Advertisement
E-Paper

খেলা নহে, যুদ্ধ

ভারত পূর্বেও বিশ্বকাপে খেলিয়াছে, ফাইনালে উঠিয়াছে, জিতিয়াছে, আবার হারিয়াছেও। সমর্থকরা জয়ে আপ্লুত হইয়াছেন, পরাজয়ে ভগ্নহৃদয়। কিন্তু, সেই পরাজয় কখনও দেশ বা জাতি হিসাবে ভারতের পরাজয় বলিয়া গণ্য হয় নাই, জাতিগত ব্যর্থতার পরিচায়ক হইয়া উঠে নাই।

শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৯ ০০:৫৩
ছবি রয়টার্স।

ছবি রয়টার্স।

ভালবাসা ও যুদ্ধে সকল পন্থাই বৈধ, এমন কথা চালু রহিয়াছে। ভারতীয়রা ভাল বুঝিবেন, কারণ ক্রিকেট তাঁহাদের নিকট বরাবরই ভালবাসার ছিল, এখন যুদ্ধও হইয়া দাঁড়াইয়াছে। পন্থা অবশ্য তাঁহাদের একটিই, জাতীয়তাবাদ। বিশ্বকাপের আসর হইতে ভারত বিদায় লইল, প্রেমাস্পদ সৈনিকটি যেন যুদ্ধে পরাস্ত হইয়া সমরাঙ্গন ত্যাগ করিল। কোটি কোটি মানুষের দেশপ্রেমের আঁতে বর্ণনাতীত ঘা লাগিল। খেলায় জয়-পরাজয় থাকিবেই, এই সহজ সত্য অন্তত এই বার তাঁহারা একেবারেই বোঝেন নাই, বলা চলিবে না। খেলায় হার যদি বা মানিয়াছেন, দেশের হার তাঁহাদের নিকট অসহ্য। সমাজমাধ্যমে যে প্রতিক্রিয়া দৃশ্যমান, আপাত ভাবে তাহা ক্রিকেট দল, দলনেতা ও প্রশিক্ষকের প্রতি উদ্দিষ্ট হইলেও, ঘনঘোর আবেগের কচুরিপানা সরাইয়া দেখিলে আহত রক্তাক্ত জাতীয়তাবাদের আস্ফালন চোখ এড়াইবে না। তাহার অন্তর্গত মনোভাবটি এই রূপ: ভারত নামের জাতি কখনও হারিতে পারে?

ভারত পূর্বেও বিশ্বকাপে খেলিয়াছে, ফাইনালে উঠিয়াছে, জিতিয়াছে, আবার হারিয়াছেও। সমর্থকরা জয়ে আপ্লুত হইয়াছেন, পরাজয়ে ভগ্নহৃদয়। কিন্তু, সেই পরাজয় কখনও দেশ বা জাতি হিসাবে ভারতের পরাজয় বলিয়া গণ্য হয় নাই, জাতিগত ব্যর্থতার পরিচায়ক হইয়া উঠে নাই। এই দফায় তবে জাতীয়তাবাদের এমন রমরমা কেন? কেন্দ্রের শাসকদের বদান্যতায়, বলিলে অত্যুক্তি হইবে না। বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারাইবার পরে অমিত শাহ টুইট করিয়াছিলেন, পাকিস্তানের উপরে আর এক বার সফল ‘স্ট্রাইক’-এর জন্য ভারতীয় দলকে অভিনন্দন। ইঙ্গিত সার্জিকাল স্ট্রাইকের দিকে, বুঝিতে বিন্দুমাত্র বেগ পাইতে হয় না। পুলওয়ামা হামলা ও তৎপরবর্তী ঘটনাক্রম জাতীয়তাবাদের অগ্নিতে ঘৃতাহুতির কাজ করিয়াছে। লোকসভা নির্বাচনের পূর্বে এই হাওয়ায় ক্রমাগত ইন্ধন দিয়া কেন্দ্রের শাসক দল লাভের গুড়টি হস্তগত করিয়াছে। ক্রিকেটের ময়দানও এই অতিজাতীয়তাবাদী গর্বকে টানিয়াছে চুম্বকের ন্যায়। পুলওয়ামা-কাণ্ডের পরে ভারতীয় ক্রিকেটারদের সেনা-টুপি পরিয়া প্র্যাকটিসে বিতর্ক হইয়াছিল। বিশ্বকাপেও একটি ম্যাচে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির দস্তানায় শোভা পাইল সেনার চিহ্ন। দূরদর্শনের পর্দা ভাসিয়া গেল একের পর এক বিজ্ঞাপনে, প্রতিটিরই উপজীব্য— প্রতিবেশী দেশকে নস্যাৎ করিয়া কলার তুলিতেছেন উপরচালাক ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমী। সমস্ত কিছুকে ছাপাইয়া গিয়াছে সমাজমাধ্যমের রঙ্গ-পরিহাস, ভারত-সমর্থন সেখানে অনিবার্য ও অবাধ কদর্যতায় পর্যবসিত।

বিজেপি-শাসনে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদ বহু কাল যাবৎ সমার্থক, কিন্তু সাম্প্রতিক কালে তাহা গিয়া ঠেকিয়াছে সামরিক অস্মিতায়। দেশরক্ষা সেনাবাহিনীর নূতন কর্তব্য নহে, কিন্তু শাসক দল কর্তৃক জনমানসে সামরিক অস্তিত্বটি ঠুসিয়া দিবার প্রবণতাটি নূতন। এই প্রবণতা জনজীবনের প্রতিটি ভাবনা, প্রতিটি কার্যকে সামরিক তৌলে মাপিতে চায়। ক্রিকেটের মঞ্চে খেলোয়াড়দের কৃতিত্ব বা অসাফল্যও ব্যতিক্রম নহে। পাকিস্তানের সহিত খেলা তাই ভারতীয়দের কাছে আর একটি কার্গিল বা বালাকোট হইয়া দাঁড়ায়, সেমিফাইনালে স্বপ্নভঙ্গ যেন সামরিক ব্যর্থতারই নামান্তর। এই মুহূর্তে স্কোরবোর্ড বলিতেছে, ক্রিকেট কট অ্যান্ড বোল্ড সামরিক জাতীয়তাবাদ।

ICC Cricket India BJP Nationalism
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy