শুক্রবার আমেরিকার ওয়াশিংটনের জন এফ কেনেডি সেন্টার ফর পারফর্মিং আর্টসে হয়ে গেল বিশ্বকাপের গ্রুপবিন্যাস। ব্রাজ়িল, আর্জেন্টিনা, পর্তুগাল, ফ্রান্সের মতো দেশ জেনে গেল তাদের প্রতিপক্ষের নাম। তুলনামূলক সহজ গ্রুপে পড়েছে ব্রাজ়িল এবং আর্জেন্টিনা। ফ্রান্স একটু কঠিন গ্রুপে। গ্রুপ পর্বেই দেখা যাবে কিলিয়ান এমবাপে বনাম আর্লিং হালান্ডের লড়াই। পর্তুগালেরও লড়াই তেমন কঠিন নয়।
পরের বছরই প্রথম বার ৪৮টি দেশ নিয়ে বিশ্বকাপ আয়োজন করা হচ্ছে। দেশের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ড্র সহজ হতে পারে, এমন অনুমান আগেই করা হয়েছিল। আদপে হলও তাই। ১২টি গ্রুপের কোনওটিকেই সে ভাবে ‘গ্রুপ অফ ডেথ’ বা মারণগ্রুপ বলা যায় না। তিনটি শক্তিশালী দেশ রয়েছে, এমন গ্রুপ হয়ইনি।
এই অনুষ্ঠানের আগে থেকেই ওয়াশিংটনে তৈরি হয়েছিল আগ্রহ। বিশ্বকাপে খেলতে চলা দেশগুলির সমর্থকেরা হাজির হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, আমেরিকার জাতীয় ফুটবল লিগ এবং বাস্কেটবল লিগের তারকারা এসেছিলেন। ব্রাজিলের কোচ কার্লো আনচেলোত্তি, আমেরিকার কোচ মৌরিসিয়ো পোচেত্তিনো-সহ বিভিন্ন দেশের কোচকে দেখা গিয়েছে।
তবে আগ্রহ ছিল একজনকে নিয়েই। তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফ্যান্টিনোর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বের কথা অজানা নয়। শোনা যাচ্ছিল, এ বার থেকে ফিফা যে শান্তি পুরস্কার চালু করেছে, তার প্রথম প্রাপক ট্রাম্পই। সেটাই হয়েছে। নোবেল শান্তি পুরস্কার না পেলেও ফিফার পুরস্কার পেয়ে গেলেন ট্রাম্প। একটি ভিডিয়োয় তিনি কী ভাবে ভারত-পাকিস্তান, কম্বোডিয়া-তাইল্যান্ড, মিশর-ইথিয়োপিয়া যুদ্ধ থামিয়ে গোটা বিশ্বে শান্তি এনে দিয়েছেন, তা দেখানো হয়। ট্রাম্পের গলায় সোনার পদক পরিয়ে দেন ইনফ্যান্টিনো। বিশ্বকাপের বাকি দুই আয়োজক দেশ মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ক্লদিয়া শিনবাউম এবং কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি ছিলেন।
ফিফা শান্তি পুরস্কারের পদক পরছেন ট্রাম্প (বাঁ দিকে)। পাশে ইনফ্যান্টিনো। ছবি: রয়টার্স।
ইনফ্যান্টিনো জানান, বিশ্বজুড়ে থাকা ফুটবলপ্রেমী মানুষের তরফে এই পুরস্কার ট্রাম্পের হাতে তুলে দেওয়া হল। যদিও ট্রাম্পের জন্যই যে এই পুরস্কারের আয়োজন করা হয়েছে এবং তিনিই যে প্রথম প্রাপক তা আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। পুরস্কার পেয়ে ট্রাম্প বলেন, “আমার জীবনের অন্যতম সেরা সম্মান এটা। তবে পুরস্কারের চেয়েও বড় কথা, আমরা লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচিয়েছি। কিছু কিছু যুদ্ধ শুরু করার আগেই থামেয়ি দেওয়া হয়েছে। আমি আপ্লুত। পরিবার, ফার্স্ট লেডি মেলানিয়াকে ধন্যবাদ। গোটা বিশ্ব দেখেনি, এমন একটা প্রতিযোগিতা পরের বছর আপনারা দেখতে চলেছেন। গোটা বিশ্ব এখন খুব নিরাপদ। এক বছর আগেও আমেরিকা খুব একটা ভাল ছিল না। এখন সকলে এখানেই আসতে চাইছে।”
শুরুতেই গান গেয়ে দর্শকদের মাতিয়ে দেন ইটালির আন্দ্রেয়া বোচেল্লি। এর পর সঞ্চালক হিসাবে প্রকাশ্যে আসেন কমেডিয়ান কেভিন হার্ট এবং মডেল হেইডি ক্লাম। মজার মজার কথা বলে দর্শকদের হাসিয়ে দেন হার্ট। এর পর উদ্বোধনী ভাষণ দেন ইনফ্যান্টিনো। তিনি জানান, এক মাসের মধ্যে ১০৪টি ‘সুপার বোল’ (আমেরিকার ফুটবল লিগের সবচেয়ে জনপ্রিয় ম্যাচ) দেখতে চলেছে আমেরিকা।
বিশ্বকাপ এনে মঞ্চে রাখছেন গত বারের বিজয়ী আর্জেন্টিনা দলের কোচ লিয়োনেল স্কালোনি। ছবি: রয়টার্স।
এর পর প্রকাশ্যে আসে ২০২৬ বিশ্বকাপের থিম সং ‘ডিজ়ায়ার’। সেই গান পরিবেশন করেন ব্রুস স্প্রিংস্টিন এবং নিকোল শারজ়িঙ্গার। এর পর সঞ্চালক কথা বলেন আর্জেন্টিনার কোচ লিয়োনেল স্কালোনি এবং ব্রাজিলের প্রাক্তন বিশ্বকাপজয়ী রবার্তো কার্লোসের সঙ্গে।
ড্রয়ের প্রথম রাউন্ড করার জন্য তিন রাষ্ট্রপ্রধানকে ডেকে নেওয়া হয়। ইনফ্যান্টিনো একে একে ডাকেন কানাডার মার্ক কার্নি, মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ক্লদিয়া শিনবাউম এবং আমেরিকার ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। ট্রাম্প জানান, তিনি পেলের খেলা দেখা বড় হয়েছেন। এমনকি আমেরিকায় ‘ফুটবল’-এর (গোটা বিশ্বে যা ফুটবল নামে পরিচিত, তা আমেরিকায় সকার নামে পরিচিত। কারণ সে দেশে ফুটবল নামে অন্য একটি খেলা রয়েছে) নাম বদলে দেওয়ার সম্ভাবনাও উস্কে দেন।
কানাডা, মেক্সিকো এবং আমেরিকা কে কোন গ্রুপে যাবে তা আগে থেকেই জানা ছিল। উত্তেজনা ছিল ড্রয়ের পরবর্তী রাউন্ড নিয়ে। তবে রাষ্ট্রপ্রধানে সেই রাউন্ডের জন্য থাকেননি। বিদায়ের আগে তাঁদের সঙ্গে নিজস্বী তোলেন ইনফ্যান্টিনো।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই অধৈর্য বাড়ছিল সমর্থকদের মধ্যে। গ্রুপবিন্যাস করতে অকারণে অনেকটা সময় নিচ্ছিল ফিফা। বিশ্বকাপ সরাসরি দেখার জন্য আমেরিকার বিভিন্ন শহরে ফ্যান পার্কের আয়োজন করেছিল ফিফা। ট্রাম্পকে পর্দায় দেখামাত্রই অনেক শহরে সমর্থকেরা বিদ্রূপ করেছেন।
স্ত্রী মেলানিয়ার সঙ্গে ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স।
দেড় ঘণ্টা পর ড্রয়ের জন্য ইংল্যান্ডের প্রাক্তন ফুটবলার রিয়ো ফার্ডিনান্ড এবং সামান্থা জনসন উপস্থাপক হিসাবে মঞ্চে আসেন। প্রাক্তন হকি খেলোয়াড় ওয়েন গ্রেটজ়কি, নিউ ইয়র্ক ইয়াঙ্কিসের অধিনায়ক অ্যারন জাজ, আমেরিকার ফুটবলের তারকা টম ব্র্যাডি, বাস্কেটবলের শাকিল ও’নিলকে ডাকা হয় ড্রয়ের জন্য।
ব্র্যাডি প্রথমেই তোলেন ব্রাজ়িলের নাম। তারা যায় গ্রুপ সি-তে। তার পরেই জার্মানি যায় গ্রুপ ই-তে। একে একে উঠে আসে জার্মানি, আর্জেন্টিনা, পর্তুগালের মতো প্রথম পাত্রে থাকা দেশগুলির নাম। শাকিল দ্বিতীয় পাত্রের দলগুলি বেছে নেন। অ্যারন বেছে নেন তৃতীয় পাত্রের দলগুলি। চতুর্থ পাত্রের দেশগুলি বাছেন ওয়েন।
ব্রাজিলের নাম তুললেন টম ব্র্যাডি। ছবি: রয়টার্স।
পরের বছর ১১ জুন মেক্সিকো বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ দিয়ে শুরু হচ্ছে বিশ্বকাপ। অপর দুই আয়োজক কানাডা এবং আমেরিকা। কানাডা প্রথম ম্যাচ খেলবে উয়েফা প্লে-অফ এ-র বিজয়ী দলের বিরুদ্ধে। আমেরিকার প্রতিপক্ষ প্যারাগুয়ে। এই দু’টি খেলা হবে ১২ জুন। বাকি সূচি শনিবার প্রকাশ্যে আসবে।
ব্রাজিলকে প্রথম ম্যাচ খেলতে হবে মরক্কোর সঙ্গে। তারা ছাড়া বাকি দুই প্রতিপক্ষ সহজ। আর্জেন্টিনা প্রথম ম্যাচ খেলবে আলজেরিয়ার বিপক্ষে।
গ্রুপ এ: মেক্সিকো, দক্ষিণ আফ্রিকা, কোরিয়া প্রজাতন্ত্র, উয়েফা প্লে-অফ ডি বিজয়ী।
গ্রুপ বি: কানাডা, উয়েফা প্লে-অফ এ বিজয়ী, কাতার, সুইৎজ়ারল্যান্ড।
গ্রুপ সি: ব্রাজ়িল, মরক্কো, হাইতি, স্কটল্যান্ড।
গ্রুপ ডি: আমেরিকা, প্যারাগুয়ে, অস্ট্রেলিয়া, উয়েফা প্লে-অফ সি বিজয়ী।
গ্রুপ ই: জার্মানি, কুরাসায়ো, আইভরি কোস্ট, ইকুয়েডর।
গ্রুপ এফ: নেদারল্যান্ডস, জাপান, উয়েফা প্লে-অফ বি বিজয়ী, টিউনিশিয়া।
গ্রুপ জি: বেলজিয়াম, মিশর, ইরান, নিউ জ়িল্যান্ড।
গ্রুপ এইচ: স্পেন, কেপ ভার্দে, সৌদি আরব, উরুগুয়ে।
গ্রুপ আই: ফ্রান্স, সেনেগাল, ফিফা প্লে-অফ ২ বিজয়ী, নরওয়ে।
গ্রুপ জে: আর্জেন্টিনা, আলজেরিয়া, অস্ট্রিয়া, জর্ডান।
গ্রুপ কে: পর্তুগাল, ফিফা প্লে-অফ ১ বিজয়ী, উজ়বেকিস্তান, কলম্বিয়া।
গ্রুপ এল: ইংল্যান্ড, ক্রোয়েশিয়া, ঘানা, পানামা।