Advertisement
১০ মে ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

আপাত শান্তি

পশ্চিমবঙ্গের পার্বত্য জেলাটিতে ভয়াবহ তাণ্ডব যে এত দ্রুত আয়ত্তে আনা যাইবে, ভাবা যায় নাই। কিন্তু গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা আহূত বন্‌ধের প্রাথমিক পর্বটি মোটের উপর সংঘর্ষহীন কাটিল।

শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

আগুন নিবিয়াছে। ইহা যদি ভাল খবর হয়, তবে পাহাড়ের সংবাদ আপাতত ও আপাত ভাবে ভালই বলিতে হইবে। পশ্চিমবঙ্গের পার্বত্য জেলাটিতে ভয়াবহ তাণ্ডব যে এত দ্রুত আয়ত্তে আনা যাইবে, ভাবা যায় নাই। কিন্তু গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা আহূত বন্‌ধের প্রাথমিক পর্বটি মোটের উপর সংঘর্ষহীন কাটিল। রাজ্য প্রশাসনের নির্দেশ মানিয়া আফিস-কাছাড়িতে উপস্থিতির হারও বেশ উচ্চ দেখা গেল। পার্বত্য অধিবাসীরা স্পষ্টতই চেষ্টা করিতেছেন, আকস্মিক উথালপাথালের পর আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়া আসিতে। পর্যটকরাও গোড়ার বিভ্রান্তি কাটাইয়া উঠিয়াছেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যবিলাস-অভিলাষীদের সংখ্যা কমিয়াছে ঠিকই, কিন্তু বিক্ষিপ্ত পর্যটকরা এখনও দৃশ্যমান। সুসংবাদ। স্বাভাবিকতা যতটুকু ফেরত আসিয়াছে, তাহার জন্য প্রথম কৃতিত্ব দার্জিলিং জেলার অধিবাসীদের। বিমল গুরুঙ্গের নেতৃত্ব মোর্চার গোলযোগসর্বস্ব রাজনীতিতে তাঁহারা যদি সকলেই মনেপ্রাণে মাতিতেন, পাহাড় বনাম সমতলের খেলায় কোমর বাঁধিয়া নামিতেন, তাহা হইলে এইটুকু শান্তির আবহও এত তাড়াতাড়ি ফিরানো যাইত না। দ্বিতীয় কৃতিত্ব, অবশ্যই, মুখ্যমন্ত্রীর। তিনি জেদ করিয়া পাহাড়ে স্বয়ং বসিয়া ছিলেন পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাইবার অভিপ্রায়ে। দ্রুত সিদ্ধান্ত লইয়া ছত্রভঙ্গ পুলিশ-প্রশাসনকে সংগঠিত করিতে নিজে উদ্যোগ লইয়াছিলেন। গোর্খা নেতাদের বিশৃঙ্খলাভিত্তিক রাজনীতির পাশে তাঁহার দৃঢ়চিত্ত প্রশাসনিক উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে।

তবে কি না, আগুন নিবিলেও তাহার ধিকিধিকি আঁচ থাকিয়া যায়। সামান্য ফুলকিতেই তাহা আবার ভয়াল আকার লইতে পারে। এখন পাহাড়ময় নিরাপত্তারক্ষী ও সেনার অনবরত টহলদারি, তাই মোর্চার আদেশ অমান্য করাও সহজ। কিন্তু দিন তো এমন ভাবেই কাটিবে না। প্রহরীরা বিদায় লইবে। রাজনীতিকরাও অন্যত্র মনোনিবেশ করিবেন। তখন গোর্খা নেতৃত্ব কতটা সংযত থাকিবে, কতখানি ভয়-পরিবেশ তৈরি করিবে, পরিচিতির নামে আবার নূতন কোন বিশৃঙ্খলায় মাতিবে, বলা যাইতেছে না। বিশেষত যখন ইহা স্পষ্ট যে বিজেপিও সুযোগ বুঝিয়া ঘোলা জলে মাছ ধরিতে নামিয়া পড়িয়াছে। এত দিন অবধি প্রধানমন্ত্রী মোদী পৃথক গোর্খা রাজ্য বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেন নাই, এমনকী মোর্চার সহিত বিজেপির রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা সত্ত্বেও এ বিষয়ে নীরবতা রক্ষিত হইয়াছে। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেই অবস্থান পাল্টাইতে পারে। পশ্চিমবঙ্গ বিষয়ে কেন্দ্রীয় বিজেপির আগ্রহ এখন ভিন্ন মাত্রার। সেই আগ্রহে দার্জিলিং একটি গুরুতর তাস হইতে পারে। মোর্চার সাধারণ সচিব রোশন গিরি তো স্বতন্ত্র রাজ্যের দাবি লইয়া কেন্দ্রের পদক্ষেপ দাবি করিয়াছেন। তৃণমূল প্রশাসনের সাময়িক জয় কি সেই দ্বিপাক্ষিক ঘনিষ্ঠতার আগুনে ইন্ধন জোগাইবে না?

ইত্যবসরে পাহাড়ের উন্নয়নের প্রশ্নটি ক্রমশই আইডেন্টিটির রাজনীতির তলায় তলাইতে উদ্যত। পাহাড়ের প্রতি সমতলের বিমাতৃসুলভতা পুরাতন কথা। তবু গত কয়েক বৎসরে সেই অনাগ্রহ কমিতে দেখা গিয়াছে। সরকারি আগ্রহের ফাঁক দিয়া যে দুর্নীতি ও অনাচারের ফল্গুপ্রবাহ অবিচ্ছিন্ন ধারায় বহিয়াছে, সেই ধারা কখনও প্রবলা হইয়া মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙিয়াছে, তাহাও সত্য। এতৎসত্ত্বেও সরকারি মনোযোগ বাড়িতেছে, মন্ত্রীরা সশরীরে পাহাড়ে অবস্থা তদারকি করিতে যাইতেছেন, এইটুকুও তো সদর্থক পরিবর্তন। উল্টা দিকে, গোর্খা আন্দোলনের চরিত্রে কিন্তু কোনও সদর্থক পরিবর্তন নাই। সুবাস ঘিসিঙ্গ-এর আমলেও যেমন, এখনও তেমন, পাহাড়ি রাজনীতি মানেই পথঘাট, যোগাযোগ, জীবনযাপন বন্ধ করিবার রাজনীতি। পর্যটনশিল্প ও উন্নয়নের পায়ে কুড়াল মারিবার রাজনীতি। এই আত্মঘাতী মানসিকতা না পাল্টাইলে কোনও রাজনৈতিক অগ্রগতি অসম্ভব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE