E-Paper

যত দোষ লক্ষ্মীর ভান্ডারের?

লক্ষ্মীর ভান্ডারের দিকে সকলের রোষকষায়িত অভিসম্পাত। রাস্তা সারানো যাচ্ছে না, দোষ কার? অবশ্যই লক্ষ্মীর ভান্ডারের। প্রাপ্য মহার্ঘ ভাতা দেওয়া যাচ্ছে না, দোষ কার? অবশ্যই লক্ষ্মীর ভান্ডারের।

ঈশা দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৭:০৭

সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে পিআরএস লেজিসলেটিভ রিসার্চ রিপোর্ট। ‘মেয়েদের প্রকল্প’-এ কত অর্থ খরচ করা হয়েছে, তার সব তথ্যও সেখানে আছে। রিপোর্ট বলছে, সব দোষ ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’-এর। ভিন্ন নামের কিন্তু এক চরিত্রের অন্য দোষীরাও আছে— ঝাড়খণ্ডে মাইয়া সম্মান, মহারাষ্ট্রে লড়কি বহিন, মধ্যপ্রদেশের লাডলি বেহনা, কর্নাটকের গৃহলক্ষ্মী বা ওড়িশার সুভদ্রা প্রকল্প। প্রতিটিই সরকারি প্রকল্প। সে সব সরকারি প্রকল্পকে আমরা সাধারণ ভাবে অভিযুক্তের তালিকায় ফেলি, যেখানে বড় অঙ্কের অর্থ তছরুপের প্রমাণ আছে। ঐতিহাসিক ভাবে যেমন পশুখাদ্যের অর্থ তছরুপ। লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পটি ২০২১ সালে শুরু হয়, ছোটখাটো নথিভুক্তির ভুলভ্রান্তির অভিযোগ ছাড়া কোনও বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির দায় এখনওঅবধি ওঠেনি।

তবুও লক্ষ্মীর ভান্ডারের দিকে সকলের রোষকষায়িত অভিসম্পাত। রাস্তা সারানো যাচ্ছে না, দোষ কার? অবশ্যই লক্ষ্মীর ভান্ডারের। প্রাপ্য মহার্ঘ ভাতা দেওয়া যাচ্ছে না, দোষ কার? অবশ্যই লক্ষ্মীর ভান্ডারের। মাসে মাসে সরকারের সব টাকা তো লক্ষ্মীর ভান্ডারেই খরচ হয়ে যাচ্ছে। অন্য খাতে আর টাকা মিলবে কী ভাবে?

লক্ষ্মীর ভান্ডারে প্রতি মাসে কত টাকা খরচ হয়? সেই টাকা পাচ্ছেন কারা? রাজ্য সরকারের হিসাব অনুযায়ী, লক্ষ্মীর ভান্ডারের বার্ষিক খরচ ২৬,০০০ কোটি টাকার বেশি। প্রতি মাসে ২.২ কোটি মহিলার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা হয়। এই টাকা জমা হওয়াকে নানান নাম দেওয়া হয়েছে— কেউ বলেছেন ‘ভিক্ষা’, কেউ বলেছেন, সামান্য টাকার বিনিময়ে মেয়েরা বিকিয়ে গিয়েছেন। সরকারের দেওয়া কোন টাকাটা ভিক্ষা, কোনটা অনুদান, কোনটাই বা প্রাপ্য, কোন অর্থ আমাদের সংগঠিত শ্রমের মজুরি— সে খুঁটিনাটি হিসাব অর্থশাস্ত্রীদের কাছে আছে বিলক্ষণ। আপাতত কয়েকটা অন্য প্রশ্ন করি। সংগঠিত শ্রমজীবনের শেষে সরকারি কর্মীরা যে পেনশন পান, সেটা কি ভিক্ষা, না কি অনুদান, না হকের পাওনা? কোনও পরিচিত ছেলেমেয়ে ভাল খেললে আমরা যখন বলি যে, ‘খোঁজ করে দেখো না, সরকারি স্পোর্টস কোটায় কিছু হয় কি না’— সেটা কোন গোত্রে পড়বে? অথবা, শিক্ষা বা চাকরিতে সংরক্ষণ? ব্যাপারটা এমন নয় তো যে, আমরা নিজেদের সব সুযোগসুবিধাকে ‘ন্যায্য’ বলে ভাবি, না পেলে বিক্ষুব্ধ বোধ করি; কিন্তু অন্য কিছু ক্ষেত্রেআমাদের নৈতিকতার বোধ পাল্টে যায়?

এখন মহিলাদের গৃহশ্রমের মজুরির ধারণাটিও আমাদের কাছে তেমন অচেনা নয়। মহিলারা তাঁদের এই নিঃশব্দ অধিকারকে শব্দে পরিণত করতে পারছেন, এটাও কম পাওনা নয়। ২০২৪ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ও মহিলাদের গৃহশ্রমের আর্থিক গুরুত্বকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। গৃহশ্রমের মজুরি কত নির্ধারিত হওয়া প্রয়োজন, এই গৃহশ্রমের মজুরি কোথাও মেয়েদের হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব হয়েছে কি না— এই প্রশ্নগুলি নিয়ে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। এইটুকু বলা যেতে পারে যে, গৃহশ্রমের মজুরি দেওয়া অনর্থক, বাড়ির লোকের জন্য রান্না করার আবার মাইনে— এ ধরনের মত থেকে অন্তত কিছুটা সরে আসা গেছে। কিন্তু লক্ষ্মীর ভান্ডারকে খারাপ বলা যায়, ছোট করা যায়। কেন?

বাড়ির মহিলাকে গৃহশ্রমের মজুরি দেন কে? গৃহকর্তা। তিনি বাড়ির মহিলার হাতখরচ বাবদ একটা অর্থ মঞ্জুর করেন। ঠিক কতটা হাতখরচ পর্যাপ্ত, সেই হাতখরচ নিয়মিত ভাবে কেউ পান কি না, তা নিয়েও তথ্য অবশ্যই সহজলভ্য নয়। তবে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, এখানে গৃহকর্তাটি আক্ষরিক অর্থেই কর্তা— তিনি মহিলাদের হাতখরচ দেওয়ার মহান কর্মটি করেন।

তবু সেই বাড়ির মহিলা লুকিয়ে হলেও লক্ষ্মীর ভান্ডারে নাম নথিভুক্ত করেন কেন? আমার কাছে এসে গোপনে জানতে চান, “তুমি আমার নামটা লক্ষ্মীর ভান্ডারে ঢুকিয়ে দিতে পারো? মানে, অমুকের বাবা শুনলে রাগ করবেন তো।” সরকারি কর্মচারী হয়ে আমি এই কাজ করে দিতে অপারগ, জানার পরে বাড়ির পরিচারিকার সঙ্গে অলিখিত চুক্তি করেন, তাঁর মাধ্যমে কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খোলেন। “হকের টাকা, সরকার দিচ্ছে, কারও কাছে হাত পেতে তো চাইতে হচ্ছে না!” রীতিমতো সম্পন্ন বাড়ির স্ত্রীর যুক্তি। শ্রমের বিনিময়ে প্রাপ্ত মজুরি নয়, তাই এক কথায় একে ভিক্ষা বলেন অনেকেই— এই প্রতিযুক্তি এ ক্ষেত্রে বলা চলে কি?

বাড়ির সহায়িকা নিজের শ্রমের বিনিময়ে মজুরি পান, হাত পেতে চাইতে হয় না। তবে মাইনের দিন তাঁর স্বামী আর কাজে বেরোন না। তাঁর মাসিক বেতনের থেকে মেয়ের স্কুলের মাইনের টাকাটা আমার কাছে গচ্ছিত রেখে যান, ‘না হলে ওটাও যাবে’। তিনি বলেন, “সরকারের টাকা ব্যাঙ্কে পড়বে, পাসবইও তোমার কাছে লুকিয়ে রাখব— এক বছরে অনেক টাকা জমে যাবে না বৌদি?”

“ওই টাকা তোমার সংসারে লাগবে না? তুমি টাকাটা তুলবে না?”

“নামটা দেখোনি বৌদি? লক্ষ্মীর ভাঁড়! ভাঁড়ের টাকা দরকারে ভাঙব।”

এই সঞ্চয়ের নাম কী? অর্থনীতির পাঠ্যবইয়ের যুক্তিতে এর একটা নাম আছে ঠিকই। স্নাতক স্তরের একেবারে গোড়াতেই ক্লাসরুমে যে সব নাম শেখাই, সেখানে নামটা থাকে। উত্তর লিখিয়ে দিই, কেন জিডিপি-র মধ্যে পেনশন বা সরকারের দেওয়া অনুদান ধরা হবে না। কিন্তু বরের হাত থেকে বাঁচিয়ে মেয়ের কলেজে পড়ার জন্য জমানো টাকাকে, সরকারি প্রকল্পকে লক্ষ্মীর ভাঁড় মনে করে খুব কষ্টে জমানো সঞ্চয়কে কী বলে, শেখাতে পারি না।

ঠিক যে ভাবে সরকারের টাকা-আনা-পাইয়ের হিসাবের খুঁটিনাটি আমরা যথার্থভাবে আয়ত্তে আনতে পারি না। আমরা কর দিই, সরকারের করপ্রাপ্ত অর্থের ব্যবহার সম্পর্কে বলার অধিকার আমাদের অবশ্যই আছে। সত্যিই কি আমরা জানি খরচের দু’টি ভাগ ডেভলপমেন্টাল ও নন-ডেভলপমেন্টাল ব্যয়ের কথা? দ্বিতীয় ভাগে পড়া অনুদান, গ্রান্ট ভাতা প্রভৃতি অর্থব্যয়ের তাৎপর্য? সরকারি অপচয়ের বা লিকি বাকেট তত্ত্বের কথা যে ছাত্রছাত্রীদের বলি আমরা, তার সমাধান করতে পারা যায়নি অনেক সময়? তা হলে সব দোষ লক্ষ্মীর ভান্ডার বা মাইয়া সম্মানের হল কী করে?

অনেকে অবশ্য কন্যাশ্রী, বা স্কুলছাত্রীদের সাইকেল প্রদানের দিকেও একই ভাবে অঙ্গুলি নির্দেশ করেন। বলেন, কন্যাশ্রী প্রকল্পের টাকা জমিয়ে মেয়ের বিয়েতে ব্যবহার করেছেন দরিদ্র পিতা, তাই এই প্রকল্প অর্থহীন। সাইকেল পাওয়ামাত্রই বিক্রি করে দেওয়া হয়, পুরনো সাইকেল দেওয়া হয় এ রকম আরও অসংখ্য অভিযোগ কানে আসে। তবে এ ক্ষেত্রেও যাঁরা অভিযোগ করেন, তাঁরা আসলে কখনও সাইকেল পাননি, তাঁদের সন্তান যে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়েছে, তা সরকারি প্রকল্পে তথ্যভুক্তি করায় না।

তা হলে তাঁদের উষ্মার কারণ কী? একটা কারণ কি এই যে, লক্ষ্মীর ভান্ডারে যাঁদের হাতে টাকা যায়, তাঁদের বহু দিনই আমরা অর্থের অধিকার থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছি? তাঁদের লেখাপড়া করতে দিইনি, করলেও চাকরি করতে দিইনি, চাকরি করলেও মাইনের টাকার হিসাব রেখেছি অনবরত? জ্যানাইন রোগান তাঁর দ্য পিঙ্ক ট্যাক্স: ডিসম্যান্টলিং আ ফাইনানশিয়াল সিস্টেম ডিজ়াইনড টু কিপ উইমেন ব্রোক গ্রন্থে দেখিয়েছেন, ঐতিহাসিক ভাবে মেয়েদের শিক্ষা, চাকরি, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের অধিকার, ঋণের সুবিধা থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছে সারা বিশ্বের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ— এখনও করছে। জেন্ডার ওয়েজ পে গ্যাপ, বা পুরুষ ও মহিলা কর্মীদের মধ্যে আয়ের তফাত তার সাক্ষ্য দেয়।

লক্ষ্মীর ভান্ডারের উপরে রাগের কারণ এখানে নয় তো? যখন ‘ভোটের আগে টাকা দেওয়া’র অভিযোগ তোলা হয়, তখন আসলে এটা বলা হয় না তো যে, ভোটের আগে ‘মেয়েদের হাতে’ টাকা? ভোটের আগে টাকা দেওয়ার প্রচলন যতই বেআইনি হোক না কেন, নতুন তো নয়। নতুন বিষয়, এ বার টাকা কে পাচ্ছে, এবং কী ভাবে ব্যাঙ্কের মাধ্যমে সরাসরি পাচ্ছে।

সস্তা জনপ্রিয়তা, ভোটব্যাঙ্ক ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা যেতেই পারে এই প্রসঙ্গে। বলা যেতে পারে এই প্রকল্পগুলির পিছনে রাজকোষের ব্যয়ের কথাও। তবু মহিলা ভোটাররা আর এখন আর ‘মিসিং ভোটার’ নেই, তাঁদের ভোটের জন্য ব্যবহৃত অর্থ হয়ে উঠছে রাজনৈতিক আলোচনার মুখ্য বিষয়। ‘মেয়েদের প্রকল্প’গুলি রাজ্যের, দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে, কম কথা তো নয়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Government Schemes Scheme

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy