তবুও ভাল, অরুণ জেটলি উদ্বেগের কারণ দেখিয়াছেন। বলেন নাই যে জিডিপি-র বৃদ্ধির হার ৫.৭ শতাংশে নামিয়া যাওয়ায় বিচলিত হওয়ার প্রয়োজন নাই, কারণ সেই পথেই অর্থনীতির অচ্ছে দিন আসিবে। তিনি আশ্বাস দিলে অবাক হইবার কারণ থাকিত না। এক দিন পূর্বেই তিনি বুঝাইয়া বলিয়াছিলেন, নোট-বাতিলে দেশের কতখানি লাভ হইয়াছে। এক্ষণে প্রশ্ন, পর পর দুই দিন সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ দুইটি কথা যে অর্থমন্ত্রী বলিতে পারেন, তাঁহাকে কি ভরসা করা চলে? বস্তুত, যে সরকার অর্থনীতিকে এমন অবস্থায় লইয়া যাইতে পারে, তাহার উপর ভরসা করা উচিত কি? নোট বাতিলে দেশের অর্থনীতির কতখানি ক্ষতি হইয়াছে, তাহা স্পষ্ট, কিন্তু সেই ক্ষতির কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণ নাই। উৎপাদনক্ষেত্র মার খাইয়াছে, নির্মাণশিল্প ধরাশায়ী— কিন্তু, সেই ক্ষয়ক্ষতি যে নোট বাতিলের ফলেই হইয়াছে, তাহার হাতেকলমে প্রমাণ নাই। বস্তুত, সেই ক্ষতির মাপের জন্য অবরোহাত্মক তর্কশাস্ত্রের যুক্তির উপরই ভরসা করিতে হইবে। তাহাই প্রামাণ্য পদ্ধতি। কিন্তু, দেশের ভক্তবৃন্দের উপর অর্থমন্ত্রীর নির্ঘাত ভরসা আছে যে তাহারা যুক্তির কথা শুনিলেও মানিবে না। অন্য দিকে, জিডিপি কাহাকে বলে, সেই কথাটি যাঁহারা জানেন না, তাঁহারাও বিলক্ষণ জানেন যে এই হার কমিতে আরম্ভ করিলেই সর্বনাশ। মনমোহন সিংহের আমলে নরেন্দ্র মোদীর এই হারের যথেষ্ট বৃদ্ধির অভাব লইয়া প্রভূত শোরগোল করিতেন। কাজেই, জিডিপি-র বৃদ্ধির হার গত তিন বৎসরের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে নামিয়া যাওয়াকে দেশের উন্নতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বলিয়া ঘোষণা করিতে অর্থমন্ত্রী সম্ভবত সাহস পান নাই। উদ্বেগের কারণ আছে, এই স্বীকারোক্তিটির উৎপত্তি এই সাহসের অভাবেই।
ভারতীয় অর্থনীতির অবস্থা দেখিয়া কাহারও হাল্লার রাজার কথা মনে প়়ড়িতে পারে। বৈজ্ঞানিকের গবেষণাগারে বিভিন্ন অপরিচিত যন্ত্র দেখিয়া রাজার যেমন উল্লাস হইয়াছিল, দুর্জনে হয়তো বলিবে, ভারতীয় অর্থনীতি নামক বস্তুটিকে হাতে পাইয়া নরেন্দ্র মোদীও তেমন লাফাইয়া উঠিয়াছেন। ‘বাচ্চা কেমন চটপটে’, তাহা দেখিবার জন্য তিনি সুকুমার রায় বর্ণিত পথটিই বাছিয়াছেন। নোট বাতিলের ধাক্কা সামলাইয়া না উঠিতেই তিনি জিএসটি-র গুঁতা লাগাইয়া দিয়াছেন। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম তলানিতে, ভারতের মূলধনী খাতে ঘাটতি ঐতিহাসিক রকম কম, এমন একটি অবস্থাতেও ভারতীয় অর্থনীতি মুখ থুবড়াইয়া পড়িল। নোট বাতিল হইবার পর মনমোহন সিংহ আশঙ্কা প্রকাশ করিয়াছিলেন, জিডিপি-র বৃদ্ধির হার দুই শতাংশ-বিন্দু অবধি কমিতে পারে। পরিসংখ্যান তাঁহার আশঙ্কাটিকে সত্য প্রমাণ করিতেছে। তবে, এই ঘটনাক্রম হইতে কেহ চাহিলে আরও একটি বার্তা পাঠ করিতে পারেন— অর্থনীতির রাশ সব হাতে সমান বশ মানে না।
মেক ইন ইন্ডিয়া-র ব্যর্থতা বিষয়ে নীতি আয়োগের পর্যবেক্ষণ, নোট বাতিল প্রসঙ্গে রিজার্ভ ব্যাংকের পরিসংখ্যান এবং জিডিপির বৃদ্ধি-হারের গতিভঙ্গ— এক সপ্তাহের মধ্যে প্রকাশিত তিনটি সংবাদকে পাশাপাশি রাখিলে নিঃসংশয় হইয়া বলা যায়, অর্থনীতির প্রশ্নটিতে ক্ষতি বই আর কিছু হইতেছে না। প্রধানমন্ত্রী ছাতি চাপড়াইয়াছেন, কাঁদিয়াছেন, পঞ্চাশ দিনে উপকার না পাইলে তাঁহার গায়ে আগুন লাগাইয়া দেওয়ার ছাড়পত্র দিয়াছেন। তিনি বহুবিধ নাম উদ্ভাবন করিয়াছেন, তাহারও অধিক অজুহাত নির্মাণ করিয়াছেন। কিন্তু, অর্থনীতি বস্তুটি খেয়ালখুশিকে প্রশ্রয় দেয় না। ভোট ভিন্ন আর কোনও লক্ষ্য নাই, চাতুর্য ভিন্ন আর কোনও অস্ত্র নাই— শাসক এমন হইলে অর্থনীতি মুখ থুবড়াইয়াই পড়ে। উদ্বেগের কারণ? বিলক্ষণ আছে। অর্থনীতির স্বাস্থ্য লইয়া যতখানি, তাহারও অধিক তাহার পরিচালকদের কাণ্ডজ্ঞান লইয়া।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy