Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Coronavirus

অশিক্ষিত

সমাজমাধ্যমে প্রচারিত কোনও বার্তাকে নিজ স্বার্থসিদ্ধি বা অন্য কুপ্রণোদনায় বিকৃত করা দণ্ডনীয় অপরাধ।

শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০২০ ০১:০২
Share: Save:

মানুষই মানুষের পাশে দাঁড়ায়, সাক্ষ্য দিবে যে কোনও সঙ্কটকাল। এই সময় দেখিতেছে, শুধু কোভিড-১৯’এ আক্রান্ত রোগীই নহে, শুশ্রূষাপ্রার্থী হইয়া প্রতীক্ষারত অগণিত মানুষ— কেহ দরিদ্র, নিরন্ন, কেহ বা কর্মহীন, বা বার্ধক্যপীড়িত। বিশেষত মহানগর বা মফস্‌সলের ঘরে ঘরে খুঁজিলে পাওয়া যাইবে সেই সব অসুস্থ বৃদ্ধবৃদ্ধাদের, নিয়মিত ঔষধের জোগান ভিন্ন যাঁহাদের বাঁচা দুষ্কর। লকডাউন চলাকালীন তাঁহাদের অনেকেই দোকানে ঔষধ কিনিতে যাইতে পারিতেছেন না, হয়তো ঘরে এমন কেহ নাই যে আনিয়া দিবে। তাঁহাদেরই সাহায্যে আগাইয়া আসিয়াছিলেন শহরের কয়েক জন তরুণ। সমাজমাধ্যমে নিজেদের যোগাযোগের নম্বর জানাইয়া বার্তা দিয়াছিলেন, যোগাযোগ করিলে তাঁহারাই ঔষধ গৃহে পৌঁছাইয়া দিবেন। সেই বার্তা বিকৃত হইয়া ছড়াইয়া গেল, পর্যবসিত হইল ঘরে ঘরে মদ্য পৌঁছাইয়া দেওয়ার প্রলোভনে। স্বেচ্ছাসেবকগণ আদেশ-নির্দেশের বন্যায় অতিষ্ঠ হইয়া উঠিলেন, ফলস্বরূপ পুরা পরিষেবাটিই বন্ধ করিতে বাধ্য হইলেন।

সমাজমাধ্যমে প্রচারিত কোনও বার্তাকে নিজ স্বার্থসিদ্ধি বা অন্য কুপ্রণোদনায় বিকৃত করা দণ্ডনীয় অপরাধ। অভিযোগ দায়ের হইয়াছে, অপরাধী শাস্তিও পাইবে বলিয়া আশা করা যায়। কিন্তু ঘটনা-অঘটনের পারে যে বৃহত্তর সম্ভাবনার দ্বার, তাহা তো রুদ্ধ হইয়া গেল। যে সেবা ও শুভের অঙ্গীকার লইয়া স্বেচ্ছাসেবীগণ পথে নামিয়াছিলেন, কতিপয় নাগরিকের অসভ্যতায় তাহা রক্ষিত হইল না। যে মানুষগুলির সত্যই ঔষধ প্রয়োজন ছিল, তাঁহারা আর এই পরিষেবা পাইবেন না। তিনশত মানুষ এই পরিষেবায় উপকৃত হইয়াছিলেন, তাহা তিন সহস্র হইতে পারিত। সংখ্যা বড় কথা নহে, এই আপৎকালে এহেন শুভবোধসম্পন্ন ও সক্রিয় উদ্যোগ উদাহরণযোগ্য হইয়া চারিপার্শ্বে ছড়াইয়া পড়িতে পারিত। সেই সম্ভাবনাও বিনষ্ট হইল। অশক্ত রোগী, সেবাব্রতী যুবক বা উৎকট পরিহাসপ্রিয় নাগরিক— লাভ কাহার হইল? এই কাণ্ডজ্ঞানহীনতার দায় লইবার কেহ নাই, কারণ সঙ্কটকালে আর্তের পাশে দাঁড়াইবার বিরল শিক্ষা অপেক্ষা একটি শুভ কার্যকে দায়িত্ব লইয়া পণ্ড করিবার অশিক্ষা বাঙালি সবিশেষ অর্জন করিয়াছে। তার ব্যবসা করিবার বিষয়বুদ্ধি নাই কিন্তু শিক্ষার বল আছে, সেবার তন্নিষ্ঠতা আছে, ভারত এমনই জানিত। কিন্তু সেই শিক্ষাও যে তাহার জীবন হইতে মুছিয়া গিয়াছে, ঘর ও বাহিরকে নির্লজ্জ ভাবে তাহা জানাইতে সে বদ্ধপরিকর। এমনকি এই অতিমারি-লাঞ্ছিত সময়েও।

সেবাব্রতী, মানবদরদি বিদ্যাসাগর সম্পর্কে লিখিতে গিয়া রবীন্দ্রনাথ বাঙালি জাতিচরিত্রের সমালোচনা করিয়া বলিয়াছিলেন, এই জাতি দুর্বল, ক্ষুদ্র, হৃদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক, তার্কিক। বলিয়াছিলেন, বাঙালির বুদ্ধি অতিসূক্ষ্ম তর্কের বাহাদুরিতে ভাল ছুটে, কিন্তু কর্মের পথে চলে না। মনীষীবাক্য এই কালেও যে কী নিদারুণ সত্য, আরও এক বার প্রমাণিত হইল। একুশ শতকের বঙ্গে দিগদর্শকের সংখ্যা কমিয়াছে। যদি বা সাধারণ্যে কেহ কেহ সীমিত বলবুদ্ধি দ্বারা দুর্যোগকালে পীড়িতের সহায় হইয়া দাঁড়াইতেছিলেন, কর্মহীন লঘুচিত্ত অন্যেরা সেই সুকৃতিকে টানিয়া ধূলায় মিশাইতেছেন। এই মজ্জাগত অসভ্যতা মুছিয়া দিবার ক্ষমতা অতিমারিরও আছে কি না সন্দেহ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Health
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE