Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Assam

দিব্যি কাজ করে শিশু গ্রামসভা

ব্রহ্মপুত্রকে পিছনে রেখেই মাটির অপরিসর পথ বেয়ে এগোলে গ্রামের স্কুল। ঈর্ষণীয় তার সামনের মাঠটুকু। প্রকৃতিপাঠের সুন্দর আসর। কয়েক পা দূরেই চলছে রাস্তা আর বাঁধ বানানোর কাজ।

বালি আর নদীর সঙ্গে অবিরাম লড়াই গ্রামের মানুষদের।

বালি আর নদীর সঙ্গে অবিরাম লড়াই গ্রামের মানুষদের। ফাইল চিত্র।

পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০২২ ০৫:১০
Share: Save:

জাতীয় সড়ক থেকে রাস্তাটা ডান দিকে ঘুরতেই অসমের চোখজুড়োনো গ্রাম। পড়ন্ত দুপুরে বাঁধাকপির খেত, টলটলে জলে মাছ-ধরা জালের দৃশ্য পিছনে ফেলে বেশ কিছুটা এগোতেই চমক। চটচটে সাদা বালিতে ঢাকা রাস্তা, উঠোন। এ জায়গা ব্রহ্মপুত্রের অদূরে গড়ে ওঠা গ্রাম, বেড়াছাপুরি। বছর দুয়েক আগের বন্যায় উত্তাল ব্রহ্মপুত্র গ্রামে ঢুকে উপুড়হস্তে বালি ঢেলে ফিরে গিয়েছিল যথাস্থানে। সেই বালিতেই ডুবেছে গ্রাম। বালি আর নদীর সঙ্গে অবিরাম লড়াই গ্রামের মানুষদের।

ব্রহ্মপুত্রকে পিছনে রেখেই মাটির অপরিসর পথ বেয়ে এগোলে গ্রামের স্কুল। ঈর্ষণীয় তার সামনের মাঠটুকু। প্রকৃতিপাঠের সুন্দর আসর। কয়েক পা দূরেই চলছে রাস্তা আর বাঁধ বানানোর কাজ। বালি আর ধুলো উড়ে সমানে ঢেকে দিচ্ছে ক্লাসের চেয়ার-টেবিল। মিহি ধুলোয় শহুরে শ্বাস আটকে আসে যেন। পড়ুয়ারা অবিচল। ‘মক ড্রিল’-এর প্রস্তুতিতে ব্যস্ত।

ফি শনিবার স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে মহড়া দেয় বন্যা-ভূমিকম্পের হাত থেকে বাঁচার, করোনাকালে নিয়ম মেনে হাত ধোয়ার। রূঢ় বাস্তবের সঙ্গে লড়াই করে যাদের বাঁচতে হয়, তাদের এই জীবনের পাঠও জরুরি বইকি। অসমের ধেমাজি জেলা অত্যন্ত ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। ফলে বিপদ মাথায় নিয়েই দিন কাটে বাসিন্দাদের। আর বন্যা তাদের নিত্যসঙ্গী। বছরের ছ’মাস চলে নদীর সঙ্গে এক অসম জলযুদ্ধ। সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে শহর ছেড়ে অনেক ভিতরে, মূলত জনজাতি অধ্যুষিত গ্রামের এক অনামী বিদ্যালয় কী ভাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও সেই যুদ্ধে জেতার মন্ত্র শেখানোর চেষ্টা করছে, দেখে মুগ্ধ হতে হয়। স্কুলেই থাকে পরিপাটি ফার্স্ট এড বক্স, পড়ুয়াদের একাংশ ব্যান্ডেজ বাঁধা, ক্ষত ঢাকার প্রাথমিক পাঠ রপ্ত করেছে সযত্নে, শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে।

ঠিক এখানেই সদিচ্ছার প্রশ্নটা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। শিশুদের নিয়ে গঠনমূলক কিছু করে ওঠার সদিচ্ছা। শুধু সিলেবাসটুকু শেষ করা নয়, শুধু পরিকাঠামোর অভাবের অভিযোগ নয়, বরং সীমাবদ্ধ পরিকাঠামোকেই ব্যবহার করে শিশুকে গড়ে তোলার সদিচ্ছা। সেই সদিচ্ছা আপার অসমের ধেমাজি জেলার জনজাতি অধ্যুষিত গ্রামগুলিতে স্পষ্ট চোখে পড়ে। ধেমাজি ভারতের অন্যতম বন্যাপ্রবণ অঞ্চল। জলবায়ু পরিবর্তনের দাপটে পাল্টে যাচ্ছে বন্যার গতিপ্রকৃতি। প্রস্তুত হওয়ার সময়টুকুও মিলছে না। এমতাবস্থায় মানুষের সুরক্ষা, তাঁদের জীবিকার দিকটি অক্ষত রাখার প্রচেষ্টারই সর্বাধিক গুরুত্ব পাওয়ার কথা ছিল। সেই কাজ চলছে। পাশাপাশি চলছে শিশুর অধিকারগুলি যেন বন্যার জলে ভেসে না যায়, সেই চেষ্টাও। ইউনিসেফ, স্থানীয় অসরকারি সংস্থা এবং সরকার— যৌথ ভাবে। সাগ্রহে শামিল হয়েছেন অভিভাবকেরাও।

২০১৬ সাল থেকেই ধেমাজি এবং মাজুলিতে বন্যা থেকে বাঁচতে নিরাপদ স্থায়ী প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে ‘চাইল্ড ফ্রেন্ডলি স্পেস’ বানানোর প্রচেষ্টা শুরু করে ইউনিসেফ এবং স্থানীয় অসরকারি সংস্থা। রাজ্যের মধ্যে প্রথম। পরবর্তী কালে সেই ধারণাকেই গ্রহণ করে রাজ্য সরকার। এবং ত্রাণ শিবিরের মধ্যেই ‘শিশু সহায়ক পরিবেশ’ গড়ে তোলা বাধ্যতামূলক করে। দীর্ঘ বন্যার সময়কালে এক সময় পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। পরবর্তী কালে শুরু হয় বানভাসি এলাকায় শিক্ষকদের ত্রাণশিবিরে এসে পাঠ দেওয়ার কাজ। অনেকটা লকডাউনের সময় স্কুল বন্ধ থাকাকালীন শিক্ষাদানের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রাখার যে পন্থাটির কথা পশ্চিমবঙ্গেও শোনা গিয়েছিল। দুর্ভাগ্য, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সেই উদ্যোগ বিশেষ চোখে পড়েনি।

শিশুকল্যাণ উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া বিষয় হতে পারে না। অথচ, বাস্তবে তার অনুশীলনই দেখা যায়। শিশুরা কী চায়, সে নিয়ে আদৌ কেউ ভাবে না। অথচ, ওদের ভাবনাগুলোর কণ্ঠে স্বর দেওয়ার বড় প্রয়োজন। লাইমাকুড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতে গিয়ে জানা গেল ‘শিশু গ্রামসভা’র কথা। শিশুরা তাদের গ্রামের, নিজেদের সমস্যার কথা যেখানে তুলে ধরতে পারে, তার মঞ্চ। স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং পঞ্চায়েত সদস্যদের উপস্থিতিতে তারা জানাল, অনলাইন পঠনপাঠনের জন্য ফোনে ইন্টারনেট সংযোগ নেওয়া হলেও তাতে মাঝেমধ্যেই আপত্তিকর ভিডিয়ো, পপ-আপ ভেসে ওঠে। অভিভাবকরা ইন্টারনেট সংযোগ কেটে দেন। পড়ুয়ারা অসুবিধায় পড়ে। শিশু গ্রামসভার বক্তব্য শুনে পঞ্চায়েত তার নিরসনের চেষ্টা করবে, এমনটাই আশা। এই ‘কনসেপ্ট’ পরিপূর্ণ রূপ এখনও পায়নি, তবু শিশু-ভাবনাগুলিকে পরিবারের মধ্যেই ধামাচাপা না দিয়ে তাকে যে সরকারের কানে তোলার চেষ্টা চলছে, সেটাই বা কম কিসের।

শীতের বিকেল দ্রুত নামে। হাওয়াই চটি, সস্তার জুতো পরা পায়ের সারি দূর গ্রামের পথ ধরে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। কত অনাদরই না জোটে তাদের কপালে। শিক্ষকের অভাবে শিক্ষা অপূর্ণ থাকে, অপ্রতুল সরকারি বরাদ্দে আধপেটা মিড-ডে মিলে সন্তুষ্ট হতে হয়। তবুও কিছু আলোর ফুলকি ইতিউতি চোখে পড়ে। এই ঘোর অন্ধকারে সেই ফুলকিগুলোর বড় প্রয়োজন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Assam village school
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE