Advertisement
E-Paper

পশ্চিম বর্ধমানের বৌদ্ধ প্রত্নস্থল

বৌদ্ধধর্মের মহাযান শাখা থেকে কালচক্রযান, সহজযানের মতো শাখাগুলি বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রসারলাভ করেছিল। তার সাক্ষ্য বহন করে ‘চর্যাপদ’-এর মতো সাহিত্য নিদর্শন এবং বাংলার বৌদ্ধস্তূপগুলির ধ্বংসাবশেষ। যেমন, পশ্চিম বর্ধমানের ভরতপুরে বৌদ্ধস্তূপটি।তাঁর বর্ণিত এই ‘অনুকূল জীবন ধর্মে রূপান্তরণ’-এর মধ্যে দিয়েই বাঙালি আত্মস্থ করেছিল বৌদ্ধধর্মকে।

শ্রাবণী দত্ত

শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০১৯ ০২:১৩
ভরতপুরের স্তূপ। —নিজস্ব চিত্র।

ভরতপুরের স্তূপ। —নিজস্ব চিত্র।

কিন্তু তার গৌরব গর্বের বিষয়ও বড় কম নেই। সে তর্ক করে, যুক্তি মানে কিন্তু হৃদয় বেদ্য না হলে জীবনে আচরণ করে না। তাই সে বৌদ্ধ, ব্রাহ্মণ্য ও ইসলাম ধর্ম মুখে যতটা গ্রহণ করেছে অন্তরে ততটা মানেনি। সে তার জীবন ও জীবিকার অনুকূল করে রূপান্তরিত করেছে ধর্মকে।’’ তাঁর ‘বাঙলা, বাঙালি ও বাঙালিত্ব’ বইয়ে বাঙালির ধর্ম আত্মীকরণ প্রসঙ্গে এমন মন্তব্যই করেছিলেন প্রাবন্ধিক আহমদ শরীফ। তাঁর বর্ণিত এই ‘অনুকূল জীবন ধর্মে রূপান্তরণ’-এর মধ্যে দিয়েই বাঙালি আত্মস্থ করেছিল বৌদ্ধধর্মকে।

বাঙালির নিজস্ব জীবন ইতিহাস আলোচনা করে নীহাররঞ্জন রায় বা আহমদ শরীফের মতো ইতিহাসবিদেরা মনে করেছেন আজ থেকে তিন চার হাজার বছর আগেও বাংলাদেশে একটি সমৃদ্ধ সভ্যতা ছিল। তবে তাদের সঙ্গে বহির্ভারতের যোগাযোগ কতটা ছিল তা নিয়ে প্রশ্ন থাকে। তাঁরা মনে করেন, বৌদ্ধধর্মই প্রথম বাঙালিকে বহির্বঙ্গের সঙ্গে পরিচিত করে তোলে। বৌদ্ধধর্ম ঠিক কোন সময় এ দেশে প্রবেশ করেছিল তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। তবে সে সব সময়কালের বিতর্ককে পাশ কাটিয়ে বলা চলে, সম্রাট অশোকের সময় থেকে পালযুগ পর্যন্ত বৌদ্ধধর্মের একটা স্রোত বাংলায় ছিল। বৌদ্ধধর্মের মহাযান শাখা থেকে কালচক্রযান, সহজযানের মতো যে শাখাগুলি বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রসারলাভ করেছিল তার সাক্ষ্য বহন করে ‘চর্যাপদ’-এর মতো নানা সাহিত্য নিদর্শন এবং বাংলার বৌদ্ধস্তূপগুলির ধ্বংসাবশেষ। তেমনই একটি বৌদ্ধস্তূপের নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায় পশ্চিম বর্ধমানের ভরতপুরে।

ভরতপুর গ্রামটি পানাগড় রেলস্টেশনের দক্ষিণ দিকে চার মাইল দূরে দামোদর নদের কাছে অবস্থিত। নীহাররঞ্জন রায় বা আহমদ শরীফের মতো ইতিহাসবিদেরা মনে করেন, বৌদ্ধধর্ম প্রবেশের আগেও বাংলায় যে সভ্যতা প্রচলিত ছিল তার কেন্দ্রভূমি ছিল রাঢ় বাংলায়। এখানকার পাণ্ডুরাজার ঢিবি, বীরভানপুর, তুলসীপুর, সাঁওতালডাঙা, মঙ্গলকোট, শ্রীপুর এবং ভরতপুর থেকে উদ্ধার হওয়া নানা প্রত্নসম্ভার সেই মতকেই মান্যতা দেয়। পরে বৌদ্ধধর্মের প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে তা এখানকার মানুষের জীবনাচরণের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।

ভরতপুরে আবিষ্কৃত হওয়া বৌদ্ধস্তূপটিই এখনও পর্যন্ত রাঢ় অঞ্চলে একমাত্র আবিষ্কৃত বৌদ্ধস্তূপ। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত পুথিতে ‘তুলাক্ষেত্র বর্ধমান স্তূপ’ নামে এই স্তূপের উল্লেখ পাওয়া যায়। ধ্বংসপ্রাপ্ত এই স্তূপের মধ্যে ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় বজ্রাসনে উপবিষ্ট সর্বসাকুল্যে এগারোটি বুদ্ধমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে।

ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের পূর্বাঞ্চলীয় শাখা এবং বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে বুদবুদ থানার এই গ্রামে ১৯৭১ সালে স্বল্প পরিসরে খননকার্য পরিচালিত হয়েছিল। সেই প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পুরাতত্ত্ব বিভাগের সহ-অধিকর্তা সুশান্ত মুখোপাধ্যায়। হঠাৎ তাঁর মৃত্যুর ফলে এই উৎখনন মাঝপথে গতি হারায়। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত বিভাগীয় মুখপত্রে এ সম্পর্কে যে রচনা প্রকাশিত হয়েছে তা থেকে জানা যায়, স্তূপের নিম্নভাগে ‘তাম্রাশ্মীয়’ সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে এবং এই সভ্যতা ও সংস্কৃতির নিদর্শনগুলি খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের কাছাকাছি সময়ের বলে প্রমাণিত হয়েছে। ভরতপুরের ঢিবিতে উৎখননের ফলে যে সভ্যতা আবিষ্কৃত হয়েছে তা পাণ্ডুরাজার ঢিবির সমপর্যায়ভুক্ত হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। ভরতপুরে খননের ফলে যে চারটি স্তরে প্রাচীন সভ্যতার চিহ্ণ অবিষ্কৃত হয়েছে তা থেকে ওই সময়কার অধিবাসীদের জীবনচর্চা সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া যায়।

চারটি স্তরে খননকার্যের ফলে চতুর্থ বা সর্বশেষ স্তরে ঐতিহাসিক যুগের পুরাবস্তুগুলির সন্ধান পাওয়া যায়। এই স্তরে পঞ্চরথাকৃতি একটি বৌদ্ধস্তূপের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে যা অনেকে অষ্টম নবম শতাব্দীতে নির্মিত বলে মনে করেন। স্তূপের ভিত্তি দেখে অনুমান করা চলে এটি ইটের তৈরি।

উল্লেখ্য প্রত্নক্ষেত্রটি ভরতপুর ও মণিরামপুর মৌজায় অবস্থিত হলেও স্তূপটি ‘ভরতপুরের স্তূপ’ নামেই বেশি পরিচিত। স্তূপটির আয়তন ১২.৭৫ মিটার x ১২.৭৫ মিটার। বর্গাকার আয়তনের ইট নির্মিত স্তূপটির চতুর্দিকে রয়েছে কারুকার্য। এবং বৃহদাকার কুলুঙ্গিতে ছিল ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় পদ্মাসনে উপবিষ্ট বুদ্ধমূর্তি যা বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রহশালায় স্থান পেয়েছে। ইতিহাসবিদেরা মনে করেন, এই স্তূপটি সম্ভবত কোনও বৌদ্ধবিহারের সংলগ্ন ছিল।

স্তূপটির দক্ষিণ পশ্চিম কোণে ১০ মিটার x ১০ মিটার পরিসরে খাত খনন করে দেখা গিয়েছে যে বর্গাকার স্তূপের নিম্নমুখী ধাপগুলি পোড়া ইটের তৈরি হলেও তা আসলে রোদে শুকানো। সর্বনিম্ন অংশে স্বাভাবিক মৃত্তিকাস্তরের উপর হলুদ আভা যুক্ত চুনাপাথর ও পাথরের গুটি বিছিয়ে দিয়ে তার উপরে কাঁচা ইটের ভিত্তি নির্মাণ করা হয়েছিল। ভিতের উপরে আগুনে পোড়া ইটের দ্বারা স্তূপটির গঠনকার্য সমাধা করা হয়। গাঁথনির জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল বালি ও চুনের সমাহার। আয়তন অনুসারে ইটগুলিকে দু’টি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায় — এক) ৩০x ২৮ x ৭ সেন্টিমিটার আয়তন বিশিষ্ট এবং ৪৮ x ২১ x ৬ সেন্টিমিটার আয়তন বিশিষ্ট। দু’রকম ইটের ব্যবহার থেকে অনুমান করা চলে যে কোনও প্রাচীন সৌধ থেকে সংগৃহীত হয়ে ইট এই সৌধ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছিল। স্তূপের উপরে অংশ যথাক্রমে পাঁচটি পর্যায়ে বিভক্ত হয়েছে বলে এটিকে ‘পঞ্চরথাকৃতি স্থাপত্য’ বলা হয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞেরা অনুমান করেন যে, এই স্তূপটির স্থাপত্য কৌশল ওডিশার রত্নগিরি স্তূপের অনুরূপ। ১৯৫৮ সালের আইন অনুসারে এই পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনটি প্রাচীন স্মারক তথা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থল রূপে ঘোষণা করা হয়েছে এবং যাতে কোনও ভাবে ক্ষতি করা না হয় সে সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই স্তূপকে ঘিরে একটি ভ্রমণকেন্দ্র তৈরির বিষয়ে এখনও পর্যন্ত কোনও উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ করা হয়নি। ফলে ভরতপুর গুরুত্বপূর্ণ হয়েও একটি অবহেলিত গ্রাম হিসেবেই এক পাশে পড়ে রয়েছে।

তথ্যসূত্র: বর্ধমান: ইতিহাস ও সংস্কৃতি, যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী

Buddhism
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy