Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
Slap by TMC leader

এক চড়েতে ঠান্ডা! ইছাপুরের ইচ্ছাপূরণ

সত্যিই কি অবিমৃশ্যকারিতাবশত মারা কোনও চড়ের গুঞ্জন কানে-মাথায়-মগজে ভোঁ-ভোঁ করতে থাকে ইহজীবন? সেই চড়ের গুঞ্জন কি পরে বোমার মতো ফাটে?

শাসক অসহিষ্ণুতায় ভোগে। সে বিরোধিতা চায় না। সমালোচনা চায় না। সে চায় মাথা থাকবে নিচু। লেজ থাকবে দু’পায়ের ফাঁকে।

শাসক অসহিষ্ণুতায় ভোগে। সে বিরোধিতা চায় না। সমালোচনা চায় না। সে চায় মাথা থাকবে নিচু। লেজ থাকবে দু’পায়ের ফাঁকে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

অনিন্দ্য জানা
অনিন্দ্য জানা
শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০২৩ ০৮:০০
Share: Save:

ভিডিয়োটা দেখতে দেখতে ‘কর্মা’ ছবির কথা মনে পড়়ে গেল। ‘ডক্টর ড্যাং’রূপী অনুপম খেরকে সেলের ভিতরে ঢুকে সপাটে চড় কষাচ্ছেন জেলের অধিকর্তা দিলীপ কুমার। ঠাটিয়ে চড় খেয়ে চোয়াল শক্ত করে অনুপমের চরিত্র বলছে, ‘‘ইস থাপ্পড় কি গুন্‌জ তুমহে সুনাই দেগি রানা! যব তক জ়িন্দা রহোগে, তব তক সুনাই দেগি। মুঝে তুমহারে ইয়ে থাপ্পড় ভুলেগা নহি!’’

আশির দশকের মধ্যভাগে সুভাষ ঘাইয়ের তৈরি সেই মাল্টিস্টারার এবং অতিনাটকীয় ছবিটি সুপারহিট হয়েছিল। গল্পের শেষে যথারীতি ছিল দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন। যেখানে ভিলেন অনুপম চড় খাচ্ছেন ছবির সচ্চরিত্র সরকারি অফিসার দিলীপ কুমারের হাতে।

কুশীলবদের ভূমিকা একেবারে উল্টো হলেও শনিবার সকালে দত্তপুকুরের ইছাপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে সপাটে চড়ের দৃশ্যটি দেখতে দেখতে দিলীপ কুমার-অনুপম খের অভিনীত দৃশ্যটা মনে পড়ল। মনে পড়ল সেই দৃশ্যের ডায়ালগ (‘সংলাপ’ বললে ঠিকঠাক জোরটা বোঝায় না। এ হল ‘ডায়ালগ’), যার মর্মার্থ— যত দিন বাঁচবে, এই চড়ের গুঞ্জন তুমি শুনতে পাবে। তোমার এই চড় আমাকে কোনও দিন ভুলবে না।

‘কর্মা’ ছবিতে গল্পের শেষে যথারীতি ছিল দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন। যেখানে ভিলেন অনুপম চড় খাচ্ছেন ছবির সচ্চরিত্র সরকারি অফিসার দিলীপ কুমারের হাতে।

‘কর্মা’ ছবিতে গল্পের শেষে যথারীতি ছিল দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন। যেখানে ভিলেন অনুপম চড় খাচ্ছেন ছবির সচ্চরিত্র সরকারি অফিসার দিলীপ কুমারের হাতে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

ভোলে? না কি ভোলে না? সত্যিই কি অবিমৃশ্যকারিতাবশত মারা কোনও চড়ের গুঞ্জন কানে-মাথায়-মগজে ভোঁ-ভোঁ করতে থাকে ইহজীবন? সেই চড়ের গুঞ্জন কি পরে কখনও বোমার মতো ফাটে? সেই বিস্ফোরণে কি সব কিছু ওলটপালট হয়ে যায়? যেতে পারে?

রাজ্যের শাসক তৃণমূলের প্রণীত ‘দিদির সুরক্ষা কবচ’ কর্মসূচি শুরু থেকেই বিক্ষোভের মুখে পড়েছে। কোথাও নেতা, কোথাও মন্ত্রী, কোথাও বিধায়ক, কোথাও সাংসদ আমজনতার মুখোমুখি হয়ে সেই ক্ষোভের আগুনের আঁচ টের পাচ্ছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনাধীন পশ্চিমবঙ্গে গত ১১ বছরে গ্রামাঞ্চলে কোথাও কাজ হয়নি, এ কথা তাঁর ঘোর বিরোধীরা একগলা গঙ্গাজলে দাঁড়িয়ে বললেও বিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই। কাজ যে হয়েছে, তার প্রমাণ কঠিন থেকে কঠিনতর নির্বাচনে তাঁর সফল থেকে সফলতর হওয়ার খতিয়ান।

কিন্তু ক্ষমতায় থাকতে থাকতে কিছু অতিরিক্ত মেদ জমে। ক্ষমতার সেই গাদ কথা বলে। তার শব্দও শোনা যায়। যে শব্দ বিরোধিতার লেশমাত্র গ্রাহ্য করে না। অনুযোগ শোনে না। অভিযোগ শুনলে অসহিষ্ণুতা দেখায়। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্ভবত তা অনুমান করেছিলেন। বুঝতে পেরেছিলেন, সবুজ ঘাসের তলায় কিছু বেনোজল জমেছে। যাতে জমি আলগা হয়ে যেতে পারে। তাই পঞ্চায়েত ভোটের আগে তিনি দলীয় স্তরে এই কর্মসূচি বেঁধে দিয়েছেন। যাতে সময় থাকতে ফাঁকফোকর বুজিয়ে ফেলা যায়। তার আগে থেকে তিনি নিজস্ব পরিকাঠামো ব্যবহার করে জমির পরিস্থিতি বুঝে নিয়েছেন। রাজ্য জুড়ে তাঁর বিবিধ কর্ষিকাকে সক্রিয় করে তুলেছেন। তারা নিজেদের মতো করে ঘুরে নৈর্ব্যক্তিক এবং নিরপেক্ষ রিপোর্ট পাঠাচ্ছে তাঁর কাছে। মনে হতে পারে, অভিষেক একটি সমান্তরাল প্রশাসন চালাচ্ছেন। কিন্তু এ ছাড়া তাঁর আর উপায়ই বা কী ছিল!

অভিষেক যে ভুয়োদর্শী, তার ইঙ্গিত প্রথম থেকেই মিলছে। তৃণমূল স্তরে পৌঁছনোর জন্য গোটা দলকে যে ট্রেডমিলে তিনি চড়িয়ে দিয়েছেন, দেখা যাচ্ছে, সেখানে দৌড়তে গিয়ে ক্ষমতার মেদবৃদ্ধির ফলে হাঁফ ধরছে। পঞ্চায়েত ভোটের আগে এ সব চর্বি ঝরিয়ে দল আবার স্লিম-ট্রিম হয়ে বিরাট কোহলী অবতারে আবির্ভূত হবে কি না, সেটা সময়ের বিবেচ্য। কিন্তু যে অসহিষ্ণুতার উন্মেষ শুরুতেই দেখা গেল, তা খুব সুখের নয়।

ছবি: পিটিআই।

ইছাপুরের ঘটনায় কয়েকটি বিষয় প্রত্যাশিত। কিন্তু প্রণিধানযোগ্য—

এক, যিনি চড় খেয়েছেন, তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া শুরু হয়েছে। তিনি বিজেপির মণ্ডল সভাপতি। সে তথ্য ঠিক। কিন্তু যুক্তি হল— অতএব, তাঁর মন্ত্রীর কাছে অভিযোগ জানানোর অধিকার নেই! তাঁর কাজটা ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’। দুই, মন্ত্রী বলছেন, এর সঙ্গে সরকারের কাছে অভাব-অভিযোগ জানানোর কোনও সম্পর্ক নেই। পুরোটাই ‘স্থানীয়’ গোলমাল। কোনও একটি ক্লাবের মাঠে গাছ-কাটা নিয়ে বিবাদ। সেই ক্ষোভের ‘সুযোগ’ নিয়েই অভিযোগকারী এসেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচিতে গোলমাল পাকাতে। তৃতীয়ত, মন্ত্রী বিষয়টি দক্ষতার সঙ্গে সামলেছেন। ঠান্ডা মাথায়। চড়-খাওয়া ব্যক্তিকে সস্নেহে আলিঙ্গন করেছেন। এবং জানিয়েছেন, যিনি চড় মেরেছেন, তিনি তৃণমূলের কেউ নন। আরও জানিয়েছেন, তাঁর উপস্থিতিতে তৃণমূলের কারও কাউকে চড় মারার দুঃসাহস হবে না। হামলাকারীও চড়-খাওয়া যুবকের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন (আসলে গালে আদরের অদৃশ্য ঠোনা দিয়েছেন। যেমন মন্ত্রী-সান্ত্রীদের সাইডকিকরা করে থাকেন)। ফলে ধরে নেওয়া যায়, বিষয়টির মধুরেণ সমাপয়েৎ হয়েছে। যদিও পরে ‘চড়াক্রান্ত’ প্রতিবাদে নিয়মরক্ষার অবরোধে বসেছিলেন।

চতুর্থত, সিপিএম এবং বিজেপি বিষয়টি নিয়ে ময়দানে নেমে পড়েছে। স্বাভাবিক। এ নিয়ে নামবে না তো কী নিয়ে নামবে! কিন্তু সিপিএমের সাড়ে চৌত্রিশ বছরের ইতিহাসে এমন চড় যে কত বার কত জনের গালে পড়েছে! তখন শ্রাব্য, দৃশ্য এবং সমাজমাধ্যম এত শক্তিশালী ছিল না। হাতে-হাতে স্মার্টফোন ছিল না। ফলে সব কিছুই সিন্দুকে ভরে তালা মেরে চাবি গভীর বিস্মরণে ফেলে দেওয়া যেত। কিন্তু ওই যে, চড়ের গুঞ্জন কখনও না কখনও গর্জন হয়ে ওঠে। যেমন হল ২০০৬ সালের বিধানসভা ভোটের পর। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের বহ্বাস্ফোট এবং তজ্জনিত কারণে ২০১১ সালে বাংলার ঠিকাদারি থেকে বিদায় নেওয়ার পর এক প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ সখেদে বলেছিলেন, ‘‘আমরা গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছি। কিন্তু খেয়াল করিনি, তার পিছু পিছু সেখানে নিউজ চ্যানেলও ঢুকছে!’’

এবং পঞ্চমত, বিজেপি! সারা দেশের কত রাজ্য, শহর এবং গাঁ-গঞ্জে যে তাদের এমন কত চড়-থাপ্পড়ের ইতিহাস ছড়িয়ে রয়েছে। এ রাজ্যে ক্ষমতায় আসার আগেই যে ‘দিলীপ-বাণী’ দিগ্‌বিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল, তা শিহরিত হওয়ার মতো। ক্ষমতায় এলে না জানি কী হত!

ছবি: পিটিআই।

অতএব সে তর্ক থাক। অস্যার্থ হল— প্রশ্ন তুললে সকলেই আসলে এক চড়েতে ঠান্ডা করতে চান। কেউ দু’অক্ষরের সম্বোধন-সহ সপাটে চড় কষান। কেউ বলেন, ‘‘শুঁটিয়ে লাল করে দেব!’’ হীরকরাজের মতো কেউ বলেন, ‘‘অভিযোগ! এটা একটা রোগ!’’ কেউ বলেন, ‘‘রগড়ে দেব!’’ কালে কালে এমনই হয়ে এসেছে। শাসক অসহিষ্ণুতায় ভোগে। সে বিরোধিতা চায় না। সমালোচনা চায় না। সে চায় মাথা থাকবে নিচু। লেজ থাকবে দু’পায়ের ফাঁকে। যতই কেউ গান বাঁধুন, ‘বিরোধীকে বলতে দাও’, সে গান নিছক এবং নিষ্ফলা আকুতি হয়েই ক্যাসেট-সিডি-ইউটিউবে থেকে যায়। ইছাপুর সেই ইচ্ছাপূরণের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।

কিন্তু ইতিহাস বলে, চড়ের গুঞ্জন কোথাও না কোথাও থেকে যায়। সেই গুঞ্জন কানে-মাথায়-মগজে ভোঁ-ভোঁ করতে থাকে অবিরল। তার পর সময় বুঝে গর্জনে পরিণত হয়। দিদির বিভিন্ন দূত যে ভাবে হেনস্থার মুখে পড়ছেন, তাতে পঞ্চায়েত ভোটে সেই ‘সময়’ আসবে কি না, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হওয়ার গভীর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

‘কর্মা’ ছবিতে চড় খেয়ে প্রাথমিক ভাবে ভোম্বল হয়ে-যাওয়া এবং পরে সামলে-সুমলে পাল্টা হুঁশিয়ারি-দেওয়া অনুপম খেরকে দিলীপ কুমার বলেছিলেন, ‘‘ভুলনা ভি নহি চাহিয়ে!’’ দুষ্ট এবং শিষ্টমূলক কুশীলবদের সরিয়ে রেখে যদি শুধু থাপ্পড়টা নিয়ে ভাবি?

সত্যিই কি অবিমৃশ্যকারিতাবশত মারা কোনও চড়ের গুঞ্জন কানে-মাথায়-মগজে ভোঁ-ভোঁ করতে থাকে? সেই গুঞ্জন কি পরে কখনও বোমার মতো ফাটে? সেই বিস্ফোরণে কি সব কিছু ওলটপালট হয়ে যায়? যেতে পারে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE