E-Paper

নিহতের আসল পরিচয়

সংখ্যাটা উনিশ না পঞ্চাশ, তা নির্ণয় করা কঠিন। পঞ্চায়েত নির্বাচনের ‘যুদ্ধে’ ঠিক কত জন প্রাণ হারালেন, সেই সংখ্যাটা নির্ভর করছে সংখ্যাটা কে বলছেন তাঁর উপর।

কুমার রাণা

শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০২৩ ০৬:১৭
An image of Jawan

ভয়: পুনর্নির্বাচনের দিন নিরাপত্তারক্ষার দায়িত্বে বহাল কেন্দ্রীয় আধাসামরিক বাহিনীর জওয়ান। ১০ জুলাই ২০২৩, দক্ষিণ দিনাজপুর। ছবি: পিটিআই।

কথা হচ্ছিল ভাঙড়ের এক বন্ধুর সঙ্গে, সেখানকার দলীয় সংঘর্ষে লোক মারা যাওয়া নিয়ে। “ভাই, লোক মারা যাওয়াটা কোনও ব্যাপার না। এক জনের বৌকে গিয়ে আর এক জন জিজ্ঞাসা করল, অমুক কখন ফিরবে। বৌ উত্তর করল, কে জানে, ফিরবে কি না, হয়তো মার্ডার হয়ে গেছে। মানুষের জীবনের এই দাম!” মানুষের জীবনের দাম যে নেই— অন্তত বাংলার পার্টিকর্তা থেকে প্রশাসন, বিদ্যাবেত্তা ও সংবাদমাধ্যমের কাছে— তা জানতে না চাইলেও তাঁরা জানিয়ে ছাড়বেন, ঠিক কত জনের প্রাণ গেল, সেই চিৎকৃত বায়সকলহে।

সংখ্যাটা উনিশ না পঞ্চাশ, তা নির্ণয় করা কঠিন। পঞ্চায়েত নির্বাচনের ‘যুদ্ধে’ ঠিক কত জন প্রাণ হারালেন, সেই সংখ্যাটা নির্ভর করছে সংখ্যাটা কে বলছেন তাঁর উপর। তার পরেও প্রশ্ন, কেন একটা নির্বাচনের প্রক্রিয়াতে কারও প্রাণ যাবে? উত্তরটা চেনা: না গিয়ে উপায় কী— বিরোধী দলের লোকেরা হিংসা ছড়িয়েছে, তারা শান্তি চায় না। উত্তরের যথার্থতার পিছনে আরও সহজ ‘প্রমাণ’ হল, মারা যাওয়া লোকেরা বেশির ভাগই শাসক দলের কর্মী বা সমর্থক। এহ বাহ্য। কিন্তু, তাঁরা শাসক দলের কর্মী-সমর্থক, এটা তো কারও জন্মজাত পরিচিতি নয়। তার আগে সন্তান, পিতা, স্বামী, ভাই, গ্রামবাসী ইত্যাদি নানা পরিচিতি তাঁদের ছিল। রক্তের স্রোত সেগুলোকে ধুয়ে নিয়ে গেল। আরও যা ধুয়ে নিয়ে গেল, তা হল তাঁদের জীবনধারণের সংশ্লেষ— শ্রেণি-পরিচিতি, পেশাগত ও সামাজিক প্রেক্ষাপট। কেবল রেখে গেল হয় তাঁদের দলীয় সংযোগ, নয় ধর্মীয় পরিচিতি। মৃতের সংখ্যা উনিশ দাবি করা রাজনীতিকর্তার কাছে তাঁরা তাঁদের দলের লোক, আর সংখ্যাটা পঞ্চাশ দাবি করা সংবাদমাধ্যমের কাছে তাঁরা ধর্মে মুসলমান।

পরিচিতি আরোপ করে দেওয়া সহজ। কারণ, তাঁদের দলীয় বা ধর্মীয় আকৃতিগুলো দৃশ্যমান। শ্রেণিগত প্রেক্ষাপটগুলো ঢাকা দিয়ে দেওয়া হয় দলীয় পতাকা বা তাঁদের নামের আড়ালে। আর, লক্ষ করা যেতে পারে, নিহতদের মধ্যে নামের দিক দিয়ে হিন্দুদের প্রায় সকলেই নিপীড়িত দলিত বর্গের, যাঁদের সম্পর্কে ঔদাসীন্যই ক্ষমতাশালীদের ভূষণ। তাঁদের সম্পর্কে প্রায় কিছুই বলা হয় না। অথচ, একটু খতিয়ে দেখলেই স্পষ্ট হয় যে, নিহতদের বেশির ভাগেরই যে পরিচিতি প্রাধান্য পাচ্ছে— অর্থাৎ, দলীয় কর্মী ও মুসলমান (দলিতদের জন্য পড়ে থাকে নীরবতা)— এগুলোর পিছনে কাজ করেছে তাঁদের শ্রেণি-পরিচিতি।

নিহতদের প্রায় কারও জীবনেই সুযোগের দেখা মিলত না। এঁদের না ছিল আর্থিক জোর, না লেখাপড়ার বল। স্বাভাবিক ভাবেই রাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষমতাও এঁদের অধরা। জন্মজাত ভাবেই এঁরা নাগরিকত্বের বৃত্তের বাইরে। সম্প্রতি জনগণনার খুবই বড় আকারের তথ্য বিশ্লেষণ করে লেখা একটি গবেষণাতে দেখা গেছে যে, মুসলমান ও দলিতরা বিভিন্ন জনপরিষেবা থেকে বিপুল ভাবে বঞ্চিত। স্কুল হোক বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, নলবাহী জল হোক বা সাফাই ব্যবস্থা, সব দিক দিয়েই এঁরা সুযোগবঞ্চিত (এ কথা জনজাতিদের ক্ষেত্রেও খাটে)। শিক্ষিত হয়ে সংগঠিত হওয়ার, এবং তার ভিত্তিতে বিক্ষোভ দেখানোর যে পথের কথা আম্বেডকর বলে গেছেন, সেই পথটাই এঁদের কাছে অচেনা। ফলে, এঁদের সামনে পড়ে থাকে ‘নিয়তিনির্দিষ্ট’ এক বিধান— গতরে খেটে ততটাই পাওয়া, যতটা তাঁদের বাঁচিয়ে রাখে, কিন্তু নাগরিক হয়ে উঠতে দেয় না।

কিন্তু, মানুষমাত্রেই নাগরিকত্বের স্বপ্ন দেখে। সারা বিশ্বের গরিবের মতোই, বাংলার গরিবও দেখে। ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’-র স্বপ্ন বিস্তৃত হয়, ‘আমার ছেলেমেয়ে যেন লেখাপড়া শেখে’। সে-স্বপ্ন বারংবার মার খায় শিক্ষার প্রতি শাসকের ‘স্বাভাবিক বিরাগে’। তবু স্বপ্নের অমরত্ব তার বুকে জাগিয়ে তোলে এক পূর্ণ নাগরিক হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা। যুগ যুগ ধরে সে শ্রম করে এসেছে। আর তাকে বলা হয়েছে: মা ফলেষু কদাচন। তার উপরে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে অপমানের বোঝা, “তুই পড়তে পারিস না, বাংলা বলতে পারিস না, রবীন্দ্রসঙ্গীত জানিস না...।” যে অভাবগুলো তার উপর চাপিয়ে দেওয়া, তার জন্য তাকেই দায়ী করা।

অথচ সে মুক্তি পেতে চায়। আর্থিক শোষণ থেকে, নানা ধরনের বঞ্চনাবোধ থেকে— সে বঞ্চনা নিজেকে প্রকাশ করতে না পারার, নিজের সাংস্কৃতিক মূল থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকার, নিজের সামুদায়িক নৈতিকতা থেকে বিচ্যুত হওয়ার। একদা তার অনেক কিছুই ছিল না, কিন্তু ক্ষুধা, অনাহার, অস্বাস্থ্যের মধ্যেও তার স্বজনরা তাকে ঘিরে থাকত। দিন যত এগিয়েছে, পুঁজির প্রক্রিয়া ও নিয়মে, লোকে তত বেশি করে স্বজন হারিয়েছে। বাংলার গ্রামীণ গরিবের অবস্থা ‘না ঘরকা না ঘাটকা’-র। গ্রামের নৈতিক প্রহরার দায়িত্ব যারা এত কাল কাঁধে তুলে রেখেছিল, সেই যুবকগোষ্ঠীর বেশির ভাগটাই দেশান্তরে, যারা আছে তাদের বেঁচে থাকার সম্বল বলতে গোটা সমুদায়ের হতাশার যোগফল। এই হতাশ্বাস, বেপরোয়া অবস্থায় বঞ্চিতদের ভাবনায়, নিজস্ব উদ্যোগের বদলে, রাজনৈতিক দলই হয়ে উঠল একমাত্র পরিত্রাতা। দলকেই তার মনে হল একমাত্র নিজের বস্তু, তার উপাসনার জায়গা, যাকে রক্ষা করার নামে সে প্রাণ দিতে পারে, প্রাণ নিতেও পারে। উনিশ হোক বা পঞ্চাশ, কিচ্ছু যায় আসে না।

এমন নয় যে, গরিব মানুষ এই প্রথম পার্টিকে তার আশ্রয় ভাবতে শুরু করল। তার উপরে চাপিয়ে দেওয়া সামাজিক-আর্থনীতিক হিংসা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে বামপন্থী গণ-রাজনীতি মানুষকে পার্টিমুখী করে তুলেছিল, গরিবেরা ইতিহাসে প্রথম বার নিজেদের সংগঠনের দাবিদার হয়ে উঠছিল। কিন্তু সেই সংগঠনের মধ্যে এমন কিছু ছিল, অথবা ছিল না, যার ফলে গরিব ও তার সংগঠনের সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হল, এবং বেড়ে চলল। সংগঠনের মধ্য-সামাজিক নেতৃত্ব আশ্রয় নিলেন হতাশার কোলে, কিন্তু গরিবের তো উপায় নেই। পার্টিতেই তার আশ্রয়। কিন্তু, যে পার্টিটা তাদের সামনে উঠে এল সেটা এমন, যার শিকড় স্পষ্টতই অচলায়তনপন্থী এক মতাদর্শের মধ্যে নিহিত। তার রাজনৈতিক কর্মসূচিতে এমন কিছু নেই যা সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের সক্ষমতার বিকাশ ঘটাতে তৎপর। বরং, সেই মতাদর্শ হল ক্ষমতার অতিকেন্দ্রীকরণের জন্য শ্রমজীবীদের সিঁড়ি হিসাবে ব্যবহার করা।

তৃণমূল কংগ্রেস দলটিকে আদর্শহীন মনে করা বোধ হয় ভুল— তার কর্মকাণ্ডে যে জিনিসটা প্রতিফলিত তা হল, সামূহিক স্বার্থের জায়গায় ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার দর্শন। বিকেন্দ্রীভূত দুর্নীতির পরিব্যাপ্তির পিছনে যে কারণটি সবচেয়ে জোরালো, তা হল ব্যক্তিস্বার্থকে পরম মেনে নেওয়া। এই দর্শনকে মানুষের মনে চালিত করে দিতে পারলে কী হয়, তা রাজনৈতিক হিংসার কেতাবি বিবরণেই স্পষ্ট: ডুবতে থাকা মানুষ নিজেকে ভাসিয়ে রাখার জন্য পাশের জনকে ডুবিয়ে দিতে পিছপা হয় না। অধুনা সারা পৃথিবী জুড়ে এই দর্শনের প্রাবল্য। এর জোর এতটাই বেশি যে, লোকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্যও শরণ নেয় এমন একটা দলের, যার প্রকৃতি অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক। সারা ভারতে বিজেপির ক্ষমতা দখলের পিছনে যেমন এই কারণ কাজ করেছে, তেমনই বাংলার রাজনীতিতে গরিব মানুষের একাংশের বিজেপির কাছে আশ্রয় নেওয়ার পিছনেও একই ধারা ক্রিয়াশীল থেকেছে। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া এক ভয়ঙ্কর পরিবর্তন, পার্টিকর্তাদের ব্যবসায়ী, এবং ব্যবসায়ীদের পার্টিকর্তা হয়ে ওঠার মতো বৈশিষ্ট্যও গা-সওয়া হতে হতে এখন স্বাভাবিক। দীর্ঘ কাল ক্ষমতায় থাকা, এবং সেই সূত্রে নানা অবাঞ্ছিত স্মৃতির জন্ম দেওয়া, বিশেষত শ্রমজীবী সঙ্গে দূরত্বের কারণে, বাম দলগুলির পক্ষে বিরোধিতার ভূমিকাটিও এখনও অধরা। তারা যত দ্রুত তাদের বিরোধী ভূমিকায় স্থিত হতে পারবে, ততই দেশবাসীর মঙ্গল।

না যদি পারে, তাদের বিকল্প তৈরি হবে। কারণ, সবটাই তো নিরাশার কাহিনি নয়। শ্রমজীবী যে তার সামূহিক চরিত্র হারিয়ে ফেলতে চায় না, তার কিছু নজির তো এই নির্বাচনেও আমরা দেখলাম। যতই ক্ষুদ্র আকারে হোক, পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজ্যের নানা প্রান্তে, শাসক ও শাসকীয়-বিরোধী বিজেপির নিশ্ছিদ্র গড়গুলোতে যে ভাবে মানুষ ভোট দিলেন, বা দেওয়ার চেষ্টা করলেন, তাতে একটা বার্তা আছে: উনিশ না পঞ্চাশ, তাঁদের কাছে সেই তরজাটার কোনও মানে নেই। তাঁদের একান্ত আগ্রহ নাগরিকত্বের পূর্ণতর অর্জনে, মানুষের জীবনের দামে। শাসকের কাছে সেটা অশান্তির, কিন্তু সামূহিক মানুষের কাছে সেটাই আশার কারণ।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

West Bengal Panchayat Election 2023 Death Election Violence

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy