উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রান্তিক রাজ্যগুলিরও ‘প্রান্তে’ অরুণাচল প্রদেশ। সেই রাজ্যে আবার প্রান্তবাসী বিরাট সংখ্যক রাষ্ট্রহীন চাকমা ও হাজং জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন জাতিগত, ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের জনজাতি সম্প্রদায়কে সভ্য সমাজ ‘ট্রাইবাল’ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করতে অভ্যস্ত। তাঁদের নিয়ে তথাকথিত ‘মেনল্যান্ড’-এর মানুষের কখনও মাথাব্যথা ছিল না, এখনও নেই। কিন্তু রাষ্ট্রহীন চাকমা ও হাজং জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে অরুণাচল প্রদেশের রাজ্য-রাজনীতি বেশ কয়েক দশক ধরে সরগরম। গত ৪ ডিসেম্বর চাকমাদের জন্য এক বিশেষ জনগণনা করা হবে শুনে এমন আতঙ্ক ছড়িয়েছিল যে, ‘দ্য চাকমা ডেভলপমেন্ট ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়া’ নামে এক সংগঠন প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রধান ভাগবতকে হস্তক্ষেপের দাবি জানায়।
ইতিহাস বলছে, দেশভাগ-পরবর্তী রাষ্ট্রব্যবস্থা, উদ্বাস্তু সম্পর্কে রাষ্ট্রনেতাদের মনোভাব এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ঘিরে গোটা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি এই সমস্যার উৎস। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় ৯৮ শতাংশ বৌদ্ধ ও হিন্দু জনগোষ্ঠীর মতকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে, র্যাডক্লিফ লাইনের মাধ্যমে এই অঞ্চলকে জুড়ে দেওয়া হয় ‘পাকিস্তান’-এর সঙ্গে। ১৯৫০-এর দশক থেকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিল্পাঞ্চল হিসাবে গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু করলে অঞ্চলের আদিবাসীরা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখে পড়তে শুরু করেন। চট্টগ্রামকে শিল্পনগরী হিসাবে গড়ে তোলার জন্য ১৯৫৩ সালে চন্দ্রগোলাতে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের সহায়তায় কর্ণফুলি পেপার মিল এবং ১৯৫৯-৬৩ সালের মধ্যে পাকিস্তান আমলের সবচেয়ে বড় পরিকল্পনা, কাপতাই হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্রজেক্ট গড়ে তোলা হয়। কাপতাই প্রজেক্টের সার্থক রূপায়ণের জন্য ৫২,০০০ একর চাষযোগ্য জমি, যা চট্টগ্রামের মোট আবাদ করা জমির ৪০ শতাংশ নিয়ে নেওয়া হয়। প্রায় লক্ষাধিক আদিবাসী জমি থেকে বিচ্ছিন্ন হন। পাকিস্তান সরকার তাঁদের ক্ষতিপূরণ অবধি দিতে অস্বীকার করলে, তাঁরা অন্যত্র জুম চাষের জমি ও বাসস্থান খুঁজতে শুরু করেন।
এই ভাবে ১৯৬০-এর দশকে প্রায় ১৪,০০০-এর বেশি চাকমা ও হাজং জনজাতির মানুষ আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি রাজ্য, নেফা (অরুণাচল প্রদেশ), মিজোরাম ও ত্রিপুরায় আশ্রয়ের দাবি জানান। তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার নেফা অঞ্চলের টিরাপ ও চাংলাং জেলার এজেন্সি এলাকায়, লোহিত ও সুবলসিঁড়ি জেলায় মোট ১০,৭৯৯ একর জমিতে এঁদের চিরস্থায়ী ভাবে পুনর্বাসন দেয়। ১৯৬২ সালের চিন-ভারত সংঘর্ষের প্রেক্ষিতে এই অসহায়, প্রান্তিক, ছিন্নমূল আদিবাসী মানুষদের ‘হিউম্যান ওয়াল’ হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। অন্য উদ্দেশ্য ছিল, এই অনাবাদি জমিতে এঁদের পুনর্বাসন দিলে, এই অঞ্চলের পতিত জমিকে চাষের আওতায় আনা সম্ভব হবে। তবে ভারত সরকার এঁদের বৈধ আশ্রয় দিলেও ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্বের আইনে এঁদের অন্তর্ভুক্ত করা হল না।