E-Paper

বহুতলের স্বপ্নময় শহর

বিজ্ঞাপনের ভাষা, দৃশ্য, রং, মেজাজ— সেটাই বিক্রি করে, ক্রেতাদের কাছে যা দুর্লভ অথচ আকাঙ্ক্ষিত। যাতায়াতের পথে, মুঠোফোনে বা সমাজমাধ্যমে সম্পূর্ণ মগ্ন না হয়ে খানিক মুখ তুলে রাস্তার বিজ্ঞাপন দেখলে জানতে পারা যাবে, কী সেই অধরা পণ্যসামগ্রীর প্রলোভনবাণী।

শ্রীদীপ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৭:১৫

উদারীকরণের প্রভাবে, গত সাড়ে তিন দশক ধরে আমাদের শহরের বসতি, যানজট, জনসংখ্যা— বিপুল বেড়েছে। শহর আরও ঘিঞ্জি হয়েছে, বেড়েছে ঠেসাঠেসি। এটার ঘাড়ে সেটা গজিয়ে ওঠা ঘরবাড়ি শহরের বাহ্যিক দৃশ্যসত্তার অঙ্গ হয়ে উঠেছে। জায়গা কম, রাস্তা সরু— সবাই সবার ঘাড়ে শ্বাস ফেলছে যেন। এই ঘনত্বের মধ্যে থেকে মাথা উঁচিয়ে ওঠে বিলবোর্ড। বড় হরফে বিলবোর্ডে লেখা শব্দগুচ্ছ ও ছবির জৌলুস, সঙ্গে বাজারি প্রতিশ্রুতি— আজ শহরের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।

বিজ্ঞাপনের ভাষা, দৃশ্য, রং, মেজাজ— সেটাই বিক্রি করে, ক্রেতাদের কাছে যা দুর্লভ অথচ আকাঙ্ক্ষিত। যাতায়াতের পথে, মুঠোফোনে বা সমাজমাধ্যমে সম্পূর্ণ মগ্ন না হয়ে খানিক মুখ তুলে রাস্তার বিজ্ঞাপন দেখলে জানতে পারা যাবে, কী সেই অধরা পণ্যসামগ্রীর প্রলোভনবাণী। শহর জুড়ে আজ সবচেয়ে দুষ্প্রাপ্য ও দামি অথচ স্বপ্নময় বস্তুটি কী, আপনার-আমার জীবনে? জমি। বাসস্থান। ঠিকানা। নজর করলে দেখা যাবে, শহরের সিংহভাগ বিজ্ঞাপন নাগরিককে সেটাই বিক্রি করতে চাইছে। শহরে জমি আর নেই, থাকলেও তা মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরেই। তবে আছে— বাড়ি ভেঙে, জলা-জমি বুজিয়ে, খেত অধিগ্রহণ করে বহুতল আবাসনের হাতছানি।

সেই রিয়াল এস্টেটের বিজ্ঞাপনী ভাষা ও দৃশ্য, আদৌ কিন্তু আমাদের ঘর বিক্রি করতে উন্মুখ নয়। বাড়িঘর একটা কেজো ব্যাপার— ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ফাংশনাল’। তার জন্য এত টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপনের আয়োজন করতে হয় না— তা এমনিতেই বিক্রি হয়। বিজ্ঞাপন বিক্রি করতে চায় এক কাল্পনিক দৃশ্যকল্প, যার অবস্থান আমার-আপনার আপাত-অগোছালো বাড়ি বা পাড়ার থেকে আরও দূরে ও উপরে। সেখানকার প্রেক্ষাপট ও পরিমণ্ডল পরিচ্ছন্নতার প্রতিশ্রুতিতে ভরা— যা কিনা ‘ঘর’ বা ‘বাড়ি’র চেয়েও দুর্লভ এক নির্মিত ধারণা।

সত্যজিৎ রায়ের সীমাবদ্ধ ছবিতে শ্যামলেন্দুর স্ত্রী, তার ছোট শহর থেকে কলকাতায় ঘুরতে আসা বোনকে ফ্ল্যাট দেখানোর সময় বলেছিল, “ওপরেই ভাল। ধুলো, ধোঁয়া, মশা, মাছি— সবই কম।” অর্থাৎ যানজট, ঘিঞ্জিপনা থেকে তফাতে— মাটি, ঘাম, রক্ত, প্রতিবাদ ও শ্রেণিসংঘর্ষ থেকে দূরত্বের অঙ্গীকার এই বহুতল। উচ্চতা এখানে উত্তোলন ও উন্নতির প্রতীক। তাতে পুরোদস্তুর লেগে আছে নীচের মানুষদের প্রতি তাচ্ছিল্য ও অবমাননা, এবং নিজেকে বা অন্যকে বোঝানো যে আমি জাতে, পদে, ধনে, মানে উৎকৃষ্ট।

তাই অধিকাংশ বহুতলের বিজ্ঞাপনে যা বিক্রি হচ্ছে— অর্থাৎ ঘর ও তার মাপ— সেটা দেখা যায় ছোট হরফে। বড় হরফে আসলে যা দেখানো হয় তা হল উচ্চ শ্রেণি-সচেতনতা। তাই কিছু কিছু বিশেষণের প্রয়োগ ও পুনরাবৃত্তি কাকতালীয় তো নয়ই, বরং অতি আবশ্যক ও অনিবার্য। যেমন: ‘রয়্যাল’ (রাজোচিত), ‘লাক্সারি’ (বিলাস), ‘অ্যাক্টিভিটি সেন্টার’ (আসলে যা প্রমোদস্থান), ‘প্রিস্টিন’ (নির্মল), ‘পিসফুল’ (শান্তিময়), ‘প্রিমিয়াম/এলিট’ (অভিজাত), ‘গ্র্যান্ড’ (বৃহৎ), ‘এগজ়োটিক’ (বিচিত্র)। এই সব শব্দ স্কোয়্যার ফুটের হিসাবে বা ফিতে দিয়ে মাপা যায় না, যাচাই করা যায় না এদের গুণগত মান— কারণ এগুলি বাজারের নির্মিত ধারণামাত্র।

এই কল্পিত ধারণাগুলির অবস্থানের মূলে আছে দূরত্ব। শহরের যা কিছু ক্লেদে ভরা ও বাস্তব, তা থেকে কাল্পনিক উত্তরণ। ঘিঞ্জি জীবন অতিক্রম করে গাছ, গল্ফ কোর্ট, ক্ষুদ্র জলাশয় আঁকা এক আশ্চর্য আনন্দলোক— যার নির্মাণ সবুজ কেটে, জলাজমি বুজিয়ে। বিজ্ঞাপনের ভাষা বা পুঁজিবাদকে বিশেষ প্রয়াস করতে হয় না আমাদের বোঝাতে যে, কংক্রিটের এই ধ্বংসযজ্ঞ খুব পরিবেশ-অনুকূল। প্রকৃতিকে মেরে প্রকৃতি গড়ার এই সৃষ্টি— আসলে আপনাকে দেবে অনেকটা উন্মুক্ত জায়গা ও শূন্য শতাংশ শহর, দেবে শান্ত এক কোণ, এমনও লেখা থাকে বহু বহুতলের বিজ্ঞাপনে।

হীন, মলিন, গ্লানিময় যা কিছু, তার ঊর্ধ্বে এ এক প্রাচুর্যের ঘেরাটোপ, যার উঁচু দেওয়াল বাস্তব শহর থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন রাখবে। আমরা নিরালায় বসে ভাবব, এই ‘মানবাধিকার’ আমাদের অর্জিত; এই ভোগের আয়োজনেই আমাদের সুরক্ষা ও নিজস্বতা। বিদ্যুৎ, জল ও আরও নানা সরবরাহ অনবরত— সবই প্রতিপালনের উচ্চমূল্যে। সুসজ্জিত, নিঃসঙ্গ এই নির্বাণ লাভে আমাদের প্রতিটি শ্বাস দূষণমুক্ত— বাকি শহরের তুলনায়।

শূন্য শতাংশ শহরের আসল তাৎপর্য হল, কুড়ি-ত্রিশ তলার বাসিন্দা মানুষজনের কাছে বাকি শহরটার অস্তিত্বই নেই। বহুতল-কল্পনায়, নীচের শহর নিঃশেষিত, আরামদায়ক উচ্চতায় আছে শুধু দামি নির্জনতা, দৃষ্টি সাঁতার কাটবে শুধু আকাশের মেঘেদের সঙ্গে; শালিক-চড়ুইয়ের ডাকে ভাঙবে ঘুম। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী— আবাসন অল্প, কিন্তু দৃষ্টিপথ অঢেল। আর তা কেনার সামর্থ্য বা বাকি নাগরিকদের প্রতি ঔদাসীন্য না জন্মালে, তাকে জন্মাতে দেওয়াটাই যেন এই সময়ের উচ্চাশা। সম্পদ সঞ্চয় করতেই হবে, তা সে ধারের টাকায় হলেও। নীচ থেকে শহরটাকে তো অনেক দেখা হল, এ বার কেবল উপরে থাকা, উপর থেকে দেখা!

সমাজতত্ত্ব বিভাগ, শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Advertisements Real Estate City

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy