Advertisement
০১ মে ২০২৪
প্রয়াণদিনে শক্তি চট্টোপাধ্যায়: জীবন-মৃত্যুর আশ্চর্য গতায়াত
Shakti Chattopadhyay

পদ্যের অনায়াস প্রভু

জন্ম থেকেই সেই একলা বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো বালকটি কখনও হাত ছাড়েনি শহর-কাঁপানো পদ্যের প্রভু শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের।

কবি: শক্তি চট্টোপাধ্যায়, গণেশ পাইনের আঁকা ছবিতে।

কবি: শক্তি চট্টোপাধ্যায়, গণেশ পাইনের আঁকা ছবিতে।

অগ্নি রায়
শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০২৪ ০৭:৫১
Share: Save:

কলকাতাকে সে গন্ধে চিনেছিল। দাদুর হাত ধরে লক্ষ্মীকান্তপুরের গাড়ি যখন ইস্টিশানে ঢুকেছে, নানা অবর্ণনীয় গন্ধে সে চিনেছিল শহরকে। যে পাঁকগন্ধের সঙ্গে আজন্ম পরিচয়, পুকুরপাড়ের গেঁড়ি-গুগলির, শুকনো খড়ের বিশ্বজাঙ্গালের কচুরিপানার, তার থেকে বহু দূরের এই বালিগঞ্জের চামড়ার গন্ধ, পেট্রল আর ঘোড়ার গুয়ের গন্ধ যেন নাকে থেকে যেত বালকের। গাছের শিকড়েবাকড়ে জড়িয়ে থাকা ছেলেটা শহরে এসেই চাইত ট্রামগাড়ি চড়তে। কিন্তু দাদু সে সব পছন্দ করতেন না মোটেই। ইস্টিশান থেকে বেরিয়েই ঘোড়ার গাড়ির দরদাম। হাতের লাঠি দিয়ে জানলা দুটো খুলে দিয়ে বেশ জুত করে বসে বলতেন, “দু’দিক দেখতে দেখতে চল, কত তাগড়াই ইমারত দেখতে পাবি। আমাদের মতো পুকুর বাগান পাবি না, শুধ গলি আর তাবড় তাবড় বাড়ি।” হাঁ করে দেখতে দেখতে পেট্রলের গন্ধে মাঝে মাঝেই ওয়াক দিয়ে উঠত ছেলেটা।

চার বছরে পিতৃহীন, মা সুদূর বাগবাজারে, ছেলেটি দাদামশাই আর এক অকালে স্বামী-হারানো মাসির ভূতের মতো বড় একটা গ্রামের বাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছে একলা। দু’পাশে উধাও মাঠ আর বাগান। পিছনে খিড়কির পুকুরের পাড় উপচে পড়েছে সুপুরি, নারকেলের বাগান। এই বাড়ির উপর দিয়ে নাকি দু’শো বছর আগে বয়ে যেত গঙ্গা, দাদুর কাছে রাতে গল্প শোনে সে। দিনে দাদুর কড়া নির্দেশে সংস্কৃত পড়া, গীতার শ্লোক পড়ে শোনানো। কাছের বাদামগাছ পেরিয়েই ইস্টিশান। হৈদরদা দেখাশোনা করে সারা দিন, কিন্তু নিশুত রাতে খুব ভয় লাগে ওর ভূতপ্রেতের। তবে দিনে অকুতোভয়। ছিপে গুবরেপোকার টোপ দিয়ে জিয়ল মাছ ধরে বাগান থেকে ধানের বাদায়, নালিঘাসের ফোকরে। পুকুরে শাল, শোল, ল্যাটা। সে চমকে যায় ডোমরেল মাছ দেখে, কেমন চোখ বড় বড় করে তার পুকুর চষে বেড়ায়।

চোদ্দো বছর বয়সে বাগবাজারের ইস্কুলে ভর্তির পর কলকাতায় স্থায়ী হয়ে মামাবাড়ির নেড়া ছাদের মতোই নিরাপত্তাহীন জীবনের কার্নিসে দাঁড়িয়ে গোটা আকাশটা এক দিন দেখতে পেল বালক। দেখল, বাড়ির চূড়াগুলো ভাসছে অন্য রকম এক রোদ্দুরে। অনেক অনেক পরে সে কুয়োতলায় লিখবে নিরুপমের জবানিতে এই দেখার কথা, লিখবে “গম্বুজের মাথা থেকে কালো ধোঁয়া বের হয়ে আকাশের মেঘের ভিতরে যাচ্ছে মিশে, একটা উঁচু জায়গা থেকে অবিরাম গাড়ি ঘোড়া টলে পড়ছে জলপ্রপাতের মতো।”

জন্ম থেকেই সেই একলা বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো বালকটি কখনও হাত ছাড়েনি শহর-কাঁপানো পদ্যের প্রভু শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের। বরং, “সবার বয়েস বাড়ে আমার বালক বয়েস বাড়ে না কেন”-র এই মধুর হাহাকার শুনে মনে হয়, শক্তি কখনও ছন্দোবদ্ধ অথবা বেপথু পদচারণাতেও ভুলেও হাত ছাড়তে চাননি সেই বিস্ময়বালকটির। অথচ সেই শুকিয়ে যাওয়া ভাগীরথীর মজা মাটির উপর বসবাস করে জয়নগর-মজিলপুরের গ্রাম বহড়ুতে বড় হয়ে শিয়ালদহ স্টেশনে আসা কিশোরটি আরও বড় হয়েছে, এক সময় যার দাদুও থাকবে না আর, মাসিও না, ‘লুকিয়ে লুকিয়ে কী ভাবে বড় হয়ে যেতে হয়’ সে শিখে নেবে।

সেই সময়খণ্ড, যখন করাল আয়নায় মুখ ভ্যাংচাচ্ছে সমাজ, রাজনীতি, মন্বন্তর, সাম্প্রদায়িক আগুন। সেই সময়পর্ব, যখন পৃথিবীব্যাপী মহাসমর, ভারতের আকাশে নেমে এসেছে মহামন্বন্তরের ছায়া। স্বাধীনতার লড়াইয়ে সরাসরি সংযুক্ত হয়ে গিয়েছে যুবসমাজের একটা বড় অংশ। সাতচল্লিশে শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাঁর রূপকথার গ্রাম বহড়ুকে চিরবিদায় জানিয়ে কলকাতায় আসেন, বলা ভাল আসতে কিছুটা বাধ্য হন কলকাতার স্বাধীনতা-পূর্ব দাঙ্গার কারণেই মূলত। দাঙ্গা-কবলিত এলাকায় থাকা তাঁর এক মাসি তাঁর মেয়েদের নিয়ে বহড়ু ফেরায় দাদুর বাড়িতে স্থানের অসঙ্কুলান। বড়বাজারে চোদ্দো বছর বয়সে ক্লাস এইটে মহারাজা কাশিমবাজার পলিটেকনিক স্কুলে ভর্তি হওয়া, যেখানে তাঁর তুতো ভাইবোনেরা আগে থেকেই পড়তেন। কলকাতায় এসে তিনি নিজেকে বদলে নেবেন তিন বছরের মধ্যে, অর্ন্তমুখী পাড়াগাঁয়ের স্বল্পবাক ছেলেটি মামাবাড়ির সব ভাইবোনের সর্দার হয়ে উঠবেন অচিরেই, তাঁর স্বভাবের ইন্দ্রজালে। কিন্তু সেই নির্জন ঘাটের রানার কাছে ঝুঁকে থাকা স্থলপদ্মটি রয়েই যাবে তাঁর ভিতরে। নির্জনসজনে সেই চিরসখাকে তিনি ছাড়তে চাইবেন না আর, নিজের পদ্যগন্থাবলিতে বার বার ফিরে ফিরে দেখা যাবে তার মুখ। তাকে কখনও মহিমান্বিত করবেন না, তৈরি করবেন না তাকে ঘিরে কোনও অতিগৌরবগাথা, বরং রেখে দেবেন সংসারে সন্ন্যাসী করে। একটি সাদামাটা জীবন, আড়ালে থাকা অন্যমনস্ক মন ছায়া ফেলে যাবে তাঁর রেখে যাওয়া বিপুল কাব্যকৃতিতে। যিনি নিজেই বলবেন, “ছোটবেলার ঐ ইস্টিশান, দোলমঞ্চ, গাঁযের চাষাভুষোর সঙ্গে গাছপালা পানাপুকুর— পরিপ্রেক্ষিতশুদ্ধু এক পাড়া গাঁ আমার মধ্যে চেপে বসেছে। তার থেকে পরিত্রাণ কখনো পাই নি।”

দাদুর কাছে গল্প শুনে, সংস্কৃত শিখে আর তাঁর হোমিয়োপ্যাথি চেম্বারের শিশির ভিতর জল পুরে পেঁপেপাতা দিয়ে পরিষ্কার করতে করতে তৈরি যে রহস্যবোধ, তাঁকে ছেড়ে যাবে না তা-ও। আর তাই ১৯৫৬-র খাদ্য সঙ্কট, দুর্ভিক্ষ, দু’-দু’টি সীমান্তযুদ্ধ, ফ্রান্স, আমেরিকা, তৎকালীন চেকোস্লোভাকিয়ায় ছড়িয়ে পড়া আন্দোলন, ভিয়েতনামের যুদ্ধ, কেনেডির হত্যার মধ্যেই বাংলা কবিতায় আমেরিকার কবি অ্যালেন গিনসবার্গের আবির্ভাবের মধ্যে, কৃত্তিবাসের বন্ধুদের সঙ্গে মধ্যরাত শাসন করতে করতেও স্বেচ্ছাচারের মর্মে ভোমরার মতো বেঁচে থাকবে এক মায়ারহস্যের কৌটো, যা সঙ্গে নিয়ে অজ পাড়াগাঁ থেকে পঞ্চাশের বিক্ষুব্ধ পটভূমির শহরে পা দিয়েছিলেন তিনি। তৈরি করবেন লিরিকের অনাবিষ্কৃত এক ভুবন। ওই বদলের সময়েও শক্তির কবিতা পড়তে পড়তে শেলির সেই প্রাচীন উক্তি মনে পড়বে গবেষক, সমালোচকদের। সেটি হল, কবি হচ্ছেন সেই এয়োলিয়ান হার্প, গ্রিক দেশের তারে বাঁধা সেই বাদ্যযন্ত্র, যার মধ্যে হাওয়া যাতায়াত করলে সুর নির্গত হয়।

প্রশ্ন উঠতে পারে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এক সার্বিক নরকস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে কোথায় সুর আর লিরিকের ব্যঞ্জনা? আনখশির শক্তি-পাঠে আমরা যারা বড় হয়েছি, আমরা যারা টের পেয়েছি নিজের ভিতরে ‘মর্মছেঁড়া গাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে’, আমরা যারা ‘লাটাই-ঘুড়ির যোগাযোগকারী সুতোও ছিঁড়েছি/ জীবনে অসংখ্যবার’, আমরা যারা জানি, ‘প্রেম কিছু দেয়, কিন্তু প্রেমের হীনতা দেয় খুব/ বিরহ, গোপন মেঘ, হিংস্র থাবা জিহ্বা যন্ত্রণা’, তারা এত দিনে বুঝে গিয়েছি, শরীরময় সমসময়ের জটিল ব্যাধি নিয়েও কবি খুঁজে নিচ্ছেন রেলপথ, শুঁড়িপথ, মোরাম, জলে গলে যাওয়ার পাতাপুতোর পথ। জীবন-মৃত্যুর মধ্যে অনায়াস যাতায়াতের আশ্চর্য সংযোগের কম্বিনেশন।

তাঁর অগ্রজ অন্য সময়ের কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সংবর্ত কাব্যগ্রন্থের ভূমিকাংশে সাহিত্যের আদ্যকৃত্য হিসাবে উচ্ছ্বাস সংবরণের কথা বলেছিলেন। শক্তি তা পারেননি এবং চাননি। তিনি ক্ষণে ক্ষণে উচ্ছ্বসিত হয়েছেন। আর ঈশ্বরের মতো ক্ষমতায় উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বুনেছেন রহস্যকে। যা তাঁকে টেনেছে ভিতরের বেদনার দিকে। কিশোর-দুঃখে নিজেকে সাজিয়ে তুলেছেন, “এখন ওকে মনে পড়ায় কলসের জল আপনি গড়ায়/ বুকের ভিতর যে-পথগুলি চেতন-রুক্ষ/ লাগুক তাতে বৃষ্টি-ভরা কিশোর দুঃখ।” এ ভাবেই তাঁর অন্তঃস্রোতের আলোড়নকে খোঁজা, একের পর এক কাব্যগ্রন্থে। শুধু কলরবে নয়, উচ্ছৃঙ্খলতায় নয়, তাঁকে ঘিরে গজিয়ে ওঠা অনেকানেক অতিকথায় নয়, এই কবিকে হয়তো খুঁজে পাওয়া যেতেও পারে বহুদূরে এক চির-অন্বেষণরত বালক নাবিকের বেশে। যিনি ছদ্ম অভিমানে বলে ওঠেন, “ছেলেবেলার শব্দ, তুমি আমার দিকে তাকালে না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Shakti Chattopadhyay Bengali Poet Death Anniversary
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE