E-Paper

শ্রমিক, না কি ক্রীতদাস

বহু শ্রমিক যৌন নিগ্রহের সম্মুখীন হন। অভিযোগ জানানোর উপায় নেই। কুয়েত, কাতারে মহিলা শ্রমিকরা এ ধরনের অভিযোগ করার পর উল্টে বিবাহ-বহির্ভূত যৌন সম্পর্কের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন।

রুমি গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৫:০৭

রোজ একটানা আঠারো-উনিশ ঘণ্টা কাজ, মাঝে খাওয়ার সময়টুকু ছাড়া ছুটি নেই। এ ভাবেই বছরের পর বছর কাজ করেছেন আরব মুলুকে কর্মরত অধিকাংশ পরিযায়ী শ্রমিক। বিনিময়ে যে খুব বড় অঙ্কের মজুরি মিলছে, তা-ও নয়। বরং পাওনা টাকা হাতে পান না অনেকে। কাজ ছাড়ারও উপায় নেই। কারণ কাজে ঢুকেই ‘কাফালা’-র কবলে পড়ে যান শ্রমিক। এই আইন অনুযায়ী, মালিকের অনুমতি ছাড়া তাঁর অধীনে কর্মরত কর্মীরা কাজ ছাড়তে পারবেন না।

এ বছর সৌদি আরবে বাতিল হল প্রাচীন এই কাফালা ব্যবস্থা। ‘কাফালা’ অর্থাৎ পৃষ্ঠপোষক বা নিয়োগকর্তার তত্ত্বাবধান। গত শতাব্দীর বিশের দশক থেকে আরব দেশগুলোতে অন্য দেশ থেকে শ্রমিক আসা শুরু। স্থানীয় কোনও ব্যক্তি (কাফিল) তাঁদের দেখাশোনা করতেন। ক্রমে তেলের ব্যবসা বাড়লে শ্রমিকও বাড়ল। মিশরের শ্রমিকদের জায়গা নিল দক্ষিণ এশিয়া আর আফ্রিকার মানুষ। ভিন দেশের শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণের জন্য কাফালা ব্যবস্থায় পৃষ্ঠপোষকদের ক্ষমতা বাড়ল। শ্রমিকের সুরক্ষার ব্যবস্থা রূপান্তরিত হল শোষণের যন্ত্রে।

কেবল সৌদি আরব নয়। কুয়েত, ওমান, কাতার, বাহরিন, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, জর্ডন, লেবাননেও এই ব্যবস্থা চলত। পরিকাঠামো নির্মাণ, গৃহসহায়ক, স্বাস্থ্য-সহ অন্যান্য পরিবেষার কাজে আসা শ্রমিকরা কাফালার কবলে পড়ে যেতেন। তাঁরা আসতেন নিজের দেশের কোনও এজেন্সি মারফত, ভিসার অর্থ দিতেন নিয়োগকারী (স্পনসর)। এর পর শ্রমিকদের পাসপোর্ট নিজের হাতে নিয়ে নিয়োগকর্তা তাঁদের জীবনের নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়াতেন। শ্রমিকরা কোথায় থাকবেন, কী করবেন, কবে দেশে ফিরবেন, আদৌ ফিরতে পারবেন কি না, সবই মালিকের মর্জি।

বাংলাদেশের মেয়ে আসমা ওমানে একটি পরিবারে গৃহসহায়কের কাজে গিয়েছিলেন। চার তলা বাড়িতে কুড়িটি ঘর, ১৫ জন সদস্য। ভোর চারটেয় যে কাজ শুরু হত, তা শেষ হত রাত একটায়। বছর দেড়েক পর আসমা অব্যাহতি চাইলে, নিয়োগকর্তা তাঁকে ৪০০০ আমেরিকান ডলার ফেরত দিতে বলেন। এই অর্থ দিয়েই তিনি নিয়োগকারী সংস্থা থেকে আসমাকে এনেছিলেন। অধিকাংশ নিয়োগকারী এজেন্সি থেকে শ্রমিকদের যে অর্থের বিনিময়ে নিয়ে আসেন, সেটা পরে শ্রমিকদের ঘাড়েই চাপিয়ে দেন। তা ফেরত দিতে না পারলে জোর করে আটকে রাখা হয়।

এক সমীক্ষায় ওমানে কর্মরত ৫৯ জন মহিলা-শ্রমিক জানিয়েছিলেন নিজেদের নিগ্রহের কাহিনি। তানজ়ানিয়ার মেয়ে হানা জানিয়েছিলেন, কাজে যোগ দেওয়ার পর তাঁর ফোনটা কেড়ে নিয়েছিলেন মালিক। বাইরের জগতের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ ছিল না। বাড়ির লোক এক সময় ধরেই নিয়েছিলেন, তিনি মরে গিয়েছেন। মালিকের ভাই কয়েক বার তাঁকে ধর্ষণও করে।

বহু শ্রমিক যৌন নিগ্রহের সম্মুখীন হন। অভিযোগ জানানোর উপায় নেই। কুয়েত, কাতারে মহিলা শ্রমিকরা এ ধরনের অভিযোগ করার পর উল্টে বিবাহ-বহির্ভূত যৌন সম্পর্কের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন। সৌদি আরবে কাজ করতে গিয়ে ইথিয়োপিয়ার সইফা নিয়মিত যৌন নিগ্রহের শিকার হন। আড়াই বছর কাজের পর কোনও পারিশ্রমিক তো জোটেইনি, উল্টে চুক্তি খেলাপের অভিযোগে জরিমানা হয়। টাকা ধার করে তা শোধ দিয়ে শারীরিক ও মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত সইফা শূন্য হাতে ঘরে ফিরেছিলেন। বাংলাদেশি পরিচারিকা পারভিনের নিত্য সঙ্গী ছিল দুর্ব্যবহার। পুলিশের সাহায্য চাওয়ায় মালিক তাঁকে ঘরে আটকে রেখেছিলেন।

জোর করে শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানোর নজির বিশ্বের অন্যত্রও আছে। কিন্তু কাফালার মতো কঠোর বিধি কমই ছিল। আরবের প্রায় কোনও দেশই নজর রাখত না সে দেশে আসা পরিযায়ী শ্রমিকদের হাল-হকিকতের উপর। তা সত্ত্বেও রোজগারের আশায় বিশ্বের গরিব দেশগুলো থেকে শ্রমিকরা ক্রমাগত এসেছেন এ সব দেশে। কুয়েত, সৌদি আরব, এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহি বিশ্বের প্রথম দশটি ‘রেমিট্যান্স’ দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে। দাসত্ব করেও শ্রমিকরা টাকা পাঠান বাড়িতে।

‘ভিশন ২০৩০’-এর জন্য যে সব আইনি সংস্কার করছেন সৌদির বর্তমান যুবরাজ মহম্মদ বিন সলমন, কাফালা বাতিল করাকে তারই অঙ্গ মনে করা হচ্ছে। এতে অন্তত দেড় কোটি পরিযায়ী শ্রমিক উপকৃত হবেন। ‘স্পনসরশিপ’ ব্যবস্থা তুলে দেওয়ায় নিয়োগকারীর ক্ষমতা কমবে। অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে শ্রমিকদের সঙ্গে চুক্তি হবে। তাতে কাজের সময় নির্দিষ্ট থাকবে। চুক্তির সময়ের শেষে শ্রমিকরা স্বাধীন ভাবে কাজ খুঁজে নিতে পারবেন।

বিশ্ব জুড়ে প্রতিবাদের জেরে সৌদির আগে অনেক দেশ এ পথে হেঁটেছে। বাহরিন (২০০৯), সংযুক্ত আরব আমিরশাহি (২০১৬) সংস্কারের মাধ্যমে কাফালা ব্যবস্থাকে শিথিল করেছে। বিশ্বকাপের প্রস্তুতিতে প্রবল গরমে পরিকাঠামো নির্মাণ করতে গিয়ে কাতারে কয়েক বছরে সাড়ে ছ’হাজার পরিযায়ী শ্রমিক মারা যান। অবশেষে, ২০২০-র সেপ্টেম্বরে কাতার কাফালা তুলে দেয়।

তবে আইন বাতিল করলেই শ্রমিক নিগ্রহের অভ্যাস বদলাবে, এমন নয়। বিশেষত ব্যক্তিগত নিয়োগ বা অসাংগঠনিক ক্ষেত্রে নতুন আইন সহজে কার্যকর হবে, এমন আশা করা চলে না। কাফালা-বিরোধী আন্দোলনের দিন শেষ হয়নি।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Workers Kafala system Migrant Labours Saudia Arabia

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy