Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
ব্যক্তিমানুষের সপ্রশ্ন সংশয় পর্দায় ফুটিয়ে তোলেন মৃণাল সেন
Mrinal Sen

ভাঙা জীবনের চিত্রকর

উজ্জ্বল স্মৃতির সঙ্গেই আবার অনভিপ্রেত স্মৃতিও আছে মৃণালবাবুর, তাঁদের বাড়িতে ব্রিটিশ পুলিশের ঘন ঘন তল্লাশি চালানোর স্মৃতি।

A glimpse of a film named Padatik

টানাপড়েন: পদাতিক ছবিতে ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায় ও সিমি গারেওয়াল। ছবি সৌজন্য: কুণাল সেন।

শিলাদিত্য সেন
শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০২৩ ০৪:৩২
Share: Save:

ফরিদপুরে মৃণাল সেনের জন্ম যে বছর, সেই ১৯২৩-এ, রায়ত সম্মেলনের বক্তৃতায় তাঁর বাবা ১৯১৭-র বলশেভিক বিপ্লবের কথা সশ্রদ্ধ উল্লেখ করেছিলেন। বড় হয়ে জানতে পারার পর সে প্রসঙ্গ আজীবন ভোলেননি মৃণালবাবু, বিভিন্ন অনুষঙ্গে ফিরিয়ে আনতেন। তাঁর বাবা ছিলেন উকিল, চরমপন্থী কংগ্রেসিদের অন্যতম বিপিনচন্দ্র পালের যে গোষ্ঠী, তাঁদের ঘনিষ্ঠ। বিপ্লবীদের ফাঁসির হুকুম হলে বাবা তাঁদের হয়ে মামলা লড়তেন, সকলকে না পারলেও কাউকে কাউকে ফাঁসির দড়ি থেকে বাঁচাতে পেরেছিলেন। ফরিদপুরে তখন ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন জোরদার। এক বার গান্ধীজি বিলেত থেকে বৈঠক সেরে দেশে ফিরতেই গ্রেফতার হলেন, প্রতিবাদে হরতাল হল সারা দেশ জুড়ে। মৃণালবাবুর বাবা আদালতে তো গেলেনই না, জেলাশাসক কৈফিয়ত চাইলে স্পষ্ট বলে দিলেন যে, গান্ধীজির গ্রেফতারের প্রতিবাদে তাঁর এই বয়কট। সে জন্য শাস্তিও পেতে হল তাঁকে। এ সবই দেখতে দেখতে বড় হয়েছেন মৃণাল সেন। দেখেছেন, নেতাজি সুভাষচন্দ্র আর বিপিনচন্দ্র পালের কী রকম স্নেহধন্য ছিলেন তাঁর মা, ব্রিটিশ-বিরোধী জনসভায় উদ্বোধনী গান গাইতেন, মায়ের গলায় রবীন্দ্রনাথের ‘অয়ি ভুবনমনোমোহিনী’ চিরদিন কানে বাজত তাঁর।

এমন উজ্জ্বল স্মৃতির সঙ্গেই আবার অনভিপ্রেত স্মৃতিও আছে মৃণালবাবুর, তাঁদের বাড়িতে ব্রিটিশ পুলিশের ঘন ঘন তল্লাশি চালানোর স্মৃতি। বলেছেন, “তখন দেখেছি কত অসংখ্য লোক আসতেন আমাদের বাড়িতে। আসতেন সে সব লোক যাঁরা সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, যাঁদের পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছে। যাঁদের পুলিশ খুঁজছে, তাঁরা নতুন নতুন আশ্রয় খুঁজছেন।” মৃণালবাবুর কথার সূত্রে ধৃতিমান মানে সুমিতের কথা মনে পড়ে যায় না? নকশাল আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী, পুলিশের খপ্পর থেকে পালিয়ে, তারই রাজনৈতিক দলের বন্দোবস্তে আশ্রয় নেয় সিমি অর্থাৎ শীলার ফ্ল্যাটে। মৃণাল সেনের পরাধীন ভারতের স্মৃতিই তাঁর ছবির বিষয় হয়ে ফিরে আসে স্বাধীনতার পঁচিশ বছর পর।

পদাতিক। মৃণাল সেনের ছবিটা (১৯৭৩) পঞ্চাশ বছরের পুরনো, অথচ আজ মৃণালবাবুর জন্মশতবর্ষের শুরুতে সে-ছবির কথাই সবচেয়ে মনে পড়ছে বেশি। শীলা বাঙালি নয়, তার আদি নিবাস পঞ্জাব, কিন্তু সে বরাবরই এখানে, কলকাতায়। পৈতৃক প্রাচুর্যের থেকে আড়াল করে রাখে নিজেকে, কাজের মধ্যে আনন্দ খুঁজে নেয়, কিন্তু কাজের জগতের মদ্যপায়ী হুল্লোড়ে মাতে না, স্বামীর প্রভুত্ব মানে না, একা থাকে। সুমিতকে দেখে শীলার নিজের ভাইয়ের কথা মনে পড়ে, একমাত্র ভাই, সেও জড়িয়ে পড়েছিল নকশাল আন্দোলনে, বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি ছেড়ে চলে যায় পঞ্জাবের রোপারে, সেখানেও তখন কলকাতার মতোই নকশাল আন্দোলন তুঙ্গে, সেখান থেকেই সে দিদিকে শেষ চিঠিতে লিখেছিল, সে একা নয়, তার সঙ্গে যারা লড়াই করছে, তারা লড়াই করছে ‘দেশের না-খেতে-পাওয়া, আধপেটা-খাওয়া মানুষগুলোর জন্য’।

এখন ফিরে তাকালে মনে হয়, অর্ধশতক আগেই মৃণালবাবু তাঁর এই ছবির ভিতর দিয়ে আমাদের, আরও স্পষ্ট করে বললে ‘প্রগতিশীল’দের সমষ্টিগত ভাবনার মধ্যে এমন কিছু বিপজ্জনক প্রবণতা চিহ্নিত করেছিলেন, যা আজও রীতিমতো প্রাসঙ্গিক। তাঁর সাতাশটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবির মধ্যে পদাতিক এমন এক ছবি, যেখানে তাঁর সেই সংশয়ী সপ্রশ্ন নিভৃত ব্যক্তিমনকে ছুঁতে পারা যায়, যা সঙ্গী করে আজীবন চলেছিলেন তিনি। তখন তাঁকে, ওই সত্তর দশকে, রাজনৈতিক চলচ্চিত্রকার হিসাবে ক্রমাগত দেগে দেওয়া হত, আর বামপন্থীরা তাঁর ছবিগুলি নিয়ে তুমুল কাটাছেঁড়া করতেন, তা সে সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বামপন্থীই হোন, বা বিপ্লবে বিশ্বাসী।

আসলে রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের সংজ্ঞা সম্পর্কেও আমাদের একপেশেমি অপরিসীম। মৃণাল সেনের ছবিতে বরাবরই ধরা পড়ত দুঃসহ দারিদ্র আর ভয়ঙ্কর শোষণ, পুলিশ-প্রশাসন-সরকারের সশস্ত্র সন্ত্রাস। গণতন্ত্রের বকলমে রাষ্ট্র বা আইন-আদালতের শাসন নিয়ে প্রায়ই প্রশ্ন তুলতেন তিনি, তাঁর সেই সময়কার প্রায় প্রতিটি ছবিতেই। পাশাপাশি আবার নকশাল আন্দোলন থেকে জরুরি অবস্থা অবধি বামপন্থী আন্দোলনের শক্তি ও দুর্বলতার ইতিহাসও ধরা পড়ত তাঁর এই সব ছবিতে। আমরা প্রথম পর্বটি নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভুগতাম, পরের পর্বটিতে অসন্তুষ্ট হতাম। ভুলে যেতাম যে, দুই-ই রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের অঙ্গ। ফলে তর্কাতর্কি সত্ত্বেও ইন্টারভিউ (১৯৭০) বা কলকাতা ৭১ (১৯৭২) মেনে নিতে আমাদের অসুবিধা হয়নি, কিন্তু পদাতিক আমরা মেনে নিতে পারিনি।

বামপন্থী রাজনৈতিক সংগঠনকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন যে মৃণালবাবু! ছেলেটি, সুমিত প্রশ্ন তুলেছিল নিজের অবস্থান সম্পর্কে: “পালিয়েছিলাম, ধরা পড়লাম, আবার পালালাম। তার পর?” নেতৃত্বের নির্দেশ, তাকে এখন পালিয়েই থাকতে হবে— এ ধরনের লুকানো জীবনের চেয়ে দলের একটার পর একটা ভুল, ভুলের পুনরাবৃত্তি সম্পর্কে সংশয়ী হয়ে ওঠে ছেলেটি। আন্দোলনের বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে, নেতৃত্বের ‘অথরিটারিয়ানিজ়ম’ সম্পর্কে পুনর্মূল্যায়নে প্রবৃত্ত হয়। অথচ দারিদ্রের ইতিহাসকে পাল্টাতেই সত্তরের উত্তাল আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল সে। আর তার ওই দল বা গোষ্ঠী তাকে তো খারিজ করেই দেয়, এমনকি তার সঙ্গে শীলার সংসর্গের অভিযোগও আনে।

ছবিটি মুক্তির পরে নানা ধরনের ধমকানি শুনতে হয়েছিল মৃণাল সেনকে। কেউ বলেছিলেন, এটা ছবি নয়, পুলিশ রিপোর্ট। মৃণালবাবুর সোজাসাপটা উত্তর: “কোনটা স্ল্যান্ডার, কোনটা সেল্ফ-ক্রিটিসিজ়ম— সে দিক থেকে আমি যথেষ্ট সতর্ক ছিলাম। সেল্ফ-ক্রিটিসিজ়ম করলে কেউ সহ্য করতে পারে না। অথচ পার্টিতে বার বার বলা হয়— সেল্ফ-ক্রিটিসিজ়ম করো।” শুধু বামপন্থী নয়, যে কোনও সৎ রাজনৈতিক সংগঠনের আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে, ঝালিয়ে নেওয়ার কাজে সব সময়ই আত্মসমালোচনা প্রয়োজন, প্রতি পদে প্রশ্ন তোলা প্রয়োজন, মৃণালবাবু ঠিক সে চেষ্টাটাই করেছিলেন পদাতিক ছবিতে।

এক দিকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আর অন্য দিকে বামপন্থী রাজনীতির কর্তৃত্ববাদী সন্ত্রাস— এই দুইয়ের মাঝে একা হয়ে যাওয়া সুমিতের পাশে-দাঁড়ানো ও ক্রমশ বন্ধু হয়ে ওঠা শীলা চরিত্রটির সূত্রে মৃণালবাবু বলেছিলেন, “কলকাতার মতো একটা মেট্রোপলিটান শহরে একজন বাঙালির সঙ্গে অবাঙালির পরিচয়, সম্পর্ক... এত স্বাভাবিক, এত চালু, অথচ ছবি করতে গিয়ে আমরা এ ব্যাপারটা ভুলে যাই।... পৃথিবীটা কত ছোট হয়ে আসছে, এতটুকু একটা সংসারের মতো হয়ে আসছে, সেখানে আমরা এত সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়ব কেন?” সমস্ত রকম সেকটারিয়ানিজ়ম, বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে বানিয়ে ছিলেন ছবিটা, বার বার বলেছিলেন তিনি। শুধু দলীয় সঙ্কীর্ণতা নয়, “পিতৃতন্ত্রের বাঁধন থেকে মুক্তির প্রকল্প বাদ দিয়ে যে বিপ্লব সাধন সম্ভব নয় সেই কথাটা বলেছিল এই ছবি। মনে রাখতে হবে আমাদের দেশে নারীবাদ তখনও আন্দোলন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেনি,” খেয়াল করিয়ে দিয়েছেন মৈনাক বিশ্বাস তাঁর একটি লেখায় (মৃণাল সেন বিশেষ সংখ্যা, চিত্রভাষ পত্রিকা)।

ভুলটা আমাদেরই। প্রথম থেকেই আমরা মৃণাল সেনকে সমবেত লড়াইয়ের শরিক হিসাবেই শুধু দেখতে চেয়েছি, সহনাগরিক কিংবা ব্যক্তি মানুষ হিসাবে দেখতে চাইনি। আমাদের অভ্যাসই হল সমষ্টিতে লগ্ন হতে চাওয়া। পঁচাত্তর-পেরোনো স্বাধীনতার জন্মলগ্ন থেকেই তো সমষ্টির অন্তর্ভুক্ত পরিচয়টাকে একমাত্র আত্মপরিচয় ঠাওরেছি আমরা। স্বাধীনতার জন্য সমষ্টির জাগরণ এতটাই বড় হয়ে উঠেছিল যে, ব্যক্তি হয়ে-ওঠার চেষ্টা সে ভাবে করিনি কখনও আমরা। তাই মৃণাল সেনকে বোঝার নাগরিক-মনটাই নেই আমাদের।

স্বাধীনতার পর পাঁচ দশকের পরিক্রমায় তাঁর ফিল্মগুলি পর পর পড়ে গেলে বোঝা যায়, ব্যক্তি মানুষের কোন বিপন্নতা থেকে তিনি নিরন্তর বিচ্ছিন্নতা ও খণ্ডতার এক অস্বাভাবিক অসঙ্গত জগতের আবহাওয়া বুনে চলেন তাঁর ছবিতে। দুর্লঙ্ঘ্য বৈষম্যের তাড়নায় মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক সেখানে হঠাৎ ঘূর্ণিতে ঢুকে পড়ে, স্বাধীন দেশের মানুষজনও যেন ব্রিটিশ উপনিবেশের নিয়মে বাঁধা। মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত উচ্চবিত্ত হতদরিদ্র সব সম্প্রদায়ই চাপা পড়ে আছে এক নিশ্ছিদ্র শাসনব্যবস্থার আইনশৃঙ্খলায়, যেখানে মানবিক সম্পর্কগুলি যুক্তিহীন, আর মূল্যবোধ সংহতিহীন। বিশেষত মধ্যবিত্ত জীবনের আপাত-মসৃণতা মুছে স্বপ্নভঙ্গ তিক্ততা আর কর্কশ অনুভূতিরা যখন বেআব্রু হতে শুরু করে তাঁর ছবিতে, তখন ভাঙা জীবনের চিত্রকর হয়ে ওঠেন তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

mrinal sen Bengali Film Director
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE