Advertisement
১১ অক্টোবর ২০২৪
Hindenburg Report

আদানির হিন্ডেনবার্গ-ধাক্কায় ভারতের বড় প্রকল্পগুলি কি অগাধ জলে পড়ল? 

বাজারের বিপুল ঋণ শোধ করে আদানি বা অন্যরাও কি পারবে ‘স্বনির্ভর ভারত’-এর স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিতে?

আদানি - হিন্ডেনবার্গ সংঘাত।

আদানি - হিন্ডেনবার্গ সংঘাত। — ফাইল চিত্র।

টি এন নাইনান
টি এন নাইনান
শেষ আপডেট: ১১ মার্চ ২০২৩ ১০:০৪
Share: Save:

আদানি গোষ্ঠীর উপর ‘হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ’-এর ‘শর্ট-সেলিং’ (কোনও একটি শেয়ার বা সিকিউরিটির বাজারদর কমে যাবে ধরে নিয়ে তা বিক্রি করা) আক্রমণ এক রকমের অনিচ্ছাকৃত উপকারই করে বসেছে বলা যায়। অর্থনীতির পরিমণ্ডলে ‘ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন’ (যে সব বৃহৎ বণিকগোষ্ঠী সরকারি পরিকল্পনা ও ইনসেন্টিভের সঙ্গে তাল রেখে বিপুল বিনিয়োগের কথা ভেবে রাখে) হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে আগ্রহী গোষ্ঠীগুলি হিন্ডেনবার্গের কার্যকলাপে একটি বিষয়ে সাবধান হয়ে গেল যে, উচ্চাশা চরিতার্থ করার জন্য বিপুল ঋণ নেওয়ার আগে কী কী বিপদ ঘটতে পারে।

হিন্ডেনবার্গের ‘টার্গেট’ গৌতম আদানি গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দ্রুত ঋণ শোধ করে তাঁর গোষ্ঠীর আত্মবিশ্বাস ফেরানোর কাজে ব্যস্ত ছিলেন। বেদান্ত গোষ্ঠীর অনিল আগরওয়াল তাঁর তরফে ‘মিডিয়াম টার্ম’ (দুই থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে)-এ এক লক্ষ কোটি টাকা দিয়ে ঋণ শোধ করে হাত ধুয়ে ফেলতে চাইছেন বলে জানিয়েছেন। মুকেশ অম্বানী তিন বছর আগে ঠিক এই কাজটিই করেছিলেন, যখন বেশ কিছু ইকুইটি বিক্রি করে ১.৬ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ শোধের কাজটি সারেন। কিন্তু গৌতমের ঋণের পরিমাণ আরও অনেক বেশি, প্রায় ৩.৩৯ লক্ষ কোটি টাকা। তিনি নিজে অবশ্য অনেক কম অঙ্ক দাবি করছেন।

ঘাড় থেকে ঋণের বোঝা নামিয়ে ফেলা খুব সহজ কাজ নয়। অনিল আগরওয়াল সম্প্রতি দু’টি দস্তা উৎপাদক সংস্থাকে এক ছাতার তলায় নিয়ে এসে তাঁর নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছিলেন (তাঁর পড়ে থাকা পুঁজিকে বার করার জন্যই এই উদ্যোগ)। কিন্তু সরকার বাদ সাধায় সে কাজটি করে ওঠা সম্ভব হয়নি। এই দুই সংস্থার একটির মালিকানার ক্ষুদ্রাংশ সরকারের হাতে ছিল। গৌতম প্রতিশ্রুত শেয়ারের ভিত্তিতে নেওয়া তাঁর যাবতীয় ঋণ পরিশোধ করে উঠতে সমর্থ হলেও গোষ্ঠীর শেয়ারের দর পড়ে গিয়েছে বলে ওজর তুলে ঋণদাতারা অতিরিক্ত প্রতিশ্রুতি দাবি করছেন। সেই সুযোগে ‘সেকেন্ডারি মার্কেট’ (যেখানে বিনিয়োগকারীরা তাঁদের হাতে থাকা যাবতীয় সিকিউরিটি কেনাবেচা করেন, যা চরিত্রগত ভাবে ‘প্রাইমারি মার্কেট’ বা শেয়ার বাজারের থেকে আলাদা)-এ এক অস্ট্রেলীয় বণিকগোষ্ঠী তাদের শেয়ারের দাম বাড়িয়ে নিতে পেরেছে।

এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে, বাজারে ‘ঋণ’-কে সরিয়ে তার জায়গা নিয়েছে ইকুইটি। কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলি তাদের সুদের হার বাড়ানোয় বোঝা যায়, ইকুইটির এই নতুন ভূমিকা ‘সার্ভিসিং ডেট’ (সুদ-সহ নিয়মিত ঋণ পরিশোধ)-এর মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়েছে। এর সঙ্গে যদি বন্ডক্রেতাদের ঝুঁকি সংক্রান্ত ক্রমবর্ধমান সচেতনতাকে যুক্ত করে দেখা যায়, তা হলে বোঝা যাবে, ঋণশোধের সময় এগিয়ে এলে ইতিপুর্বে উন্মুক্ত পথগুলি বন্ধ করে ভিন্ন পথ খুঁজে সেখানে ব্যয় করার প্রবণতার জন্ম দিয়েছে। এর পরের স্তরে রয়েছে সংস্থার সুনাম বজায় রাখার বিষয়টি। ঋণশোধ অবশ্যই সংস্থার সুনাম রক্ষা করতে সাহায্য করে। বিশ্ববাজারের খেলোয়াড়রা মোটেই তাঁদের হাতে থাকা কাগজের ৩০ শতাংশ বা তার চেয়েও বেশি অবমূল্যায়ন ঘটছে, এমনটা দেখতে চাইবেন না। এই মনোবৃত্তিই তিনটি আন্তর্জাতিক ব্যাঙ্ককে এ কথা ঘোষণা করেতে বাধ্য করে যে, তারা আদানিদের কোনও নথি আর গ্রহণ করবে না। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। সুনামের বিষয়টি নিয়ে জল আরও খানিকটা গড়ায়। গৌতমের চোখের সামনেই ফরাসি শক্তি উৎপাদক সংস্থা ‘টোটাল’ তাঁর সংস্থার সঙ্গে প্রস্তাবিত এক যৌথ প্রকল্প নাকচ করে বেরিয়ে যায়।

অনেকেই মনে করতে পারবেন, এর আগের প্রজন্মে এক ঝাঁক উচ্চাভিলাষী, ঋণগ্রহণে তৎপর ব্যবসায়ী সুবিশাল সব প্রকল্প রূপায়িত করেছেন। এই সব প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল এই রকম— যাতে তা শোধ না হওয়া ঋণের সঙ্গে জড়িত থাকে এবং বাজারের ছবি বদলে গেলেও তাঁদের কুলুঙ্গির গণেশ যেন না উল্টোয়। প্রায় অর্ধ শতক ধরে যখনই ব্যাঙ্কের ব্যালান্স শিট বাজার অর্থনীতির ক্ষেত্রকে আঘাত করেছে, তখনই বৃহত্তর অর্থনীতি উল্টো দিক থেকে তার মূল্য চুকিয়েছে। এ বার সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার আগেই রাশ টানা হয়েছে। এই কারণে অন্তত হিন্ডেনবার্গের কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত যে, তাদের তোলা সব অভিযোগ সত্য না হলেও তারা যথাসময়ে কাণ্ডটি ঘটাতে পেরেছে।

এখানে আবার একটি প্রশ্ন থেকে যায়— কী ভাবে বৃহৎ উদ্যোগগুলির পুঁজি জোগাড় হবে, বিশেষত যেখানে ভারতের পরিবেশবান্ধব শক্তি উৎপাদন, সেমি কন্ডাক্টর নির্মাণ, টেলিযোগাযোগ, প্রতিরক্ষা এবং পরিবহণ পরিকাঠামোর বিষয়ে ধরে রাখা উচ্চাশা হাতে গোনা কিছু ‘ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন’দের উপর নির্ভর করে দাঁড়িয়ে রয়েছে? রিলায়েন্স এবং টাটা— দুই গোষ্ঠীর হাতেই অর্থের জোগান ভাল মতোই রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ কথা ঠিক যে গৌতমকে তাঁর বিভিন্ন শিল্পে বিনিয়োগের পরিকল্পনাগুলি পুনর্বিবেচনা করতে হবে। হিন্ডেনবার্গ পর্বের পরে তিনি বেশ কিছু বিনিয়োগ পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছেন। এখন দেখার অপেক্ষা যে, ‘ফক্সকন’-এর সঙ্গে সেমি কন্ডাক্টর প্রকল্পের ব্যাপারে গাঁটছড়া বাঁধা বেদান্ত গোষ্ঠীও কি একই ভাবে তাদের বেশ কিছু পরিকল্পনা থেকে সরে আসবে? জেএসডব্লিউ গোষ্ঠীর নগদ এবং পাওনা মিলিয়ে ঋণের পরিমাণ এক লক্ষ কোটি টাকা। পরিসংখ্যান দেখে মনে হতে পারে, এই পরিমাণ ঋণ শোধ করা সম্ভব হবে। কিন্তু আরও বেশি ঋণের সম্ভাবনা থেকেই যায়।

এই আলোচনা থেকে মনে হতে পারে, ভারত ‘ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন’দের জন্য এক প্রশস্ত জমি দাবি করে। বহু সংস্থাই তাদের ঋণ ও ইকুইটির অনুপাতের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে উন্নতি ঘটাতে পেরেছে। কিন্তু তারা কি সুবিশাল প্রকল্পগুলির বাস্তবায়ন ঘটাতে পারবে? যদি না পারে, তবে সরকারকে সরকারি ক্ষেত্রগুলির দিকেই তাকাতে হবে। এখানকার সমস্যা এই যে, বাজেটের মাধ্যমে আসা পুঁজির পরিমাণ ইতিমধ্যেই যথেষ্ট বেশি। এবং এখানে আরও বেশি পরিমাণে জনগণের টাকা বিনিয়োগের জন্য তেমন কোনও সুযোগ থাকছে না। এক যদি না অর্থনীতিতে বড়সড় কোনও উত্থান-পতন ঘটে যায়। পরিশেষে একটাই কথা বলার, কিছু পরিকল্পনার ক্ষেত্রে কিন্তু পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন থেকেই যাচ্ছে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE