Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

‘খারাপ’ ও ‘ভাল’ স্পর্শের মধ্যে ফারাক বোঝাতে হবে শিশুকে

পুরুলিয়াতেও শিশু-নিগ্রহের ঘটনা সামনে আসছে। পুলিশি পরিসংখ্যান থেকেই বিষয়টি স্পষ্ট। চিন্তার বিষয় এই যে, বেশির ভাগ ঘটনা ঘটেছে পরিবারের ভিতরে। কী করবেন? লিখছেন তপনকুমার কর পুরুলিয়াতেও শিশু-নিগ্রহের ঘটনা সামনে আসছে। পুলিশি পরিসংখ্যান থেকেই বিষয়টি স্পষ্ট। কাশীপুর, নিতুড়িয়া, রঘুনাথপুর, সাঁওতালডিহি, সাঁতুড়ি থানাগুলিতে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে নিয়মিত অভিযোগ দায়ের হয়েছে।

ছবি প্রতীকী।

ছবি প্রতীকী।

শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০১৯ ০২:১৬
Share: Save:

আর পাঁচটা অপরাধের মতো শিশু-নিগ্রহের ঘটনা এখন প্রায়ই সংবাদপত্রের পাতায় জায়গা করে নিচ্ছে। দেশের নানা প্রান্তে পরিবার, স্কুল ও অনাথ আশ্রমগুলিতে শিশুদের উপরে বাড়তে থাকা যৌন নির্যাতনের ঘটনা উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। পুলিশ সব ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা নেয় না বলেও মাঝেমধ্যে অভিযোগ ওঠে৷ শিশু-নিগ্রহের ক্ষেত্রে বিশেষ আইন থাকলেও তার বাস্তবায়ন ঠিকমতো না হওয়াতেও সমস্যা বাড়ছে বলে অনেকের মত।

পুরুলিয়াতেও শিশু-নিগ্রহের ঘটনা সামনে আসছে। পুলিশি পরিসংখ্যান থেকেই বিষয়টি স্পষ্ট। কাশীপুর, নিতুড়িয়া, রঘুনাথপুর, সাঁওতালডিহি, সাঁতুড়ি থানাগুলিতে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে নিয়মিত অভিযোগ দায়ের হয়েছে। চিন্তার বিষয় এই যে, বেশির ভাগ ঘটনা ঘটেছে পরিবারের ভিতরে৷ যৌথ পরিবারগুলিতে বিভিন্ন প্রজন্মের মানুষ একত্রে বসবাস করে৷ জ্যাঠা, কাকা বা তুতো ভাই-বোনেরা৷ তাই এমন কোনও পরিবারে যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা আড়াল করার চেষ্টা দেখা যায়৷ মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হলে লুকনো হয়৷ কেননা, জানাজানি হলে ‘সম্মান’ কোথায় যাবে!

প্রকৃতপক্ষে, শিশু নিগ্রহের কোনও ঘটনা ঘটলে অভিভাবকদের ভূমিকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাঁদের উচিত বিষয়টি নিয়ে সচেতন হয়ে শিশুদের কথাকে গুরুত্ব দেওয়া। তাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশে, তারা কী বলতে চাইছে তা ঠান্ডা মাথায় বোঝার চেষ্টা করতে হবে। কখনই শিশুকে ঘটনার জন্য দায়ী করা বা বকাঝকা করা উচিত নয়। বরং তাদের ভালবেসে তাদের পাশে থেকে ঘটনার প্রভাব থেকে তাদের মুক্ত করার চেষ্টা করতে হবে। শিশুদের ‘খারাপ’ স্পর্শ ও ‘ভাল’ স্পর্শ-এর মধ্যে ফারাক বুঝতে শেখাতে হবে। কোথাও শিশুকে একা রেখে যাওয়ার আগে ভাবতে হবে, তারা সেখানে নিরাপদ কি না। সর্বোপরি, ঘটনার পরে যত দ্রুত সম্ভব শিশুকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। বিষয়টি পুলিশকে জানাতে হবে এবং এ ব্যাপারে যুক্ত সামাজিক সংস্থার সাহায্য নিয়ে শিশুকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সাহায্য করতে হবে।

২০১২ সালে যৌন অপরাধের ক্ষেত্রে শিশুদের রক্ষার যে সুরক্ষা আইন (পকসো অ্যাক্ট) তৈরি হয়েছে, তাতে নানা বিষয়ের উপরে যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করে শাস্তির প্রতিবিধান রাখা হয়েছে। সেখানে অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী তিন বছর থেকে সাত বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড ও জরিমানার কথা বলা হয়েছে।

আইন অনুযায়ী, প্রতিটি পুলিশ স্টেশনে শিশুঘটিত অপরাধের বিষয়ে এক জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পুলিশকর্মীর থাকার কথা। যিনি ঘটনার কথা জানার সঙ্গে সঙ্গে সময় নষ্ট না করে শিশু যাতে আরও ভীতিজনক অবস্থার সম্মুখীন না হয়, তার ব্যবস্থা করবেন ও ডাক্তারি পরীক্ষার পাশাপাশি, দ্রুত বিচারকের কাছে জবানবন্দি দেওয়ানোর ব্যবস্থাও করবেন। প্রতি ক্ষেত্রে শিশুর অভিভাবককে সঙ্গে রাখতে হবে ও কোনও মহিলা অবর পরিদর্শকের তত্ত্বাবধানে জবানবন্দি নিতে হবে। দেখতে হবে, যাতে কোনও ভাবে শিশু অভিযুক্তের সংস্পর্শে না আসে। কোনও অবস্থায় শিশুকে রাতে থানায় রাখা যাবে না। শিশুর ডাক্তারি পরীক্ষার সময়ে অভিভাবককে সঙ্গে রাখতে হবে ও শিশুকন্যার ক্ষেত্রে মহিলা চিকিৎসক দিয়ে পরীক্ষা করতে হবে।

এ ধরনের অপরাধের বিচারের ব্যাপারেও আইনে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। কোনও ভাবেই শিশুকে সরাসরি ঘটনা সম্পর্কে প্রশ্ন করা উচিত নয়। এ ধরনের বিচারের সময়ে বিচারক ও দুই পক্ষের আইনজীবী ছাড়া, কেবল শিশুর অভিভাবক উপস্থিত থাকতে পারবেন। সাক্ষী দেওয়ার সময়ে শিশু সরাসরি অভিযুক্তকে দেখতে না পায় তারও ব্যবস্থা করতে হবে। আইনে শিশুকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যাপারেও বলা হয়েছে। বিচারক অন্তর্বর্তীকালীন ও বিচার শেষে এককালীন ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যাপারে আদেশ দিতে পারেন। এই আইনের মূল উদ্দেশ্য হল দ্রুত শিশুটিকে তার স্বাভাবিক কাজকর্ম, যেমন পড়াশোনা, খেলাধুলো ইত্যাদিতে ফিরিয়ে দেওয়া।

এই আইনের ঠিকমতো রূপায়ণে এগিয়ে আসতে হবে অভিভাবক, বিদ্যালয় ও সামাজিক সংগঠনগুলিকে। অভিভাবকদের জানতে হবে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে কোথা থেকে সাহায্য পাওয়া যেতে পারে। যেমন, ১০৯৮ নম্বরে ‘চাইল্ডলাইন’-এর সাহায্য পাওয়া যায়। এ ছাড়া, মানসিক, আর্থিক, আইনি ও অন্য সাহায্যের বিষয়েও আইনে উল্লেখ রয়েছে। তবে শিশুদের উপরে হওয়া অপরাধ কমাতে গেলে সমাজের সকল অংশের মানুষকে সচেতন ভাবে এগিয়ে আসতে হবে।

স্কুলেরও এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। শিশুরা যাতে নিরাপদে থাকে, সে দিকে সতর্ক নজর রাখার পাশাপাশি, শিশু ও তাদের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের নিয়মিত যোগাযোগ রাখার দিকে খেয়াল রাখতে হবে স্কুল-পরিচালকদের। আর সামাজিক সংগঠনগুলিকে সরকার ও অভিভাবকদের মাঝে মেলবন্ধনের কাজটা করতে হবে।

লেখক রঘুনাথপুরের আইনজীবী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sexual Harassment Child Molestation POCSO
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE