বিহারের বিধানসভা নির্বাচনের সবচেয়ে কেন্দ্রীয় প্রশ্ন যে জাতপাত-ভিত্তিক পরিচিতি, তা সংশয়াতীত। ক্ষমতাসীন জেডি(ইউ)-বিজেপি’র নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট যেমন, ঠিক তেমনই আরজেডি-কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন মহাগঠবন্ধনও তাদের নির্বাচনী কৌশলের কেন্দ্রে রেখেছে জাতপাতের অঙ্ককে। প্রশান্ত কিশোরের জন সুরাজ পার্টি অন্তত আপাতদৃষ্টিতে খানিক আলাদা অবস্থান নিয়েছে। বিহারের রাজনীতির ক্ষেত্রে এটা ঝুঁকি, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু, এর মাধ্যমে রাজনীতির দিক পরিবর্তনের যে বার্তা প্রশান্ত দিতে চাইছেন, সেটাও স্পষ্ট। যেমন, তাঁর দলের প্রচারে গুরুত্ব পেয়েছে ভূমি সংস্কারের প্রশ্নটি। ঐতিহাসিক ভাবে এই প্রশ্নের উপরে দাবি সবচেয়ে বেশি বামপন্থী রাজনীতির। কিন্তু, বিহারে বামপন্থীদের সমর্থনপুষ্ট ইন্ডিয়া জোট কতটা বলছে ভূমি সংস্কারের কথা? উত্তরটি জোটের প্রচার থেকে স্পষ্ট।
বিহার ভারতের দরিদ্রতম রাজ্যগুলির একটি। ফলে, সাম্প্রতিক কালে গোটা দেশেই তথাকথিত জনমুখী প্রকল্পের যে রাজনৈতিক সাফল্য চোখে পড়ছে, এবং বিহারের দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জোট এই নির্বাচনেও যে পথে হাঁটছে, তা কার্যত স্বতঃসিদ্ধ। প্রশান্ত কিশোর সেখানেও একটু পৃথক অবস্থান নিয়েছেন। তাঁর প্রতিশ্রুতিতে ভাতা একেবারেই অনুপস্থিত, তা নয়— প্রবীণ নাগরিকদের জন্য পেনশনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে জন সুরাজ পার্টি। কিন্তু, প্রশান্ত নির্বাচনী লড়াইতে যে বিষয়গুলির উপরে জোর দিয়েছেন, সেগুলি বিহারের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন সংক্রান্ত, নিতান্ত ভোটমুখী নয়। যে বিষয়গুলি দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত না হলেও চটজলদি ভোট আনতে পারে, সেগুলিকে ব্যবহার না করে প্রশান্ত কিশোর যে গভীরতর উন্নয়নের বার্তা দিচ্ছেন, সেইখানেই জাতপাতের রাজনীতিকে অতিক্রম করে বিহার নির্বাচনে উন্নয়নমুখী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভাবনার কথা আসছে। বিহারের মতো পশ্চাৎপদ রাজ্যে সেই অতি সীমিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে কেন্দ্র করে নির্বাচনী রণকৌশল তৈরি করা হলে সাফল্য অর্জন করা সম্ভব কি না, সে প্রশ্নের উত্তর দেবে ভোটের ফলাফল। কিন্তু, প্রশান্তের ব্যতিক্রমী রণকৌশলের দ্বিতীয় ধাপ এটিই।
ক্ষমতায় এলে বিহারে একশো জন চরম দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষকে দ্রুত আইনের আওতায় আনার কথা বলেছে জন সুরাজ। বিহারের রাজনীতিতে তার গুরুত্ব কতটুকু? বাম দলগুলি পশ্চিমবঙ্গে দুর্নীতি বা দুর্বৃত্তায়নের কথা বলছে তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে, এ দিকে বিহারে তাদের আরজেডি-কে নিয়ে সে সমস্যা নেই। অন্য দিকে, গোটা দেশে এমন বহু উদাহরণ আছে, যেখানে ভাতাবাদের ইতিবাচক প্রভাব দুর্নীতির নেতিবাচক অঙ্ককে পুরোপুরি ঢেকে দিতে পারে। খেয়াল করে দেখার যে, দুর্নীতির প্রশ্নটি মূলত মধ্যবিত্তের প্রশ্ন। প্রশান্ত কিশোরের রাজনীতি যে মধ্যবিত্ত ভোটব্যাঙ্কটিকে ধরতে চাইছে, এটি তার আরও একটি ইঙ্গিত। আবার, প্রশান্ত শিক্ষার কথা বলছেন অনেক গুরুত্ব দিয়ে, যা মূলত মধ্যবিত্ত আকাঙ্ক্ষাকে ছুঁয়ে যায়— বা, মধ্যবিত্ত হতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে। যদিও আজকের ভোট-রাজনীতিতে বিষয় হিসাবে শিক্ষার গুরুত্ব খুব বেশি নয়।
জন সুরাজ অভিযান দিয়ে এই রাজনৈতিক ভাবনার শুরু। তিন বছর আগে গান্ধীজয়ন্তীতে তিনি রাজ্যব্যাপী পদযাত্রা শুরু করেন, চম্পারণের গান্ধী আশ্রম থেকে। গত বছর একই দিনে রাজনৈতিক দল হিসাবে জন সুরাজের আত্মপ্রকাশ। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতের সবচেয়ে সুপরিচিত ভোট কৌশলী প্রশান্ত। কোনও মতাদর্শ বিচার না করেই তিনি একাধিক প্রথম সারির রাজনৈতিক দলকে পেশাদারি পরামর্শ দিয়েছেন। মোটের উপরে তাঁর সংস্থা বেশ সফলও বটে। অন্য দিকে, তথ্যভিত্তিক অতীত উদাহরণে স্পষ্ট যে, জাতপাতের খেলা খেলতে পারলে, দুর্নীতিকে ধামাচাপা দিয়ে রেখে দিলে, সামগ্রিক ভাবে ভাতার প্রতিশ্রুতি দিলে ভোট বাড়ে। তা সত্ত্বেও প্রশান্ত কিশোর অন্য ভাবে সাজিয়েছেন তাঁর নির্বাচনী রাজনৈতিক কৌশল। তা হলে কি তিনি বিহারে গত তিন বছর ধরে অন্য কোনও তথ্য খুঁজে পেয়েছেন?
তিনি একাধিক বার বলেছেন যে, এই নির্বাচনে দেড়শোর কম আসন পাওয়া মানেই তাঁর দলের পরাজয়। গত বছরের বিহার উপনির্বাচনে চারটি আসনের ফল বিশ্লেষণ করে দেখলে আদৌ আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। অর্থাৎ, তাঁর প্রচার যদি ২০২২ সাল থেকে ধরা হয়, তা হলে সেই সূচনার দু’বছর পরে, ২০২৪-এ চারটি আসনের উপনির্বাচনে গড়ে ১০ শতাংশের চেয়ে খুব বেশি ভোট পায়নি তাঁর দল। পরের এক বছরে পরিস্থিতি কতখানি বদলেছে? সাধারণ হিসাব বলে যে, তাঁর ঝুলিতে হয়তো আসবে বড় জোর ১০ শতাংশ ভোট, আর অল্প কয়েকটি আসন। হয়তো কিছু আসনে তাঁর দল ভোট কাটায় দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর ফলাফলে তার প্রভাবও পড়তে পারে। কিন্তু, ত্রিমুখী লড়াইয়ে ৩০ শতাংশের আশেপাশে ভোট পেয়ে তিনি ক্ষমতা দখল করবেন, সে সম্ভাবনা সুদূরপরাহত।
সেই ‘অসম্ভব’ সম্ভাবনা নিয়েই কিছু কথা বলা যাক। ভারতের বর্তমান আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় মধ্যবিত্ত বেশ গোলমেলে পরিস্থিতিতে। গোটা দেশে একটা আবছা উন্নয়ন যে আছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু বিহার বা পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক প্রভাব এখন অতি ক্ষীণ। সেই জায়গায় এ বার বিহারে হঠাৎ করে পরিবর্তন হতে পারে এই পথে? এখানেই বিহারের একটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করতে হয়— রাজ্যের একাংশের মধ্যে লেখাপড়ায় খুব ভাল করার প্রচেষ্টা চিরকালই ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলির প্রশিক্ষণ দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তে পৌঁছে গেছে। ফলে এক বড় অংশের অল্পবয়সি কিন্তু নিম্নবিত্ত ছেলেমেয়ের কাছে ভবিষ্যতের স্বপ্ন পৌঁছতে খুব সময় লাগছে না। তারা যদি জন সুরাজের প্রচারে প্রভাবিত হয়, সে ক্ষেত্রে তাদের অভিভাবকেরাও সেই স্বপ্নের অংশীদার হতে পারেন। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রে এখন একেবারেই উৎসাহ নেই নিম্নবিত্ত পড়ুয়াদের। স্নাতক স্তরে ভাল ফল করার তুলনায় পাড়ায় তৃণমূলের নেতা হওয়া অনেক সহজ, এবং তাতে জীবনযাত্রার মান উন্নততর হওয়ার সম্ভাবনা। ফলে রাত জেগে বাঙালি নিম্নবিত্ত লেখাপড়া করবে, এবং তার পর শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তার হবে, তৃণমূল আমলে এই স্বপ্নের সলিলসমাধি ঘটেছে। কিন্তু বিহার কি উল্টো পথ খুঁজছে?
বিহারে নির্বাচনী হিংসা গত দশকে প্রায় শূন্য। লালুপ্রসাদ যাদবের আমলের দুর্নীতি এবং দুর্বৃত্তায়নের অভিযোগ থেকেও অনেকটা বেরিয়ে এসেছে নীতীশের বিহার। অর্থাৎ, তাদের পথ হাঁটাটা মধ্যবিত্ত হওয়ার স্বপ্নের ক্ষেত্রে কিছুটা ইতিবাচক রাস্তায় আছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নবিত্তের বিহার থেকে পরিবর্তনের যদি এতটুকু আশা থেকে থাকে, সেই আশার বাহন হিসাবে নিজেদের পেশ করতে চাইছে জন সুরাজ— যারা প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে, এক অর্থে আম আদমি পার্টির মতো। শহুরে দিল্লির তুলনায় গ্রামীণ বিহারে প্রভাব হয়তো কম পড়বে, কিন্তু ঠিক সেই জায়গাতেই বাজি ধরেছেন প্রশান্ত। ধরতে চাইছেন সেইজনগোষ্ঠীকে, যারা জাতপাতের চিরাচরিত অঙ্ক, ভিন রাজ্যে গায়েগতরে খাটতে যাওয়ার ভবিতব্য, অথবা ভাতার উপরে নির্ভরশীল জীবন ছেড়ে বেরোনোর পথ খুঁজছে।
এমন একটি ব্যবস্থার কথা ভাবছে, সেখানে সরকারি ব্যবস্থায় ভাল স্কুলে ছেলেমেয়ে পড়তে যাবে, যেখানে কৃষিক্ষেত্রে পথ দেখাবে ভূমিসংস্কার, যেখানে জাতপাত নিয়ে মানুষের ভাবার সময় কম, যেখানে ঋণ নিয়ে শিল্পোদ্যোগী হওয়ার উৎসাহ আছে মানুষের। জন সুরাজের প্রার্থী তালিকায় তাই বাহুবলীদের বদলে শিক্ষিত এবং সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত মানুষের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো।
আম আদমি পার্টির সঙ্গে জন সুরাজ পার্টির মূলগত পার্থক্য হল, এখানে প্রশান্ত কিশোর কিন্তু ইতিমধ্যেই মধ্যবিত্ত বা অন্তত নিম্ন মধ্যবিত্তের সামাজিক কক্ষপথে ঠাঁই পাওয়া মানুষদের কথা বলছেন না। তাঁর লক্ষ্য সেই জনগোষ্ঠী, যাঁরা এই কক্ষপথে পৌঁছতে চায়। উচ্চাকাঙ্ক্ষার ধাপটি এখানে আলাদা, এবং সেই কারণেই এই মডেলের দিকে চোখ থাকবে গোটা দেশের। কতখানি সাফল্য অর্জন করতে পারে রাজনীতির এই নতুন ব্র্যান্ড পজ়িশনিং, তা হয়তো ভারতীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ পথনির্দেশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)