Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
রাষ্ট্রীয় বিবাদ ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সম্পর্ক আলাদা পথে চলুক

চিনের থেকে কত কী শেখার

ভারতীয় নাগরিক হয়ে এই সম্মেলনে যোগদান করা একটু জটিল। ভারত ওবোর প্রকল্পে যোগ দেয়নি, কারণ প্রস্তাবিত পথটি পাক-অধিকৃত কাশ্মীর দিয়ে যাবে, এবং দিল্লির মতে তা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ করবে।

স্বপ্ন-বিনিয়োগ: চিন ভ্রমণে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নন্দলাল বসুর চিনা বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয়, ১৯২৪

স্বপ্ন-বিনিয়োগ: চিন ভ্রমণে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নন্দলাল বসুর চিনা বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয়, ১৯২৪

অনিকেত দে
শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:২৩
Share: Save:

দেশের একেবারে মধ্যিখানে শিয়ান শহর। রেশমপথের গোড়ায় অবস্থিত বাণিজ্যকেন্দ্রটি অন্তত তিন হাজার বছর ধরে এশিয়ার সম্রাট, বণিক ও সাধকের মিলনক্ষেত্র। তবে চিনদেশের এই শহরটির বর্তমান গুরুত্ব অন্যত্র। সম্প্রতি চিন গোটা এশিয়ায় ক্ষমতা বিস্তারের লক্ষ্যে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ (ওবোর) প্রকল্প গঠন করেছে। প্রচুর অর্থব্যয়ে প্রাচীন রেশমপথ পুনর্নির্মাণ করে চিন, ইরান, মধ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্য তাঁরা একত্রিত করতে চান। এই প্রকল্প এশিয়ার ছাত্র-গবেষকদের পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত করাবে, বিভিন্ন সাহিত্য-ইতিহাস অনুবাদের সুযোগ সৃষ্টি করবে। প্রাচীন পথটির অভিমুখ শিয়ানকে ঘিরে তাই ওবোর প্রকল্পের বহু স্বপ্ন, বিনিয়োগ। সম্প্রতি এমনই এক গবেষক সম্মেলনের আমন্ত্রণে শিয়ানের বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক দিন কাটিয়ে আসি।

ভারতীয় নাগরিক হয়ে এই সম্মেলনে যোগদান করা একটু জটিল। ভারত ওবোর প্রকল্পে যোগ দেয়নি, কারণ প্রস্তাবিত পথটি পাক-অধিকৃত কাশ্মীর দিয়ে যাবে, এবং দিল্লির মতে তা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ করবে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও এই কারণে দিল্লির থেকে চিন সফরের অনুমতি পাননি, যদিও চিনের পুরনো শত্রু জাপান বা ভিয়েতনাম বৈরিতা সরিয়ে এই মহাযজ্ঞে যোগদান করেছে। তার পর ঘটেছে ডোকলাম। এমন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চিনে যাওয়া নিয়ে মনে বেশ ভয় ছিল: যদি চিনের মানুষ বা পুলিশ ভারতপন্থী কথা শুনে হয়রান করে?

বাস্তব অভিজ্ঞতা কিন্তু অবাক করল। সম্মেলনে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-অধ্যাপক, আঞ্চলিক কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা, শিল্পপতি, বিনিয়োগকারী ও সেনাবাহিনীর কিছু মানুষ। আমার আগে এক চিনা তরুণ রবীন্দ্রনাথের চিনা অনুবাদকের জীবনী বিশ্লেষণ করে বার বার চিন-মানসে রবীন্দ্রনাথের প্রতি গভীর শ্রদ্ধার কথা বলেন। আর এক গবেষক বাঙালির বিস্মৃত নায়ক বিনয়কুমার সরকারের চিনা ও হিন্দুধর্মের আলোচনা স্মরণ করেন। দুই বক্তব্যেই বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি চিনবাসীর গভীর শ্রদ্ধা প্রকট। বুঝতে অসুবিধা হয় না, ভারতচর্চায় চিনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি যথেষ্ট তৈরি। তবে সবচেয়ে চমকে উঠলাম যখন এক সেনা অফিসার আমাকে এসে বললেন যে, রবীন্দ্রনাথ ঠিকই বলেছিলেন, আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ সকলের ক্ষতি করে, আমাদের দুই দেশের উচিত এই সীমিত জাতীয়তাবাদের ওপরে ওঠা। আমার থতমত ভাব দেখে আর এক অফিসার হেসে বললেন, এখনকার চিন অন্য রকম। ‘আমরা সমালোচনা শুনতে আগ্রহী, দরকার শুধু ঠান্ডা মাথায় কথা বলা।’

চিনা বাহিনী রবীন্দ্র রচনাবলি মেনে যুদ্ধ করে না নিশ্চয়ই, তবে তার আধিকারিকরা যখন রাবীন্দ্রিক মানবতাবাদের মূল সুরটি বোঝেন, তখন মনে হয়, আলাপ-আলোচনার সুযোগটা আছে। রাষ্ট্রীয় বিবাদ এবং দুই দেশের বৌদ্ধিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক আদানপ্রদান: দুটি বিষয় আলাদা রাখলে সব পক্ষেরই মঙ্গল। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের বিবাদ অতি প্রাচীন, কিন্তু তার ফলে ফরাসি সংস্কৃতির প্রতি শিক্ষিত ইংরাজের অনুরাগ কোনও দিন কমেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তুঙ্গেও ফ্রান্স ও জার্মানির দার্শনিকরা পরস্পরের থেকে শেখা থামাননি, এবং যুদ্ধোত্তর ইউরোপের একতা সংগঠিত করতে এই সব সম্পর্কের ভূমিকা কম ছিল না। কেবল রাষ্ট্ৰীয় আস্ফালনের জেরে দুই শক্তিশালী দেশের মানুষের আলাপ-আলোচনা বন্ধ করা নির্বুদ্ধিতার পরিচয়।

মহাচিন ও ভারতভূমির প্রাচীন সম্পর্ক বিষয়ে আমরা ছোটবেলা থেকেই যথেষ্ট জানি। পণ্ডিতশ্রেষ্ঠ হিউয়েন সাং নালন্দায় দীর্ঘকাল ভাষাচর্চা করে বৌদ্ধ পুঁথিসম্ভার নিয়ে রেশমপথ ধরে শিয়ান ফেরেন। তাঁর অনুবাদগুলি আজও চিনে পড়া হয়, তাঁর ভারতযাত্রা নিয়ে একটি হাস্যরসাত্মক উপন্যাস আজও চিনা সাহিত্যে অবশ্যপাঠ্য। বৌদ্ধশ্রমণ কুমারজীব ও বোধিধর্ম চিনে বুদ্ধের বাণী প্রচার করেন, আজও হেনান প্রদেশের রহস্যময় শাওলিন গুম্ফায় তাঁরা পূজিত। আর বাঙালি সন্তান অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞানের তিব্বতযাত্রা ও ধর্মপ্রচার তো কিংবদন্তি। হাজার বছর পরেও চিনারা ভারত ও বাংলার সঙ্গে এই সম্বন্ধগুলি ভুলে যাননি, গুরুত্বপূর্ণ সব মন্দিরে এই ইতিহাস খোদাই করা আছে।

তবে চিন-জাপানের সঙ্গে আমাদের চেনাজানা তো কেবল প্রাচীনকালের নয়, আধুনিক কালেও বাঙালি তাদের কত মুখোমুখি হয়েছে। তিব্বতচর্চার পথিকৃৎ শরৎচন্দ্র দাস তিব্বতে গিয়ে বহু তথ্য সংগ্রহ করে ব্রিটিশের সহায়তা করেন। সাহিত্যিক কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বা ইকমিক কুকারের আবিষ্কর্তা ইন্দুমাধব মল্লিক চাকরি ও ভ্রমণসূত্রে চিনের ব্রিটিশ বলয় ভ্রমণ করেন। সরকারপন্থী হলেও এঁদের যোগাযোগ স্বদেশি যুগে নতুন তাৎপর্য পায়। স্বদেশি আন্দোলনের সময়ে বহু ব্রিটিশবিরোধী বাঙালি চিন ও জাপানের থেকে অনুপ্রেরণা নেন। জাপানি শিল্পবিশারদ ওকাকুরার সঙ্গে ভগিনী নিবেদিতা ও ঠাকুর পরিবারের সম্পর্ক সুবিদিত, স্বদেশি চিত্রকলায় ওকাকুরার প্রভাব গভীর। স্বদেশি আদর্শে ব্রতী মন্মথনাথ ঘোষ জাপানে গিয়ে ছাতার বাঁট, কৃত্রিম চামড়া, চিরুনি তৈরির প্রক্রিয়া শেখেন, দেশীয় সেলুলয়েড কারখানা তৈরির লক্ষ্যে জাপান সম্রাটের থেকে ভরতুকিতে কর্পূর কেনার ছাড়পত্র নেন। এই সময় চিন ও জাপান ব্রিটিশ ভারতের শত্রুদেশ ছিল, তা সত্ত্বেও স্বদেশি সমাজ তাদের থেকে নতুন আত্মশক্তি খুঁজে পায়।

ভাষাগত পার্থক্য, ঔপনিবেশিকতার ইতিহাস, ‘৬২ সালের যুদ্ধ ইত্যাদির দরুন আমরা ভুলে গেছি চিন ও ভারতের মানুষের জীবনযাপন ও বাস্তব সমস্যা আদতে কতটা সমান্তরাল। দুই দেশের অধিকাংশ মানুষ ঐতিহাসিক ভাবে কৃষিজীবী ও দরিদ্র। দুই দেশেই এক কালের জমজমাট অর্থনীতি ও সমাজ-জীবন ইউরোপীয় আগ্রাসনের কল্যাণে মলিন হয়, ও দুই দেশের রাজনীতিকরা মোটামুটি একই সময়ে আধুনিক দেশ গঠনে ব্রতী হন। ১৯১৫ সালে চিনের অভ্যন্তরে ভ্রমণ করার সময় যুবক বিনয়কুমার সরকার এই মিলগুলি ধরতে পেরেছিলেন, তাই চিনের সংস্কারপন্থী যুবক নেতৃদ্বয় কাং য়ু-ওয়ে ও লিয়াং চি চাও-কে তাঁর ভ্রমণকাহিনিটি উৎসর্গ করেন। প্রসঙ্গত, লিয়াং-ই পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের চিন সফরের ব্যবস্থা করেন। তবে রবীন্দ্র-সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ থাকা সত্ত্বেও কবির চিন-ভ্রমণ খুব একটা সফল হয়নি, কবির শান্তির বাণীতে তৎকালীন চিনের আধুনিকতা ও উন্নয়নের তৃষ্ণা মেটেনি। পরে বিশ্বভারতীর চিন ভবনের কল্যাণে চিনের সঙ্গে কবির সম্পর্ক দৃঢ়তর হয়। কিন্তু স্বদেশি যুগে চিন-জাপান-মিশর-ভারতে তরুণ এশিয়ার মনের ঠিক সুরটি ধরেছিলেন বিনয়কুমার যাতে ছিল স্বদেশপ্রেম, ঔপনিবেশিক বিরোধিতা ও উন্নয়ন। ভাষা ও রাজনীতির গণ্ডি পেরিয়ে কেবল বৌদ্ধধর্ম নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারও শিখতে চেয়েছিলেন তাঁরা।

এই সব সম্পর্ক রাষ্ট্রক্ষমতার বেঁধে দেওয়া গণ্ডি মেনে চলেনি। ঠিক একই ভাবে আজকে চিনের সঙ্গে আমাদের মেলামেশা দিল্লি-বেজিং-ওয়াশিংটনের দ্বারা নির্ধারিত হতে পারে না। আমরা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যুদ্ধনিনাদে উত্তেজনা অনুভব করি। কিন্তু কূটনৈতিক সার্কাসে দৈনন্দিন জীবনের প্রকৃত উন্নয়ন অধরা রয়ে যায়। আজকে ওবোর-এর মিত্র দেশ বাংলাদেশের অগুনতি ছাত্র বৃত্তিসহ চিনে চমৎকার প্রযুক্তিশিক্ষা পাচ্ছে। আর আমাদের বেকার, শিক্ষাহীন যুবককুল কী পেল? অগণিত চিনা তরুণ ভারতীয় ভাষা শিখছে, ভারতে চিনা ভাষা শেখার আগ্রহ কই? চিন সরকারকে নিষ্পাপ মসিহা ভাবার কোন কারণ নেই, তাদের সাম্রাজ্যবাদী আচরণ সুপরিচিত। কিন্তু শুধু সেই কারণে একটি শক্তিশালী অর্থনীতির সুযোগ না নেওয়া দূরদৃষ্টির অভাব। আমেরিকার শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিও মার্কিন আগ্রাসনের ভাগিদার, কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী চিন তাদের অসংখ্য ছাত্রকে সেখানে পাঠাতে দ্বিধা করেনি।

একশো বছর আগে বিনয় সরকার লেখেন, বাঙালি যদি পুণের মরাঠা এবং মাদুরার তামিলকে নিজের ভাই বলে ডাকতে পারে, তবে উত্তর চিনের জনগণকেও ভাই বলে কেন ডাকতে পারবে না? রাষ্ট্রীয় মতাদর্শ ও শিক্ষিত মানুষের স্বাধীন চিন্তা কখনওই সমান্তরাল নয়, প্রয়োজন কেবল কূটনীতির বাইরে সামাজিক সংযোগের চিন্তাভাবনা শুরু করা।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস ও নৃতত্ত্বের গবেষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE