শীতকাল আহারের বাহারের কাল। বাজারে আনাজপাতির দিকে তাকালেই রঙের ছটা। সবুজ-লাল-সাদা তার আবার কত রকম গাঢ়-ফিকে। রসিক বিক্রেতারা রকমারি বাংলায় হাঁক দিচ্ছেন। রসিকতর বাঙালি বাজারু ঢলঢলে বেগুনের দিকে তাকিয়ে বিক্রেতাকে দমিয়ে দেওয়ার জন্য বলছেন, “পোকা বেগুন কত করে?” বিক্রেতাও কম যান না। একগাল হেসে বলছেন, “আমার বেগুন অমূল্য, তবে আজকে বেগুনের ভরি সোনার থেকে কম।”
অন্য অনেক হাটের মতোই শেওড়াফুলির হাট চেয়ে দেখার। সেই সাহেবি আমল থেকে নামডাক। শ্রীরামপুরে গঙ্গার ধারে কেরি সাহেবদের স্থাপত্য, ছাপাখানা আর পরে কলেজিয়ানা। পাশের শেওড়াফুলিতে হাটের বাহার। সেখানে নিমাইতীর্থের ঘাট, বৈষ্ণব পাট। বাজার ভাল না হলে কি বৈষ্ণবতার সেবা চলে! হাটে-বাজারের চাষি-ব্যাপারিরা মঠে তাঁদের সদ্য ফসলটি নিবেদন করে তবে বিকিকিনির দিকে যান, অন্তত অনেক দিন পর্যন্ত তো তাই যেতেন। কাল পরিবর্তনশীল ও নিষ্ঠুর। বোলবোলাও সমান থাকে না। তবে নদীর ধারাটি তলায়-তলায় ঠিকই থেকে যায়। নিরামিষ বৈষ্ণবতা বহে রে।
সত্যি কথা হল বাঙালির নিরামিষ রান্নায় বৈচিত্রের আদি-অবধি নেই। সে রান্নার শুরু কুটনো কাটা থেকে। ঝোলের আলু আধখানা চাঁদের মতো, কোপ্তা-কালিয়ার আলু ডুমো-ডুমো। সব্জির আবার বাহির ভিতর দুই কাজে লাগে। লাউয়ের খোসা জিরিজিরি করে কেটে ভাজা-ভাজা করলে প্রথম পাতে অমৃত। আর কচি লাউ, চিংড়ি ছাড়াও, বড়ির সাহচর্যে অপূর্ব। কুটনোটি ঠিকমতো হওয়া চাই। কচি লাউ খুব কুঁচোলে গলে পিণ্ডি পাকাবে। রান্না হবে সুসিদ্ধ, মাখো-মাখো কিন্তু অস্তিত্বটি বজায় থাকবে। তবে না! মিলমিশও চাই আবার স্বাতন্ত্র্যও বজায় থাকবে। বাঙালি মায়েরা তো বৈষ্ণবতার রান্নাঘরখানিকে দুই হাতে লালন-পালন করেছেন। শুধু লালন-পালনই করেননি, নিজের মতো কত কিছু উদ্ভাবন করেছেন। সেই লালন-পালনের জন্যই তো বাঙালির গৃহ অর্থনীতি বেঁচেবর্তে ছিল। বাবার রোজগারের টাকা আর কত! মাসের মাঝামাঝি টান পড়ত। আর তখনই মায়েরা বৈচিত্রময় নিরামিষের পসরা খুলে বসতেন। কমপয়সায় হয়ে যায় এমন সুস্বাদু নিরামিষ পাতের আস্বাদ। তাই দিয়ে বেশ অনেকটা ভাত উঠে যেত।
ছিল ভাতে আর শাকান্ন। ভাতের উপাদানটি দামি নয় কিন্তু মাখার গুণে অমৃত। বিশেষ করে তেল আর লঙ্কার ব্যবহার তাকে অমৃতোপম করে তোলে। উপরে কতটা কাঁচা তেল ছড়াতে হবে সেই মাত্রাবোধটি থাকা চাই। মাত্রার গুণেই তো পাতের রান্না কমেডি কিংবা ট্র্যাজেডি! শাকের ক্ষেত্রে জানা চাই কোন অংশ খাদ্য আর কোন অংশ বর্জ্য। জানা চাই সেদ্ধ করে পুরোপুরি জল ফেলা হবে, না কি রেখে দেওয়া হবে একটুখানি। পূর্ববঙ্গ থেকে এই বঙ্গে চলে আসা মানেই তো দেশভাগ পরবর্তী চলাচল নয়, তার আগের গল্প আছে, সে গল্প দেওয়া-নেওয়ার। পূর্ববঙ্গের নদীমাতৃক ভূ-ভাগে কত রকম শাক, শাকান্ন শব্দটি কি আর এমনি এমনি হয়েছে! সেই শাকান্ন বড় বৈচিত্রময়। এ বঙ্গেও শাকের আঁটি কিছু কম নয়। বিভূতিভূষণের দেখা গ্রামের দারিদ্র শাক দিয়ে ঢাকা।
বাঙালি মধ্যবিত্তের বাড়িতে যে গোয়ালা বাঁধা ছিল, তাঁর সঙ্গে গিন্নি মায়ের আদান-প্রদান বড় মধুর। দুধে জল কতটা কথা তাই নিয়ে। বিশেষ করে বাড়িতে যে দিন পায়েস হবে তার কয়েকদিন আগে থেকে সতর্কতা জারি হত। পাটালি উঠেছে। এ বার পায়েসের আঁচ পড়বে। দুধটি ভাল হওয়া চাই। “শোনো আজ দুধে জল যা দিয়েছ দিয়েছ, সে দিন তো কয়েক সের বেশি দুধ এমনিতেই দেবে। জল যেন বেশি মিশিয়ো না।” দুধওয়ালাও স্বীকার করবেন না, গিন্নিমাও স্বীকার করাবেন। সে এক লম্বা কথামন্থন। বাঙালির পাতে নিরামিষ বলতে পনির আর কবে ছিল! ছিল ছানার ডালনা। পনিরের মতো কঠিন হৃদয় ছুরি দিয়ে কাটা জ্যামিতিক অবয়বের অধিকারী ডালনার ছানারা ছিল না। তাদের শরীর লাবণ্যময়, রসালো। লেবু দিয়ে ছানা কাটিয়ে একটু ময়দা দিয়ে মেখে বড়া ভেজে তোলা হত। তার পর তারা পড়ত রসালো ঝোলে। লাবণ্যময় সেই ছানার ডালনা ঘরযোগে রান্না হলে আলুর সাহচর্য পেত। ছানার ডালনায় আলু দেওয়ার আর এক কারণও ছিল। দুধের দামের থেকে আলুর দাম কম। দুধ তো অনেক কেনার সামর্থ্য নেই। তাই আলুর ভেজাল। মাথাপিছু ক’টা ছানার বড়া তা গোনা আছে। সঙ্গে আলু থাকলে তরকারিটি বড় হয়। আয় দেয়। মাসের শেষ সপ্তাহে পাঁপড়ের ডালনা করাই রীতি, তা আরও সাশ্রয়ী।
প্রকৃতপক্ষে হিন্দু-বাঙালির সাত দিনে সচরাচর ভোজন বিলাসে আমিষ-নিরামিষের অলিখিত একটা ভাগ ছিল। বিষ্যুত আর শনি নিরামিষ। বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীপুজো আর শনি বারের ঠাকুর। তাঁর খরদৃষ্টি নিরামিষে ঠেকান দেওয়া চলে। বাকি দিনগুলি আমিষ। বাঙালির আমিষ আর নিরামিষে কলহ ছিল না। যে মা নিরামিষে সিদ্ধহস্ত, তিনি আমিষেও দশভুজা। নিরামিষে তিনি যেমন টাকা বাঁচান, আমিষেও তেমন টাকার সাশ্রয়ের পথ খুঁজে নেন। গোটা ডিমের সাধ্য না থাকলে ডিমের অমলেটের ঝোল। তিনটে ডিমের অমলেট ছ’-টুকরো করে আলু দিয়ে কষে রান্না করে দিব্য চালিয়ে দেওয়া যায়। আধখানা ডিম খাচ্ছি অমলেটের ঝোলে এই হীনম্মন্যতার বোধও জেগে ওঠে না। ঝোলে ভাসমান অমলেট তার আধখানা চেহারাতেই গোটা। শরীরে পেঁয়াজ আর লঙ্কার সহযোগ। রবিবারে পাঁঠার মাংসের স্নিগ্ধ ঝোল আর মাংসের আলু দুপুরের ঘুমের মতো মনোহরণকারী।
এই যে আমিষ ও নিরামিষের সহাবস্থান বাঙালির রান্নাঘরে ছিল তার আদি কারণ বাঙালির শাক্ত আর বৈষ্ণব কেবল কলহ করত না, তারা মিলেমিশে গিয়েছিল। শাক্তপদাবলিমোদী বাঙালির কানে বাজে “মন করো না দ্বেষাদ্বেষি/ ... সকল আমার এলোকেশী।।/ শিবরূপে ধর শিঙ্গা, কৃষ্ণরূপে বাজাও বাঁশী/ ওমা রামরূপে ধর ধনু, কালী রূপে করে অসি।” এই গানের বাঙালি আমিষ নিরামিষের হেতুহীন লড়াই কোন দুঃখে করবে! খাওয়া আর হাসি এই নিয়ে বাঙালি জীবন। নিরামিষসেবী বৈষ্ণব আমিষ খেতে চাইলে মাঝে মাঝে অবতার সেবা করে আসতেন। মৎস্য তাঁর অবতার। সুতরাং একটু মাছের ঝোল খেলে দোষ হবে কেন! বাঙালি বাড়িতে বিধবা পিসিমারা অনেক সময় বড় যত্নে সন্তানসম ভাইপো-ভাইঝিদের জন্য মাংস রাঁধতেন। নিজে খান না তো কী হয়েছে, ওরা খাচ্ছে তাই দেখেই সুখ। বাঙালি খাদ্য সংস্কৃতির বৈচিত্রময় ঐক্য রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ধর্মবোধে সদা জাগ্রত। ঠাকুর রসে-বশে থাকার কথা বলতেন।
আর বিশ্বচারী বিবেকানন্দ? শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্ত্তীর কথার জবাবে জানিয়েছিলেন বিদেশে সব রকম খেতেন। তাঁর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য নামের ভ্রমণকাহিনি পড়লে বোঝা যাবে তিনি কী গভীর খাদ্যরসিক। সেখানে পরিষ্কার লিখেছেন যাঁরা ধর্মজীবন বা আধ্যাত্মিকজীবন যাপন করতে চান তাঁদের কথা আলাদা, তা বাদ দিয়ে কর্মযোগীরা, খেটে-খাওয়া মানুষেরা কেন নিরামিষমুখী হবেন? বাঙালি জানত কৃষ্ণচরিত্র, গীতাভাষ্য এই সবের রচয়িতা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় খাদ্যরসিক ছিলেন। বন্দে মাতরম্ প্রণেতা খাদ্যরসিক না হলে কখনও ‘আমার মন’ নামের রসাত্মক গদ্য লিখতে পারতেন না। সেখানে কমলাকান্তের মন চুরি হয়েছিল। মন কোথায় গেল? বঙ্কিম লিখেছিলেন, “যেখানে ছাগ-নন্দন, দ্বিতীয় দধীচির ন্যায়, পরোপকারার্থ আপন অস্থি সমর্পণ করেন, যেখানে মাংসযুক্ত সেই অস্থিতে কোরমা রূপ বজ্র নির্ম্মিত হইয়া, ক্ষুধারূপ বৃত্রাসুর বধের জন্য প্রস্তুত থাকে, আমার মন সেইখানেই...।”
বাঙালি মায়ের আঁচলটি বড়। রান্না করতে করতে মায়েরা আঁচলে হাত মুছতেন। নরম আঁচলটিতে আমিষ ও নিরামিষ ব্যঞ্জনের দাগ লেগে যেত। রান্না করা শাড়িটি ছেড়ে তাঁরা দুপুরের স্নানে যেতেন। দুপুর রোদে সেই শাড়িটি কেচে-ধুয়ে শুকোতে দেওয়া হত। তাতে এসে লাগত আলোবাতাস। সেই আলোবাতাস মেখে যখন শুকিয়ে যেত অমলিন শাড়িটি তখন ভাঁজ করে রাখতেন পড়ন্ত বিকেলে, সন্ধে দেওয়ার সময় হত। এই নিত্যদিনের যে বাঙালি জীবন, তাতে আমিষ-নিরামিষের লড়াই ছিল না। বাবা অফিস ফেরতা লক্ষ্মীপুজোর ফুল নিয়ে আসতেন, আবার রবিবার সকালে পাঁঠার মাংসের দোকানে লাইন দিতেন। এর মধ্যে কোনও বিরোধ ছিল না। পুজোর ফুলের থলে আর মাংসের ব্যাগ দুই দেওয়ালের পেরেকে নির্বিবাদে ঝুলত।
উত্তর ভারতের বৈচিত্রহীন নিরামিষের উটকো হাওয়া পশ্চিমবঙ্গের ময়দানে এসে তাদের স্থানচ্যুত করতে পারবে বলে মনে হয় না। বঙ্কিমচন্দ্র, বিবেকানন্দের দোহাই!
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)