E-Paper

মেয়েদের চোখে এই সফর

মুত্তাকি ভারত সফর শুরু করলেন তাজমহল দর্শন করে, যা সারা বিশ্বে প্রেমের সৌধ বলে বিখ্যাত, যার নাম এক মোগল সম্রাজ্ঞীর নামে। তা বলে আফগানিস্তানে মেয়েদের অবস্থায় উন্নতি আনার কোনও অঙ্গীকার তিনি করেননি।

নীলোভা রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০২৫ ০৫:৩৪

সম্প্রতি তালিবানের বিদেশমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি ভারত সরকারের আমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে এসে যে সাংবাদিক বৈঠক করলেন, তা থেকে সম্পূর্ণ বাদ রাখা হল মেয়েদের। সারা দেশে তুমুল ক্ষোভ দেখা দিতে মুত্তাকি আরও একটি সাংবাদিক বৈঠক করলেন, যেখানে মহিলা সাংবাদিকদেরও আমন্ত্রণ করা হল।

মুত্তাকির এই সফরের জন্য ভারত বিশেষ ছাড়ের আবেদন করেছিল রাষ্ট্রপুঞ্জের কাছে। কারণ, ১৯৮৮ সালে নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত একটি প্রস্তাব অনুসারে অধিকাংশ তালিবান-সংযুক্ত ব্যক্তির আন্তর্জাতিক সফর নিষিদ্ধ। এর ব্যতিক্রম হতে পারে কেবল যদি নিরাপত্তা পরিষদের সব সদস্য তাতে একমত হন। প্রসঙ্গত, তালিবান সরকারকে এখনও ভারত সরকারি ভাবে স্বীকৃতি দেয়নি, তবে নানা ভাবে সমর্থন করে চলেছে এই নারীবিদ্বেষী শাসনকে। সম্প্রতি কাবুলে ভারত সরকারের ‘মিশন’ উন্নত করা হয়েছে দূতাবাসে। নয়াদিল্লির আফগান দূতাবাসে রয়েছেন তালিবান-নিযুক্ত আধিকারিকরা।

আফগানিস্তানের মেয়েরা এই সফরকে কী ভাবে দেখছেন? তাঁদের চোখে নয়াদিল্লির এই সিদ্ধান্ত মানবিক মূল্যবোধের সঙ্গে বড় মাপের আপস। তালিবানের নির্দেশে মেয়েরা তাঁদের মৌলিক মানবাধিকারও হারিয়েছেন। কাজের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, একত্র সম্মিলিত হওয়ার অধিকার, কিছুই নেই তাঁদের। মেয়েদের মুখহীন, কণ্ঠহীন অবয়বে পরিণত করা হয়েছে। ভারতে অনেকেই হয়তো জানেন না, আফগান বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে মেয়েদের লেখা বইও নিষিদ্ধ হয়েছে।

এ বছরের গোড়ার দিকে যখন রাশিয়া সরকারি ভাবে তালিবান শাসনকে স্বীকৃতি দিল, তখনও যেন আফগান মেয়েদের মধ্যে এত তিক্ততা দেখা দেয়নি, যতটা দেখা দিয়েছে এই মৌলবাদী শাসকদের সঙ্গে ভারতের হাত মেলানোর প্রচেষ্টা দেখে। তালিবান দ্বিতীয় বার কাবুল দখল করায় যে মেয়েরা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, তাঁদের অনেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।

এমন এক মহিলা (নিরাপত্তার কারণে যাঁর নাম প্রকাশ করা যাবে না) এখন রয়েছেন পশ্চিমের একটি দেশে। তিনি জানান, তালিবান ক্ষমতায় আসতে প্রাণ বাঁচাতে তিনি ভিসার আবেদন করেছিলেন ভারতের দূতাবাসে। ভারত সরকার তা মঞ্জুর করেনি। “যারা আমার জীবনের ঝুঁকি তৈরি করেছিল, আজ তাদেরই এক জনকে অভ্যর্থনা করছে ভারত,” বলেন তিনি।

আরও এক মহিলার সঙ্গে কথা হল, যিনি একটি অনলাইন সংবাদপত্রের প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মানবাধিকার এবং নারীঅধিকার বিষয়ে তাঁর লেখার জন্য একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। পুরস্কার নেওয়ার জন্য ভারতে আসার ভিসা মঞ্জুর করা হয়নি। উল্টে বিষয়টি তালিবান সরকারের নজরে পড়ে যাওয়ায় তাঁর উপর নজরদারি চলছে। “সম্পূর্ণ বৈধ কারণে এক জন আফগান নাগরিককে ভারত সফরের অনুমতি না দেওয়াটা আমার মনে হয়েছে অন্যায়, নির্মম।”

ভারত কিন্তু প্রথম তালিবান সরকারের (১৯৯৬-২০০১) সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের কোনও চেষ্টাই করেনি। বরং সক্রিয় ভাবে বিরোধিতা করেছে। আহমদ শাহ মাসুদের নেতৃত্বে তালিবান-বিরোধী ‘নর্দার্ন অ্যালায়েন্স’ জোটকে পরোক্ষ মদত জুগিয়েছে ভারত। সেই সময়ে আফগানিস্তানের পরিস্থিতির উপর আন্তর্জাতিক মহলের তীক্ষ্ণ নজরদারি এবং সমালোচনা আফগান মেয়েদের অন্তত কিছুটা সহায়তা করেছিল, তালিবানের নারী-নিপীড়নের মোকাবিলায়। তুলনায়, দ্বিতীয় তালিবান সরকারের প্রতি তেমন জোরালো বিরোধিতা দেখাই যাচ্ছে না। চার বছর পার করেও রাষ্ট্রের উপর তালিবানের দখল অটুট, প্রতিদ্বন্দ্বী কোনও শক্তিও সে ভাবে জেগে ওঠেনি। অন্যান্য দেশের চেষ্টা কিছুমাত্র নমনীয়তা আনতে পারেনি তালিবান শাসনে। মেয়েদের উপরে তাদের অমানবিক বিধিনিষেধ সম্পূর্ণ বহাল রয়েছে। ভারতে তালিবান মন্ত্রীর সাংবাদিক বৈঠকে মেয়েদের স্থান দেওয়া— একটা ব্যতিক্রম।

মুত্তাকি ভারত সফর শুরু করলেন তাজমহল দর্শন করে, যা সারা বিশ্বে প্রেমের সৌধ বলে বিখ্যাত, যার নাম এক মোগল সম্রাজ্ঞীর নামে। তা বলে আফগানিস্তানে মেয়েদের অবস্থায় উন্নতি আনার কোনও অঙ্গীকার তিনি করেননি। তালিবান সরকার প্রথমে মেয়েদের রোজগারের সব পথ বন্ধ করেছে, তার পর তাঁদের পড়াশোনার পথ সঙ্কীর্ণ করেছে, কমিয়ে এনেছে জনজীবনে মেয়েদের দৃশ্যমানতা। আফগান মেয়েরা সামান্য স্বস্তি ও আনন্দ পেয়েছিলেন এ বছর জুলাই মাসে, যখন দ্য হেগ শহরে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি) তালিবানের ‘আমির’ সাইবাতুল্লা অখুন্দজ়াদা এবং তালিবানের প্রধান বিচারপতি আবদুল হাকিম হক্কানির নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে, মহিলা ও বালিকাদের প্রতি তাঁদের অপরাধের জন্য। ২০২১ সালে যে সব দমনমূলক আইন তাঁরা পাশ করেছিলেন, এবং যে বর্বরতার সঙ্গে সেগুলি আরোপ করেছেন, তার জন্যই এই সিদ্ধান্ত। আইসিসি-র এই সিদ্ধান্ত বিশ্বকে মনে করিয়ে দেয় যে, পরিকল্পিত ভাবে যে লিঙ্গভিত্তিক পীড়নের ব্যবস্থা কায়েম করেছে তালিবান, তা থেকে মেয়েদের মুক্তি দিতে বিশ্বেরও দায় আছে।

ভারত সফরে উপেক্ষিত হল সেই দায়। তালিবানি শাসনের নারীবিদ্বেষ, সামান্য সময়ের জন্য হলেও, ছায়া ফেলল ভারতের মাটিতে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Women Rights Amir Khan Muttaqi

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy