Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
Rate of Savings

সঞ্চয়ের হার নিম্নমুখী কেন

ব্যাঙ্কের গচ্ছিত জমার উপর যদি আমরা ৮ শতাংশ সুদ পাই আর মৃল্যবৃদ্ধির হার যদি ৬ শতাংশ হয়, তা হলে প্রকৃত সুদের হার ৮ থেকে ৬ বাদ দিলে ২ শতাংশ।

—প্রতীকী ছবি।

সুগত মারজিৎ
শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০২৩ ০৬:০০
Share: Save:

খবরে দেখলাম, ভারতে পরিবারপিছু সঞ্চয়ের হার বেশ খানিকটা কমে গিয়েছে। মানুষ সঞ্চয় ভেঙে বা ব্যাঙ্কের কাছে ঋণ করে ভোগব্যয় করছেন। এই পরিস্থিতির দু’রকম ব্যাখ্যা হতে পারে। সরকারপন্থীরা বলছেন, মানুষ নিশ্চয়ই ভবিষ্যৎ সম্পর্কে খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়েই অত সঞ্চয় করার কথা ভাবছেন না, তাই খরচ করছেন। নতুন নতুন জিনিসপত্র কিনছেন। বিরোধীপক্ষের বিশেষজ্ঞরা বলছেন মানুষের বাস্তব আয় বা সম্পদ খানিকটা নিম্নমুখী তাই সঞ্চয় ভাঙতে হচ্ছে।

ব্যাঙ্কের গচ্ছিত জমার উপর যদি আমরা ৮ শতাংশ সুদ পাই আর মৃল্যবৃদ্ধির হার যদি ৬ শতাংশ হয়, তা হলে প্রকৃত সুদের হার ৮ থেকে ৬ বাদ দিলে ২ শতাংশ। যাঁরা ব্যাঙ্কের মাধ্যমে সঞ্চয় করেন, তাঁরা মূল্যবৃদ্ধির হার বাড়লে ক্ষতিগ্রস্ত হন। ১০০ টাকা ব্যাঙ্কে রাখলেন, কাল পেলেন ১০৮ টাকা— কিন্তু জিনিসপত্রের দাম তত ক্ষণে বেড়ে গিয়েছে, তাই ১০৮ টাকা দিয়ে হয়তো তিন কিলো চালের বদলে দু’কিলো চাল কিনতে পারলেন। এ দিকে, ব্যাঙ্কে যাঁদের টাকা থাকে, তাঁরাই আসলে ছোট-বড় সব ব্যবসায়ীকে ধার দেন। যাঁদের পুঁজি কম, তাঁরা সহজে বড় অঙ্কের ধার পান না, তাঁরা ব্যাঙ্কে টাকা রেখে সুদ অর্জন করেন। যাঁদের পুঁজি আছে, তাঁরা সেই ব্যাঙ্ক থেকে টাকা নিয়ে ব্যবসা করেন।

ভারতে প্রকৃত সুদের হার ২০১৪ সালে ৬.৭ শতাংশ থেকে ২০২২ সালে এসে হয়েছে ০.২৩ শতাংশ। ২০২০ সাল থেকে এর পতন হয়েছে দ্রুতগামী। ব্যাঙ্কে সুদ কমলে যাঁরা টাকা জমা রাখেন তাঁদের মুশকিল, কিন্তু যাঁরা ধার নেন, তাঁদের সুবিধা। কারণ তাঁরা ১০০ টাকা ধার নিয়েছিলেন যখন, তখন তিন কিলো চালের দাম ছিল ১০০ টাকা। তাঁরা যদি টাকার বদলে তিন কিলো চাল ধার নিতেন, তা হলে ফেরত দিতে হত সেই তিন কেজি চালই। যার দাম ১০০ টাকার সুদে-আসলে বেড়ে দাঁড়ানো মোট অঙ্কের চেয়ে বেশি।

এই বিতর্কে কাউকে বলতে শুনলাম না যে, মূল্যবৃদ্ধির ফলে প্রকৃত সুদের হার কমে যাওয়ায় সঞ্চয়কারীরা আর তেমন সঞ্চয় করতে চাইছেন না। যদি ব্যাঙ্কের আমানতকারীদের প্রদত্ত বাস্তব সুদের হার মূল্যবৃদ্ধির হারের চেয়ে কম হয়, তা হলে পরিবারের প্রকৃত সঞ্চয় নিম্নমুখী হবেই।

যদি বাস্তব সুদের হার কমতে থাকে তা হলে ধার করাই ভাল। ধার করে জিনিস কেনাই ভাল কারণ ঋণগ্রহীতাদের কাছে কম সুদ মানে ধারের খরচ কম। ফলে যদি বাস্তব সুদের হার বেশ খানিকটা কমে যায়, যা মূল্যবৃদ্ধির হারের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত, তা হলে সঞ্চয় কমবে, ধার করে খরচ বাড়বে। কিন্তু উচ্চমার্গীয় বিবাদ-বিতর্কে এক দল বললেন যে, আশাবাদী মানুষ বেশি খরচ করছেন; আর এক দল বললেন যে, মানুষ নিঃসম্বল হয়ে খরচ করতে বাধ্য হচ্ছেন। সবচেয়ে সাদামাঠা যুক্তিটি হারিয়ে গেল।

এ বার প্রশ্ন হল, বাস্তব সুদের হারের এ অবস্থা হল কী করে? মূল্যবৃদ্ধিই মূল অপরাধী। বড়লোক দেশে এই হারের আরও খারাপ অবস্থা, বাস্তব সুদের হার শূন্যের কাছাকাছি বা তারও নীচে। যেমন আমেরিকা। কিন্তু সে সব দেশে অনেক দিনই ব্যাঙ্কে সুদের হার বেশ কম। ভারতে শেয়ার বাজারের ওঠানামা ঘোর অনিশ্চিত। অনিশ্চিত বাজারে ঝুঁকি নিতে স্বল্পবিত্তের মানুষজন ভয় পান। কিন্তু ব্যাঙ্কে বাস্তব সুদের হার কমতে থাকলে অগত্যা কী আর করা। বাড়িঘর, সোনাদানাকে বেশি বিশ্বাস করে অবিশ্বাসী মন। তাই যখন সরকারি ব্যাঙ্ক তেমন কিছু অতিরিক্ত রোজগার দেয় না, তখন স্বভাবতই মানুষ ইটপাথরের কাঠামোয় খরচ করেন। তাই অনিশ্চয়তার ভয়ে না নিশ্চয়তার আনন্দে এ বিষয়ে সন্দেহ দূর করা অত সহজ নয়।

তবে এ কথাটাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না যে এ দেশে সামগ্রিক ভাবে অর্থনীতির অবস্থা তেমন খারাপ নয়, যদিও জনসাধারণের আয় বৃদ্ধি তেমন ভাবে হয়নি বলেই, জাতীয় আয় বৃদ্ধির প্রায় শীর্ষে বসা ভারতের মাথাপিছু আয় সেই তুলনায় খুবই কম। আর তার তেমন বৃদ্ধিও হচ্ছে না। তাই আর্থিক অবস্থা মূল্যবৃদ্ধির বেড়াজালে ধাক্কা খাওয়ার বেশি আশঙ্কা। টাকাকড়ির হিসাবে মানুষের রোজগার যদি মূল্যবৃদ্ধির হারের চেয়ে কম হারে বৃদ্ধি পায়, তা হলে তাঁরা আগের চেয়ে দরিদ্র হচ্ছেন এবং সম্পদ বৃদ্ধি করার কোনও উপায় তাঁদের কাছে থাকছে না। কিন্তু এঁরা বাড়ি-গাড়ি-বৈদ্যুতিন গ্যাজেট কিনছেন। ফলে সামগ্রিক ভাবে মূল্যবৃদ্ধির হার পরিবারের সম্পদসৃষ্টিতে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে, কারণ সংসার খরচ সামলে সঞ্চয় করা দুষ্কর হয়। অন্য দিকে, যাঁরা অপেক্ষাকৃত সম্পদশালী, তাঁরা অতিরিক্ত সঞ্চয় করতে তেমনটা চাইছেন না, বা ‘দাম বাড়তে থাকলে এখনই কেনাকাটা সেরে ফেলা ভাল’ এমন যুক্তিটিও প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে।

মূল্যবৃদ্ধির আর একটা সমস্যা সামলাতে হচ্ছে টাকার ক্রমাগত অবমূল্যায়নের মাধ্যমে। অন্তত ২০২০ পর্যন্ত ভারতে প্রকৃত সুদের হার পশ্চিমের অনেক দেশের তুলনায় বেশি থাকার জন্য মাঝে-মাঝেই বিদেশি মূলধন এ দেশে এসেছে এবং এখনও আসছে। কিন্তু দেশে জিনিসের দাম বাড়তে থাকলে বিদেশের বাজারে সেগুলো বিক্রি করা শক্ত হয়। এ কথা যদিও সত্যি যে, সারা বিশ্বেই দাম ঊর্ধ্বমুখী, তবুও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার ধাক্কা সামলাতেই হয়। টাকার নিম্নগামী অবস্থার মানেই রফতানির সমস্যার ফলে বৈদেশিক টাকাকড়ির জোগান নিম্নমুখী হচ্ছে। সে ঘাটতি বিদেশি বিনিয়োগের ফলে আগত ডলারের স্রোত সামাল দিতে পারছে না, তাই টাকার দাম কমছে।

সরকার মূল্যবৃদ্ধির হার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যাতে আরও বেশি মূল্যবৃদ্ধি না হয় তার রাশ টানতে ব্যাঙ্কে সুদের হার বাড়িয়েছে, তাতে আমানতকারীদের নিঃসন্দেহে ক্ষতির পরিমাণ কমেছে। কিন্তু ব্যাঙ্ক ছাড়া অন্য মূলধনি সংস্থা থেকেও ধার নিয়ে মানুষ খরচ বাড়িয়েছেন। সেটাও সত্যি।

পরিবারপিছু সঞ্চয়-বিনিয়োগ যা-ই হোক না কেন, সামগ্রিক ভাবে জাতীয় আয়ে বিনিয়োগের হারে তেমন কোনও পরিবর্তন হয়নি। এ দেশে কর্পোরেট ক্ষেত্রে সামগ্রিক বিনিয়োগ ২০১৪ সালেও জাতীয় আয়ের ৩০ শতাংশ ছিল, এখনও প্রায় তা-ই। অর্থাৎ এই বিতর্ক হোক না হোক এ দেশের বিনিয়োগের হার একেবারেই বলবার মতো নয়। আর বাস্তব সুদের হারের অধোগমনে তাঁদেরই তাত্ত্বিক ভাবে সবচেয়ে খুশি হওয়ার কথা, যাঁরা বড় বিনিয়োগ করতে পারেন। কারণ, তিন কিলো চাল ধার নিলেন বটে, কিন্তু শোধ দিলেন হয়তো তিন কিলো চালই। সুদটা যাঁকে দিলেন, দাম বেড়ে তাঁর কোনও লাভই হল না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bank Economy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE