Advertisement
২৩ মার্চ ২০২৩
Economic Crisis

আমেরিকার অর্থনীতিতে দুর্যোগের পূর্বাভাস! ভারত নিরাপদ তো?

আমেরিকায় স্পষ্ট হয়ে উঠছে অর্থনৈতিক সঙ্কটের লক্ষণ। বড় ঝড়ঝাপটার মোকাবিলায় ভারত ঠিক কতখানি প্রস্তুত?

Narendra Modi and Joe Biden

নিয়ন্ত্রণকর্তা এবং ভাষ্যকারদের মুখ থেকে প্রাথমিক অবস্থায় বিস্তর স্তোকবাক্য শোনা যায়। বলা হতে থাকে, পরিস্থিতি কিছুতেই সংক্রামক হয়ে দাঁড়াবে না। ফাইল চিত্র।

টি এন নাইনান
টি এন নাইনান
শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০২৩ ১০:৪৪
Share: Save:

আমেরিকান কবি অগডেন ন্যাশ (১৯০২-’৭১) তাঁর এক কবিতায় বোতল থেকে কেচাপ বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়াকে বর্ণনা করেছিলেন ~ফার্স্ট আ লিট্‌ল, দেন আ লট্‌ল’ বলে। ‘লিটল’-এর সঙ্গে আনুপ্রাসিক সাযুজ্য রাখতে গিয়েই মহারসিক ন্যাশ ‘লট্‌ল’ শব্দটি তৈরি করে নেন। বোঝাই যায়, এ দিয়ে ‘হুড়মুড়িয়ে প্রচুর পরিমাণে বেরিয়ে আসা’-কেই বোঝাতে চেয়েছিলেন তিনি।

Advertisement

অর্থনৈতিক সঙ্কট নিয়ে ভাবতে বসলে ন্যাশের সেই দু’লাইনের ছোট্ট কবিতাটি মনে পড়ে যায়। যদি ২০০৮-এর অর্থনৈতিক সঙ্কটের দিকে তাকান, দেখতে পাবেন, ঘটনা আসলে দু’বছর আগেই শুরু হয়েছিল।যে সময়ে আমেরিকার বাজারে বাড়ির দাম পড়তে শুরু করে। ২০০৭-এর গোড়ার দিকে যাঁরা ‘সাব-প্রাইম হাউজিং’ (যে প্রকার গৃহঋণ সেই সব মানুষকেই দেওয়া হয়, যাঁদের ইতিপূর্বে ঋণ দেওয়া হয়নি বা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় কম ছিল বা ঋণদানের প্রক্রিয়া অসম্পূর্ণ ছিল)-এর জন্য টাকা ধার দিয়েছিলেন, তাঁরা নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করতে শুরু করেন। সেই বছর জুন মাসে দু’টি বড়সড় ‘হেজ় ফান্ড’ (যারা বিভিন্ন সূত্র থেকে টাকা একত্র করে যৌথ ভাবে ব্যবহারের জন্য কিছুতে বিনিয়োগ করে) সাব-প্রাইম বাজারে ধাক্কা খায়। এগুলি ছিল প্রাথমিক লক্ষণ। আসল বিপর্যয় দেখা দেয় তার পরে।

২০০৮-এর জানুয়ারি মাসে ‘কান্ট্রিওয়াইড’ (এই সংস্থার হাত দিয়েই সাব-প্রাইম সিকিউরিটি সব থেকে বেশি পরিমাণে বাজারে ছাড়া হয়েছিল) কোনও মতে তার দেউলিয়া হওয়া ঠেকাতে সমর্থ হয়।কারণ, ব্যাঙ্ক অফ আমেরিকা তাকে অধিগ্রহণ করে। দু’মাস পরে লগ্নিকারী ব্যাঙ্ক বিয়ার স্টার্নজ় দেউলিয়া হওয়ার পথে পা বাড়ায় এবং জেপি মর্গ্যান চেজ় তাকে অধিগ্রহণ করে বাঁচায়। সেপ্টেম্বর মাসে বিপদ সর্বত্র ছেয়ে যায়, সামগ্রিক ভাবেই পশ্চিমী অর্থব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। শুরু থেকে চূড়ান্ত বিন্দুতে পৌঁছতে এই সঙ্কটের দু’বছর সময় লেগেছিল।

যে কোনও পদ্ধতিগত সঙ্কটের ক্ষেত্রেই, তা সে ২০০৮-এর মতো বড় হোক বা ১৯৮০-র দশকে মেক্সিকোয় শুরু হয়ে লাতিন আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়া ‘টেকিলা সঙ্কট’-এর মতো অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রায়তন হোক, নিয়ন্ত্রণকর্তা এবং ভাষ্যকারদের মুখ থেকে প্রাথমিক অবস্থায় বিস্তর স্তোকবাক্য শোনা যায়। বলা হতে থাকে, পরিস্থিতি কিছুতেই সংক্রামক হয়ে দাঁড়াবে না। অমুক কোম্পানি বা তমুক দেশ নিরাপদ। কিন্তু তা সত্ত্বেও সংক্রমণ ঘটে, ভাল মতোই ঘটে।

Advertisement

১৯৯৭-’৯৮ সময়কালের এশীয় অর্থসঙ্কটের শুরুর দিকে তাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়া বেশ আহত হয়।কিন্তু বলা হতে থাকে, ইন্দোনেশিয়া নিরাপদ থাকবে।কারণ, সেখানে মুদ্রস্ফীতির হার বেশ কম।তার বাণিজ্য-উদ্বৃত্তের পরিমাণ যথেষ্ট এবং সে দেশের হাতে মজুত ডলারের পরিমাণও নেহাত মন্দ নয়। শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ার এই বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটিই সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমেরিকান ডলারের নিরিখে ইন্দোনেশীয় রুপিয়ার মূল্যমান ১৯৯৭ সালে ছিল ২৪০০।এক বছরের মধ্যে তা দাঁড়ায় ১৪,৯০০। অর্থাৎ আগের থেকে রুপিয়ার মূল্যমানে ৬ গুণ পতন ঘটে। দেশ জুড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয় এবং সরকারের পতন হয়।

আমেরিকায় এই মুহূর্তে যা ঘটছে, তা অগডেন ন্যাশের কেচাপ-বর্ণনার সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়। সঙ্কট শুরু হয়েছিল ধীরগতিতেই। সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে যুঝতে সুদের হার বাড়াতে শুরু করে। কার্যত তাকে কোভিড অতিমারির সময়কার আর্থিক সঙ্কটের সঙ্গে লড়াই করার জন্য তৈরি শিথিল অর্থনীতির ফলশ্রুতি বলা যায়। ঋণদাতারা তাঁদের হাতে থাকা সিকিউরিটি সংক্রান্ত ক্ষতির জন্য প্রাথমিক ভাবে প্রস্তুত ছিলেন (সুদের হার বাড়ায় বাজারে থাকা বন্ডগুলির দাম পড়তে সুরু করে)। এ বার, ২০০৭-এর মতো সব থেকে দুর্বল সংযুক্তি— সিলভারলেক, সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্ক এবং সিগনেচার এক সপ্তাহের কাছাকাছি সময়ের মধ্যে ভেঙে পড়ে। যদিও বাতাসে ‘সংক্রমণ ঘটবে না’-গোছের স্তোকবাক্য ভেসেই বেড়াচ্ছিল।

কিন্তু আর একটি ব্যাঙ্কের পতন রুখে দেওয়া সম্ভব হয় এ কারণেই যে, আমেরিকা ফার্স্ট রিপাবলিক ব্যাঙ্ককে লিকুইডিটি প্রদান করতে সমর্থ হয় এবং সুইস কর্তৃপক্ষ কেচ্ছার ভারে নুয়ে পড়া ক্রেডিট সুইসকে বাঁচাতে উদ্যোগ নিতে থাকেন। এমনকি, আমেরিকার আঞ্চলিক ব্যাঙ্কগুলিও টের পায়, তাদের শেয়ারের দর হু-হু করে পড়তে শুরু করেছে। ব্যাঙ্কের গ্রাহকরা তড়িঘড়ি তাঁদের জমা টাকা তুলে নিতে শুরু করেন। যদি সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্কের মতো অন্য যে কোনও ব্যাঙ্ক দেখতে বাধ্য হয় যে, তার লগ্নিকর্তারা কেনা দামে তাঁদের সিকিউরিটি বিক্রি করে দিতে চাইছেন, তবে তারা বাজারচলতি কম দামেই তা বিক্রি করতে বাধ্য হবে এবং এত দিন ধরে রাখা সিকিউরিটিকে কেনা দামে ছাড়তে বাধ্য হবে। এর ফল দাঁড়াবে ভয়াবহ। ঘটনা গড়াতে থাকবেব্যাঙ্ক-পুঁজির বড় রকমের বিপর্যয়ের দিকে। অর্থনীতিবিদ রবার্ট আর্মস্ট্রং গত শুক্রবার ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’-এ সঠিক ভাবেই লিখেছেন, ‘এখনও পর্যন্ত আমরা মৃদু রকমের ব্যাঙ্কিং-উৎকণ্ঠা পোহাচ্ছি… আরও বেশি দুর্ভাবনার বিষয় কিন্তু অপেক্ষা করে রয়েছে।’

এই সব মৃদু কম্পন সুবিশাল ভূকম্পে হয়তো পরিণত হবে না, যদি ক্রেডিট সুইস তার দেউলিয়া ভবিতব্যকে কাটিয়ে উঠতে পারে।যদি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া খুব সন্তর্পণে এগোতে থাকে এবং ব্যাঙ্কের হাতে-থাকা সিকিউরিটির তিন-চতুর্থাংশের ওঠানামা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। এতে এমন হতে পারে যে, ক্ষতির পরিমাণ লিখিত থাকবে।তাকে লুকোনোর চেষ্টা করা হবে না। এর দ্বারা পুঁজির বিলোপের মতো বিপর্যয় রুখে দেওয়া যাবে বলেই মনে হয়। কিন্তু বৃহত্তর অর্থনীতিতে বিদেশি পোর্টফোলিয়ো পুঁজি (যাতে বিনিয়োগকারী অন্য দেশে সিকিউরিটি ও অন্যান্য সম্পদকে ধরে রাখে)-র বহির্গমনের ঝুঁকি থেকেই যায়। এর ফলে ভারতীয় টাকার মূল্যমানের উপর চাপ পড়বে এবং শেয়ারবাজারের হালও তেমন সুবিধার থাকবে না। টাকার মান পড়ে গেলে সংস্থাগুলি যথেচ্ছ ভাবে বিদেশি ঋণ নিতে পারবে না। মুদ্রাস্ফীতি রুখতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সে ক্ষেত্রে তার তহবিল থেকে ডলার বিক্রি করতে বাধ্য হতে পারে। পরিস্থিতি গিয়ে ঠেকতে পারে স্বল্প তহবিল, বিপুল মুদ্রাস্ফীতি এবং অধঃপাতে যাওয়া শেয়ার বাজারের দিকে। এখনও পর্যন্ত ভারতের বিপদ তেমন প্রকট নয়। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার উদাহরণ মনে রেখে সচেতন থাকাটাই এখন সব থেকে জরুরি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.