জানুয়ারির শেষ তারিখে ভিয়েতনামের হ্যানয় পৌঁছোই। ঠিক এক সপ্তাহ আগেই সে-দেশে কোভিড-১৯’এর প্রথম দু’জন রোগী শনাক্ত হন। মাত্র তেরোশো কিলোমিটার দূরে চিনের উহানে তত দিনে আক্রান্তের সংখ্যা সাত হাজার ছাড়িয়েছে, মৃত ১৭০। রওনা দিয়েছিলাম কিছুটা আশঙ্কা নিয়েই। পাঁচ দিন ধরে হ্যানয় ঘুরে বেড়ালাম, নানা মিউজ়িয়ম, পার্ক, এমনকি জলে পুতুল-নাটক পর্যন্ত দেখা হল— অবাধে। শহর নয়, পরিচ্ছন্নতার চলন্ত নমুনা। প্রতিটি মানুষ যেন পরিচ্ছন্নতার বোধ তুলে ধরতে ব্যগ্র। ইতিমধ্যে, ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ভিয়েতনামে কোভিড ১৯-এ আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১০। সেই রাতে আমাদের ঘরের বেল বাজল। এক জন লোক হাতে একটা লিফলেট ধরিয়ে অনেক ক্ষণ বক্তৃতা করলেন, শুধু ‘করোনাভাইরাস’ ছাড়া কিছুই বুঝলাম না। ব্যাপার কী? ভিয়েতনাম ছেড়ে চলে যেতে বলছে? লিফলেট তিয়েং ভিয়েত— ভিয়েতনামি— ভাষায়, কিন্তু হরফটা রোমান-ভিত্তিক। গুগলের সাহায্য নিয়ে যেটুকু বুঝলাম, নোভেল করোনাভাইরাসের আক্রমণ ঠেকানোর জন্য কী কী করণীয়, সে বিষয়ে বলা আছে তাতে। বুঝলাম, যিনি লিফলেট দিয়ে গেলেন, তাঁর বক্তৃতার বিষয়বস্তুও তা-ই ছিল। ভিয়েতনামের লোকসংখ্যা কম না, দশ কোটির কাছাকাছি। প্রতি বাড়িতে গিয়ে এ ভাবে প্রচার চালানো সহজ নয়। কিন্তু করোনা প্রতিরোধে ভিয়েতনাম স্বাস্থ্য দফতর যা যা কাজ করেছিল, তার মধ্যে শুধু বিজ্ঞাপন নয়, সরাসরি মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করাটা ছিল অন্যতম।
পর দিন, ৬ মার্চ যাওয়ার ছিল ক্যাট-বা, সেখান থেকে হলং বে। বাস ছাড়ল। একরের পর একর সদ্য পোঁতা ধানচারা, কলার খেত, পথে আশ্চর্য পরিচ্ছন্ন শৌচাগার, খাবারের দোকান। সে-সব ছাড়িয়ে বাস পৌঁছল বেন ফা গট জাহাজঘাটায়, ফেরি করে আবার বাসে উঠতে হবে। বিপত্তি ওখানেই। বেশ খানিক ক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখে কন্ডাক্টর জানালেন, কর্তৃপক্ষের নির্দেশ, ছাব্বিশটি দেশের নাগরিককে ক্যাট-বা যেতে দেওয়া হবে না। এই দেশগুলোয় করোনা-আক্রান্ত মানুষের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। এক জন ছাড়া বাকি সবাইকে ফিরিয়ে দিল পুলিশ— তিনি ডেনমার্কের বাসিন্দা, তখনও তাঁর দেশ করোনা-তালিকায় আসেনি। পুলিশ আমাদের ফিরিয়ে দিল বটে, কিন্তু আচরণ খুবই ভদ্র, রাগ করা গেল না।
ফেরার টিকিট দু’দিন পর। ঠিক করা গেল, হ্যানয়ের আরও কিছু মিউজ়িয়ম, ইউনিভার্সিটি, এই সব দেখব। হা হতোস্মি! মিউজ়িয়ম, ইউনিভার্সিটি, বন্ধ। দোকান-বাজার অবশ্য খোলা। জানতে পারলাম, কয়েকটা দিনের মধ্যেই ভিয়েতনাম স্বাস্থ্য দফতর করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধপ্রস্তুতি সেরে নিয়েছে। এমনিতে ভিয়েতনামে প্রতিটি মানুষের জন্য মানবিক মানসম্পন্ন পরিচর্যামূলক চিকিৎসার সুব্যবস্থা আছে, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাও খুব উন্নত। তাই রোগ প্রতিরোধ, রোগ হলে মৃত্যুও আটকানো সহজ হয়। এই লেখার সময় (৬ এপ্রিল) অবধি দশ কোটি জনসংখ্যার দেশে কোভিড-১৯’এর আক্রমণে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। আক্রান্তের সংখ্যা আড়াইশোর কম।