যোগী আদিত্যনাথ। ফাইল চিত্র।
আঘাতটা এ ভাবেই আসে। দুর্বল স্থানেই চোট লাগে, ক্ষতস্থান থেকেই রক্তপাত ঘটানোর চেষ্টা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিপক্ষ এই কৌশল নেয়। কিন্তু ঘরের ভিতর থেকেও যখন বার বার দুর্বল স্থানটাকেই কেউ না কেউ নিশানা বানাতে থাকেন, তখন পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে ওঠে। দুর্বলতার সম্পূর্ণ নিরাময় ঘটানো ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।
বিজেপি দলিতের বন্ধু নয়, এমন অভিযোগ দলটির বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিনের। কখনও দলিত রাজনীতির ‘মসিহা’ মায়াবতী এই অভিযোগে সরব হয়েছেন। কখনও বিজেপির প্রধান প্রতিপক্ষ কংগ্রেস এই অভিযোগ তুলেছে, কখনও অন্যান্য বিরোধী দল বিজেপি-কে ‘দলিত-বিরোধী’ আখ্যা দিয়েছে।
এই সব আক্রমণের বিরুদ্ধে যুঝেই রাজনীতি করতে হয়েছে বিজেপি-কে। দল যে দলিত-বিরোধী নয়, নানা ভাবে তার প্রমাণ দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়েছে। সে চেষ্টা এখনও নিরন্তর চালাতে হচ্ছে বিজেপি-কে। কিন্তু দলের মধ্যে থেকেই এ বার অভিযোগটা উঠতে শুরু করেছে। প্রথমে উত্তরপ্রদেশের রবার্টসগঞ্জের সাংসদ ছোটেলাল খরবার দাবি করলেন, তিনি দলিত বলে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন।তার পরে দিল্লি থেকে বিজেপি-র টিকিটে নির্বাচিত সাংসদ উদিত রাজ মুখ খুললেন। বিজেপি জমানায় দলিতের উপর নির্যাতন বাড়ছে— এমন ইঙ্গিত করলেন।
আরও পড়ুন: যোগীর বাড়ির সামনে আত্মহত্যার চেষ্টা ‘ধর্ষিতা’র
ছোটেলাল খরবার বা উদিত রাজ দলের কোনও অভ্যন্তরীণ রসায়নের কথা মাথায় রেখে এই ধরনের মন্তব্য করলেন কি না, সে প্রশ্ন থাকতেই পারে। দলে নিজেদের অবস্থান মজবুত করার জন্য তাঁরা ‘দলিত তাস’ খেললেন কি না, সে নিয়ে তর্ক থাকতে পারে। কিন্তু বিজেপি যে দলিতের পাশে থাকার প্রশ্নে খুব মজবুত অবস্থানে নেই, দলিত প্রশ্নে যে দল দুর্বল অবস্থানেই রয়েছে, ছোটেলাল-উদিতদের খোঁচায় সে কথা আরও স্পষ্ট ভাবে প্রমাণিত হয়ে গেল। দলিতের উন্নয়ন বা দলিতের অধিকার রক্ষার প্রশ্নে দলকে খোঁচা দেওয়া হলে নেতৃত্বের অস্বস্তিটা সবচেয়ে বেশি দ্রুত বাড়বে— দলের সাংসদেরাও যে সে কথা ভাল ভাবেই জানেন, তা পরিষ্কার হয়ে গেল।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
বিজেপির রাজত্বে দলিত নির্যাতনের একের পর এক ঘটনা সামনে এসেছে, সে কথা কিন্তু অস্বীকার করা কঠিন। হায়দরাবাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে রোহিত ভেমুলা কাণ্ড হোক বা গুজরাতের উনায় দলিত নির্যাতন— বিজেপি গত কয়েক বছরে দলিত বিরোধিতায় অভিযুক্ত হয়েছে বার বার। দেশের এবং অধিকাংশ অঙ্গরাজ্যের শাসন ক্ষমতায় এই মুহূর্তে আসীন যে দলটি, সেই দলটির বিরুদ্ধে দলিতদের সংঘবদ্ধ অসন্তোষ গত কয়েক বছরে একাধিকবার বিপুল আকার নিয়ে আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছে। নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের নিজের রাজ্যেই সংঘবদ্ধ দলিত অসন্তোষের অত্যন্ত বড় সাক্ষী। দলিত অসন্তোষে ভর করেই গুজরাতের রাজনীতি কাঁপিয়ে দিয়েছেন জিগ্নেশ মেবাণী নামে এক যুবক। কয়েক বছর আগেও সে ভাবে খ্যাতনামা ছিলেন না যে জিগ্নেশ, তিনি আজ জাতীয় রাজনীতিতেও প্রাসঙ্গিক। দলিত অসন্তোষ কতটা ভয়ঙ্কর চেহারা নিতে পারে, তা সম্প্রতি একাধিক দলিত সংগঠনের ডাকা ‘ভারত বন্ধের’ দিনে দেখা গিয়েছে।
অতএব দলিতদের মধ্যে ক্ষোভ যে পুঞ্জীভূত হচ্ছে, বিজেপির হাতে দলিতের স্বার্থ নিরাপদ নয় বলে দলিত সমাজের একটা বিরাট অংশই যে মনে করছে, তা নিয়ে সংশয় নেই। এটা বিজেপি নেতৃত্বের ব্যর্থতা। বিজেপি পরিচালিত সরকারেরও ব্যর্থতা।
বিজেপি এবং তার সরকার দলিতের পরম বন্ধু, এমন বার্তা সম্প্রতি দেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছে। অম্বেডকরের নামে জয়ধ্বনি বার বার শোনা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ, যোগী আদিত্যনাথের কথা-বার্তায়। তফসিলি জাতি উপজাতির উপর নির্যাতন প্রতিরোধ করার জন্য যে আইন রয়েছে, তার প্রয়োগের উপরে সুপ্রিম কোর্ট বিধিনিষেধ জারি করতেই বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার কালক্ষেপ না করে ফের মামলা দায়ের করেছে। সুপ্রিম কোর্টকে তার রায় পুনর্বিবেচনা করতে আর্জি জানিয়েছে। কিন্তু সে সবের পরেও বলা যাচ্ছে না যে, বিজেপি দলিতের পূর্ণ আস্থা অর্জন করে ফেলেছে। বিজেপি নেতৃত্বও সে কথা ভাল ভাবেই জানেন।
২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন ক্রমশ কাছে আসছে। দলিতের অসন্তোষ যদি কমানো না যায়, নিপীড়নের ক্ষতস্থানে যদি প্রলেপ না দেওয়া যায়। তা হলে বিপর্যয় অপেক্ষায় থাকতে পারে। ঘরে-বাইরে আজ দলিত-খোঁচার মুখে বিজেপি। এই দুর্বলতা রাতারাতি কাটিয়ে ফেলা যাবে, এমন কোনও ‘মন্ত্র’, কারও কাছেই নেই। কিন্তু এ দুর্বলতা দ্রুত কাটিয়ে দলিতের আস্থাভাজন হয়ে ওঠা ছাড়া অন্য কোনও পথও বিজেপির সামনে খোলা নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy