বিস্ময়ের কারণ ইহাই যে, সরকার পরিসংখ্যানটি ধামাচাপা দিতে উদ্গ্রীব।
দেশ জুড়িয়া যখন লকডাউন, কলকারখানা বন্ধ, তখন শিল্পোৎপাদনের হার যে কমিবে, তাহাতে বিস্ময়ের কোনও কারণ নাই। এই এপ্রিলে শিল্পোৎপাদনের সূচক গত এপ্রিলের তুলনায় ৫৫.৫ শতাংশ কমিয়াছে। বিস্ময়ের কারণ ইহাই যে, সরকার এই পরিসংখ্যানটিকে ধামাচাপা দিতে উদ্গ্রীব। প্রচলিত রীতি হইল সূচকের হ্রাস-বৃদ্ধির হারটি প্রকাশ করা। তাহার পরিবর্তে এপ্রিলের সূচকসংখ্যা প্রকাশ করিয়াছে সরকার। এবং জানাইয়াছে, এই মাসের পরিসংখ্যানটিকে অন্য সময়কালের সহিত তুলনা করা অনুচিত হইবে, কারণ এই এপ্রিলে দেশের শিল্পোৎপাদন বিপুল ভাবে ব্যাহত হইয়াছিল। কেহ বলিতেই পারেন, ইহা পাভলভীয় প্রতিক্রিয়া। পরিসংখ্যান অস্বস্তিকর হইলেই নরেন্দ্র মোদীর সরকার নিছক প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় তাহাকে চাপিয়া দেওয়ার কথা ভাবে। কর্মহীনতা বৃদ্ধির পরিসংখ্যানই হউক বা দেশের গ্রামাঞ্চলে ভোগব্যয় হ্রাস পাইবার পরিসংখ্যান— সংখ্যা যেখানেই অস্বস্তিকর গল্প বলিয়াছে, সরকার সর্বাগ্রে তাহাকে জনপরিসর হইতে সরাইয়া লইয়াছে। বালিতে মুখ গুঁজিলে বিপদ যদি না-ও বা কাটে, মুখ দেখাইবার বাধ্যবাধকতা হইতে মুক্তি পাওয়া যায়। ফলে, কেহ অনুমান করিতে পারেন, শিল্পোৎপাদনের সূচক হ্রাস পাওয়াতেও সরকার সংখ্যা লুকাইতে মরিয়া।
এই ব্যাখ্যাটি অবশ্য সরকারের প্রতি অতি সদয়। কারণ, ইহাতে যে ছবিটি মিলিতেছে, তাহা বড় জোর কাণ্ডজ্ঞানহীনতার— কর্তারা বুঝিতে পারেন নাই যে ক্ষেত্রওয়াড়ি পরিসংখ্যান না মিলিলে লকডাউনের প্রকৃত ছবিটি ধরা সম্ভব হইবে না, ফলে উদ্ধারের পথনির্দেশিকাও মিলিবে না। আসল কথা কি সেইটুকুই? শিল্পোৎপাদনের সূচকের ৭৮ শতাংশ জুড়িয়া আছে যে নির্মাণশিল্প, লকডাউনের পূর্বেই তাহার নাভিশ্বাস উঠিতেছিল। এপ্রিলে এই সূচকটি কমিয়াছে ৬৪.২ শতাংশ। এই ক্ষেত্রের অন্তর্ভুক্ত ২৩টি ক্ষেত্রের প্রতিটিতেই উৎপাদন হ্রাস পাইয়াছে অন্তত ৫০ শতাংশ— তাহার মধ্যে বারোটি ক্ষেত্রে এই হ্রাসপ্রাপ্তির হার ৯০ শতাংশের অধিক। ঘটনা হইল, এই ২৩টি ক্ষেত্রের প্রতিটিতেই মার্চেও উৎপাদন হ্রাস পাইয়াছিল— যে মাসে শেষ সাত দিন লকডাউন ছিল। মার্চে নির্মাণ ক্ষেত্রে উৎপাদন হ্রাস পাইয়াছিল ২২.৪ শতাংশ। শিল্পোৎপাদনের সূচক সামগ্রিক ভাবে কমিয়াছিল ১৮.৩ শতাংশ। অর্থাৎ, শিল্পোৎপাদনের ক্ষেত্রে লকডাউন খাঁড়ার ঘা— ক্ষেত্রটি পূর্ব হইতে মৃতকল্পই ছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের রীতিনীতি সম্বন্ধে অধিকতর সচেতন কেহ প্রশ্ন করিতে পারেন, এই কঙ্কাল যাহাতে বাহির না হইয়া পড়ে, তাহার জন্যই কি এপ্রিলের শিল্পোৎপাদনের সূচক লুকাইবার আপাত-নির্বোধ তৎপরতা?
ভারতে আয়বৃদ্ধির হার যে ঋণাত্মক হইতে চলিয়াছে, তাহা এখন প্রায় তর্কাতীত। প্রশ্ন হইল, সেই হার কত নীচে নামিয়া যাইবে? শিল্পোৎপাদনের সূচক স্পষ্ট জানাইল, এই প্রশ্নের উত্তর আপাতত শিল্পক্ষেত্রের হাতে নাই, আছে সরকারের হাতে। লকডাউন ও কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তার কারণে ভোগব্যয় সঙ্কুচিত হইতেছে। রফতানির বাজারও অন্ধকার। জিডিপি বাড়াইবার অস্ত্র হিসাবে পড়িয়া থাকে শুধু সরকারি ব্যয়। সুলভ ঋণ ইত্যাদির গল্পগাছায় জিডিপি বাড়িবে না, তাহার জন্য প্রকৃত ব্যয়বৃদ্ধি প্রয়োজন, সাধারণ মানুষের হাতে নগদের জোগান দেওয়া প্রয়োজন— যে কাজটিতে সরকার এখনও অবধি সুদৃঢ় অনীহা প্রদর্শন করিয়াছে। অর্থনীতির চক্রটি অতি দ্রুত একটি আবর্তন পূর্ণ করিল। দরিদ্র, বিপন্ন মানুষকে অন্তত আংশিক রেহাই দেওয়ার জন্য যে আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা করিবার কথা অর্থনীতিবিদরা বলিতেছিলেন এবং সরকার যে পরামর্শটি অবজ্ঞা করিতেছিল, এখন তাহাই জিডিপি-র মানরক্ষার একমাত্র আয়ুধ। এই বার প্রধানমন্ত্রী কী করিবেন?
আরও পড়ুন: ত্রাণ দিয়ে আর বাঁধ মেরামত করে সুন্দরবনকে বাঁচানো যাবে না
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy