আইনস্টাইন এক বার মজা করে বলেছিলেন, “যার অস্তিত্ব আছে, বিজ্ঞানীরা তারই অনুসন্ধানী। আর যা নেই বা কখনও ছিল না, ইঞ্জিনিয়াররা তারই স্রষ্টা।” কথাটা আজও সত্যি। সামাজিক প্রয়োজনে পণ্য পরিষেবা বা পরিকাঠামো গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জ নিতেই তৈরি হয়েছে কারিগরি বিদ্যা। তাকে কালে কালে পেশা হিসেবে বেছেছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। কিন্তু গত দু’দশকে দেশের বিভিন্ন কলেজ থেকে পাশ করা স্নাতক ইঞ্জিনিয়ারদের সংখ্যা লাফিয়ে বাড়লেও উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে কাজের বাজারে তাঁদের কর্মসংস্থানের ভয়াবহ সঙ্কটও। অবস্থা এতই শোচনীয়, পাশ করা বি টেক, এম টেক ডিগ্রিধারী ইঞ্জিনিয়াররা অষ্টম শ্রেণি পাশের যোগ্যতার ‘ডোম’ বা ‘বন সহায়ক’-এর পদে দলে দলে আবেদন করছে। এই সঙ্কটে অতিমারির আবহে চালু অনলাইন ব্যবস্থা কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে যে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা বসাচ্ছে, সেটাই হয়েছে নতুন আশঙ্কার ক্ষেত্র।
কারিগরি শিক্ষার বিষয়সূচির পঞ্চাশ শতাংশ পুঁথিগত তাত্ত্বিক বিদ্যা হলেও বাকি অর্ধেক ল্যাবরেটরি, ওয়ার্কশপ, প্রজেক্ট, প্র্যাকটিক্যাল-নির্ভর। এ দেশে কারিগরি শিক্ষার প্রসার গত দু’দশকে যে ভাবে বেসরকারি হাতে সঁপে দেওয়া হয়েছে, সেখানেই বোনা হয়েছে বিপদের বীজ। শিক্ষার খরচ কমিয়ে দ্রুত লাভের লক্ষ্যে কলেজ চালাতে গিয়ে লঙ্ঘিত হয়েছে কাঙ্ক্ষিত ছাত্র-শিক্ষক সংখ্যার অনুপাত। আপস করা হয়েছে ল্যাবরেটরি, ওয়ার্কশপ, পরিকাঠামোয়। ফলে পঠনপাঠনের মান পড়েছে। এমন ভারসাম্যহীন, নজরদারিবিহীন ‘অফলাইন’ ব্যবস্থাতেই যখন মানের ক্রমাগত অবক্ষয় ঘটেছে, তখন অতিমারির বাজারে ‘অনলাইন’ ব্যবস্থা যে কারিগরি শিক্ষাকে বেলাইন করবে, বলার অপেক্ষা রাখে না। সরকারি প্রতিষ্ঠানের হাল খানিক উন্নত হলেও এমন আশঙ্কার বাইরে নয়।
অতিমারির ভয়ে রাতারাতি শিক্ষাদান ভাবনার যে অভিযোজন ঘটল অনলাইন ব্যবস্থায়, তাতে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত পেশাগত শিক্ষা। এমন বিকল্প পথে শিক্ষক বা পড়ুয়ারা খানিক জ়ুম-গুগল-ইউটিউব ব্যবহার করে তাত্ত্বিক বিষয়সূচির বোঝা ভাগ করতে পারলেও নাজেহাল হচ্ছে ল্যাবরেটরি, ওয়ার্কশপের মতো বিষয়ে, যেগুলি হাতে কলমে পুঁথিগত জ্ঞান প্রয়োগ করার উৎকৃষ্ট পথ। পাশাপাশি প্রতি পড়ুয়ার আবশ্যিক পাঠের অংশ হিসাবে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্নশিপেরও জলাঞ্জলি ঘটেছে গত আঠারো মাসে। এই কর্মসূচিতে পড়ুয়া এক দিকে ক্লাসে শেখা বিদ্যার যোগাযোগ খুঁজে পান শিল্পের বৃহত্তর বাস্তব পরিবেশে, স্বল্পকালীন অভিজ্ঞতায় প্রযুক্তি প্রয়োগে নতুন উদ্ভাবনী ক্ষমতারও বিকাশ ঘটে তাঁর। বহির্জগতের সঙ্গে যোগসূত্র গড়ে তোলার মাধ্যমে পড়ুয়াদের ‘সফ্ট স্কিলস’ নির্মাণের সুযোগও মার খাচ্ছে এই ভার্চুয়াল শিক্ষার দাপটে। এ দেশে সীমিত ক্ষেত্রে চালু দূরশিক্ষার মডেলে ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স, কিন্তু তার গ্রহণযোগ্যতা দুর্বল। এর সবচেয়ে বড় কারণ, এমন ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে ল্যাবরেটরি, ওয়ার্কশপ, প্রজেক্ট ইত্যাদিতে যৌথ পাঠের খামতি।