়েক থাকতে হয়েছিল। জায়গাটাকে নিউ ইয়র্ক বলে ভাবাই কঠিন। চার দিকে পিলপিল করছে বাঙালি আর বাঙালি। সাহেবদের চিহ্নও নেই। দোকানে দোকানে বাংলা সাইনবোর্ড, রাস্তাঘাটে অবিরল বাংলা এবং বাঙাল ভাষার কথা, বাংলা খবরের কাগজ, বাজারে ইলিশ, শুঁটকি, ঢেঁকিশাকের বাহার। মনে হয়, যেন বাংলাদেশ আমেরিকার একটা অঞ্চল জয় করে নিজের রাজত্ব স্থাপন করে নিয়েছে। দেখে ভারী খুশি হয়েছিলাম। বিদেশে বাঙালির এ হেন দাপট দেখে। তুলনায় ভারতীয় বাঙালিরা আমেরিকায় অনেকটাই জড়সড়।
বাঙালি সারা বছর বাংলা তারিখ মনে রাখে না ঠিকই, তার দরকারও হয় না বলে। কিন্তু পালাপার্বণ থাকলে ঠিক মনে রাখে। এই যেমন পয়লা বৈশাখ। নববর্ষ। এ বাংলা-ও বাংলা জুড়ে ফলাও উৎসব। বাঙালি এখনও পঞ্জিকা কেনে, এই কম্পিউটারশাসিত যুগেও হালখাতা করে, জামাকাপড় কেনে এবং গুরুজনদের প্রণামও করে। বন্ধুবান্ধবদের ‘শুভ নববর্ষ’ জানাতেও ভোলে না। আর এই সব ছোটখাটো লক্ষণ দেখে আজও বাঙালিকে বাঙালি বলে মনে হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy