Advertisement
০৫ মে ২০২৪
বিরোধী জোটে আসন সমঝোতা দরকার, কিন্তু তার গুরুত্ব কতটা
Opposition Alliance

আসল লড়াইটা যেখানে

বিরোধীদের জন্য চিন্তার কারণ হল, ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচন, তার পরে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনেও কংগ্রেস বিজেপির সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ে শোচনীয় ফল করেছে।

অবতীর্ণ: ইন্ডিয়া জোট মঞ্চে রাহুল গান্ধী, পিছনে সীতারাম ইয়েচুরি, মল্লিকার্জুন খড়্গে, শরদ পওয়ার প্রমুখ, দিল্লি, ২২ ডিসেম্বর। পিটিআই।

অবতীর্ণ: ইন্ডিয়া জোট মঞ্চে রাহুল গান্ধী, পিছনে সীতারাম ইয়েচুরি, মল্লিকার্জুন খড়্গে, শরদ পওয়ার প্রমুখ, দিল্লি, ২২ ডিসেম্বর। পিটিআই।

প্রেমাংশু চৌধুরী
শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:৫৬
Share: Save:

২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের পরে অমিত শাহ কংগ্রেসকে তাচ্ছিল্য করে একটা কথা বলেছিলেন। কথাটা হল, ১৭টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে কংগ্রেস একটিও আসন জেতেনি। অন্য দিকে, বিজেপি ১৭টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে। এই একটি পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল শাসক দল বিজেপি ও প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের মধ্যে ফারাক কতখানি!

২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে বিরোধী দলগুলি একজোট হয়ে ‘ইন্ডিয়া’ নামক মঞ্চ তৈরি করেছে। কংগ্রেসের সঙ্গে আঞ্চলিক দলগুলির আসন সমঝোতা নিয়ে জোর চর্চা দেখে অমিত শাহ আবার তাচ্ছিল্য করে একটি প্রশ্ন ছুড়েছেন। তা হল, এতে নতুন কী হবে? মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, রাজস্থান, হরিয়ানা, গুজরাত, হিমাচল, উত্তরাখণ্ডের মতো রাজ্যে বিজেপি বনাম কংগ্রেসের সরাসরি লড়াই। বিহার, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ুতে ইতিমধ্যেই বিজেপির বিরুদ্ধে বিরোধীদের জোট রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ, কেরল, দিল্লি, পঞ্জাবে ইন্ডিয়া-র শরিকদের মধ্যে আসন সমঝোতার আশা কম। বাকি, তেলঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশায় আঞ্চলিক দলগুলি ইন্ডিয়া-র মঞ্চে নেই। তা হলে বিরোধী জোটের আসন সমঝোতা করে লড়াইয়ের সিদ্ধান্তে বাস্তবে কী ফারাক হবে?

প্রশ্নটা কিন্তু উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই। তবে অমিত শাহ যেটা বলেননি, তা হল, ফারাক তখনই হবে, যদি কংগ্রেস বিজেপির সঙ্গে নিজের ফারাক মেটাতে পারে।

সোজা কথা সোজা ভাবে বলে ফেলা যাক। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস যদি বিজেপির সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ে ভাল ফল করতে পারে, একমাত্র তবেই বিরোধীদের জন্য আশার আলো রয়েছে। নচেৎ নয়। যে সব রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপির সরাসরি লড়াই, যেখানে কংগ্রেসকে অন্য কোনও শরিক দলের সাহায্য করার কিছু নেই, সেখানে কংগ্রেসকে ভাল ফল করতে হবে। তা না হলে ইন্ডিয়া-র শরিক দলের সমর্থনে কিছু আসনে জিতে এলেও কংগ্রেসের কিছু লাভ হবে না। ইন্ডিয়া-ও বিজেপির হাওয়ায় উড়ে যাবে। অর্থাৎ, তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসকে দু’টি আসন ছাড়লেন না কি চারটি, তার উপরে আদৌ ইন্ডিয়া-র ভাগ্য নির্ধারণ করছে না। ইন্ডিয়া-র সূর্যোদয়ের জন্য কংগ্রেসকে মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, রাজস্থান, গুজরাত, অসমের মতো রাজ্যে ভাল ফল করতে হবে।

বিরোধীদের জন্য চিন্তার কারণ হল, ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচন, তার পরে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনেও কংগ্রেস বিজেপির সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ে শোচনীয় ফল করেছে। পরিসংখ্যান দেখে নেওয়া যাক। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে ১৯২টি আসনে বিজেপি বনাম কংগ্রেসের মুখোমুখি লড়াই হয়েছিল। ৯০ শতাংশের বেশি আসনে বিজেপি জিতেছিল। কংগ্রেস মাত্র ১৬টি আসন পেয়েছিল। বিজেপি ঝুলিতে পুরেছিল ১৭৬টি আসন। ফারাকটা এতখানিই বেশি। অমিত শাহ বিনা কারণে কংগ্রেসকে তাচ্ছিল্য করেননি।

কোন কোন রাজ্যে বিজেপি বনাম কংগ্রেসের মুখোমুখি লড়াই হয়েছিল? এই আসনগুলি মূলত মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, রাজস্থান, গুজরাত, হরিয়ানা, কর্নাটক, অসমে। এর কোনও রাজ্যেই ইন্ডিয়া-র শরিক দলগুলির বিশেষ উপস্থিতি নেই। কংগ্রেস নেতারা শুধু এটুকু ভেবে আশ্বস্ত হতে পারেন, অন্য কোনও আঞ্চলিক দল সেখানে কংগ্রেসের ভোটে ভাগ বসাতে যাবে না। যেমন অতীতে গুজরাত বা গোয়ার বিধানসভা নির্বাচনে আম আদমি পার্টি বা তৃণমূল করেছে। কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনে যা সম্ভব, তা লোকসভা ভোটে সম্ভব নয়। কারণ, লোকসভা ভোটে সব আঞ্চলিক দলই নিজের রাজ্যে নিজের দুর্গ বাঁচাতে ব্যস্ত থাকে। সাধারণত অন্যের ভোট ভাঙাতে যায় না। ফলে আসন সমঝোতা করেও কংগ্রেসের এই সব রাজ্যে বিশেষ কিছু বাড়তি লাভের আশা নেই।

অন্য দিক থেকে দেখলে, বিজেপি গত লোকসভায় যে ৩০৩টি আসন জিতেছিল, তার মধ্যে ১৭৬টিই কংগ্রেসকে মুখোমুখি লড়াইয়ে হারিয়ে জেতা। কংগ্রেস সাকুল্যে যে ৫২টি আসন পেয়েছিল, তার মধ্যে মাত্র ১৬টি আসন বিজেপিকে হারিয়ে জিতে আসা। বাকি আসনের সিংহভাগই কংগ্রেস কেরল, পঞ্জাব ও তামিলনাড়ু থেকে জিতে এসেছিল। যেখানে বিজেপির বিশেষ উপস্থিতি নেই।

লোকসভার ৫৪৫টি আসনের মধ্যে ৫৪৩টি আসনে ভোট হয়। সেই ভোটে জিতে সরকার গড়তে হলে যে কোনও দল বা জোটকে ৫৪৩টি আসনের মধ্যে অন্তত ২৭২টি আসনে জিততে হবে। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে কংগ্রেস পেয়েছিল ৫২টি আসন। ইন্ডিয়া-র বর্তমান শরিকদের আসন যোগ করলে দাঁড়ায় ১০০টি আসন। অর্থাৎ, ইন্ডিয়া ভোটে যাওয়ার মুখে মোট ১৫২টি আসনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ম্যাজিক সংখ্যা ছুঁতে হলেই আরও ১২০টি আসন জিততে হবে। বলা বাহুল্য, এর বেশির ভাগটাই কংগ্রেসকে নিজেকে জিতে আসতে হবে। এবং বিজেপিকে হারিয়ে। ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থানে কংগ্রেস হারলেও দলের ভোটের হার বিশেষ কমেনি বলে মল্লিকার্জুন খড়্গে সান্ত্বনা পুরস্কার চাইতে পারেন। বাস্তব হল, বিজেপি তিন রাজ্যেই নিজের ভোটের হার বাড়িয়েছে। ২০১৪-র তুলনায় ২০১৯-এ কংগ্রেসের ভোটের হার যৎসামান্য বেড়েছিল। ০.১৮ শতাংশ। তাতে তো বিজেপির রথ থামানো যায় না। সে রথ থামাতে হলে ২০১৯-এর ৫২ থেকে কংগ্রেসকে নিজের আসনসংখ্যা বাড়িয়ে অন্তত ১৫০-এ নিয়ে যেতে হবে। তা হলেই বিরোধীদের ইন্ডিয়া জোট নরেন্দ্র মোদীকে হারিয়ে সরকার গড়ার জায়গায় যেতে পারে।

নরেন্দ্র মোদী কি তা সহজে হতে দেবেন? তিনি কংগ্রেসের জন্য লড়াই আরও কঠিন করে তুলছেন। মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি, আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ গোটা দেশে অযোধ্যার রামমন্দির ঘিরে হিন্দু ভাবাবেগের জোয়ার তুলতে চাইছে। এই চ্যালেঞ্জের মুখে রামমন্দিরের প্রাণপ্রতিষ্ঠায় যাবে কি না, কংগ্রেস সেই সিদ্ধান্ত নিতেই হিমশিম খাচ্ছে। বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস মানুষের সুরাহায় নানা গ্যারান্টিকে হাতিয়ার করেছিল। পাল্টা জবাবে বিজেপি ‘মোদী গ্যারান্টি’ নিয়ে গোটা দেশে প্রচারে নেমে পড়েছে। নরেন্দ্র মোদী ‘বিকশিত ভারত’-এর সঙ্কল্প নিয়ে গোটা দেশকে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। প্রচারে কেন্দ্রীয় সরকারের বদলে সরাসরি ‘মোদী সরকার’ লেখা হচ্ছে। সরকারের যাবতীয় গ্যারান্টি হয়ে যাচ্ছে ‘মোদী গ্যারান্টি’। তিন হিন্দি বলয়ের রাজ্যে লড়াইয়ে কংগ্রেসকে হারানোর পরে বিজেপি আরও উদ্বুদ্ধ। গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ৩৭ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছিল। কংগ্রেস যখন নিজের ভোটের হার বিশেষ কমেনি বলে সান্ত্বনা খুঁজছে, তখন বিজেপি ২০২৪-এ ৫০ শতাংশ ভোট জেতার লক্ষ্য নিচ্ছে। ৩০৩ আসনে জেতার পরে বিজেপি এ বার ৪০০ আসন জিততে চায়।

এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে কংগ্রেসের একমাত্র হাতিয়ার— মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব ও বিজেপির বিভাজনের নীতি। শুধু মূল্যবৃদ্ধিকে হাতিয়ার করে ছোট রাজ্যের বিধানসভা ভোটে জেতা যেতে পারে। লোকসভা নির্বাচনে জেতা কঠিন। বেকারত্বের সমস্যা বিজেপির গলার কাঁটা ঠিকই, কিন্তু কংগ্রেস যে তা নিয়ে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে জনমানসে ক্ষোভ তৈরি করতে পেরেছে এমন নয়। কখনও বেকারত্ব, কখনও মূল্যবৃদ্ধি, কখনও আদানিদের সুবিধা পাইয়ে দেওয়া, কখনও ধনী-গরিবের ক্রমবর্ধমান আর্থিক অসাম্যের কথা বলে কংগ্রেস নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে জনমানসে ক্ষোভ তৈরি করতে চাইছে ঠিকই, সঠিক রণকৌশল বা সুবক্তার অভাব হোক কিংবা সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে প্রচারে খামতি, তা পুরোপুরি দানা বাঁধছে না।

বিজেপির বিভাজনের নীতির বিরুদ্ধে রাহুল গান্ধী ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ করেছিলেন। এ বার তিনি ‘ভারত ন্যায় যাত্রা’ শুরু করছেন। আস্তিনে এই একটি মাত্রই তাস ছিল। কংগ্রেস বলছে, সংবিধানের চারটি মূল মন্ত্র হল, ন্যায়, স্বাধীনতা, সমতা ও ভ্রাতৃত্ব। শেষের তিনটি মন্ত্র, স্বাধীনতা, সমতা, ভ্রাতৃত্বের পক্ষে রাহুল গান্ধী প্রথম যাত্রা করেছিলেন। এ বার তিনি ন্যায়ের আশ্বাস দিতে পথে নামছেন। এই মন্ত্র নিয়ে কিছুটা বাসে চেপে, কিছুটা পায়ে হেঁটে মণিপুর থেকে মুম্বই যাত্রা করে রাহুল গান্ধী কি মুখোমুখি লড়াইয়ে বিজেপিকে হারানোর মতো রসদ জোগাড় করতে পারবেন!

পারলে ইন্ডিয়া-র পক্ষে ভাল। না পারলে অমিত শাহ ফের তাচ্ছিল্য করার সুযোগ পেয়ে যাবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Congress TMC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE