Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

বিচারে এত দেরি কেন

আইনি পরিকাঠামোর এই বেহাল অবস্থা কেন? আদালতে যত মামলা রুজু করা হচ্ছে তার তুলনায় বিচারকের সংখ্যা কম। ফলে মামলার পর মামলা জমে, বিচারে দেরি হয়।

প্রতীক্ষা: আইনের ভিতরে ঢুকে তাকে স্বচ্ছ, স্ববিরোধহীন, নির্ভার ও যুক্তিসংগত করে তুলতে পারলে আদালতের গতি বাড়বেই। কলকাতা হাইকোর্ট।

প্রতীক্ষা: আইনের ভিতরে ঢুকে তাকে স্বচ্ছ, স্ববিরোধহীন, নির্ভার ও যুক্তিসংগত করে তুলতে পারলে আদালতের গতি বাড়বেই। কলকাতা হাইকোর্ট।

অভিরূপ সরকার
শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০১৭ ০৬:০০
Share: Save:

ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন, স্বাধীন ভারত নানা দিকে উন্নতি করলেও, আইনি পরিকাঠামোর দিক থেকে বিলক্ষণ পিছিয়ে। ফলে সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচার পেতে দেরি হচ্ছে, এবং ক্রমাগত মার খেয়ে যাচ্ছে আধুনিক ব্যবসাবাণিজ্য, যাকে অনেক রকম চুক্তির ওপর নির্ভর করতে হয়। চুক্তি থাকলে চুক্তি-খেলাপেরও সম্ভাবনা থাকে, আর চুক্তির খেলাপ ঘটলে আদালতই ভরসা। কিন্তু আদালতের কাজকর্ম শ্লথ হলে চুক্তিভঙ্গকারীকে চুক্তি অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য করানো সময় ও খরচ সাপেক্ষ ব্যাপার। এই ভবিষ্যৎ খরচের কথা মাথায় রেখে অনেক বিনিয়োগকারী, বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা, এ দেশে বিনিয়োগ করতে দ্বিধা করেন। স্বচ্ছন্দভাবে ব্যবসা করতে পারার সুযোগের নিরিখে লাস্ট বেঞ্চিতে বসে আছে আমাদের দেশ।

আইনি পরিকাঠামোর এই বেহাল অবস্থা কেন? আদালতে যত মামলা রুজু করা হচ্ছে তার তুলনায় বিচারকের সংখ্যা কম। ফলে মামলার পর মামলা জমে, বিচারে দেরি হয়। প্রায় তিন কোটি মামলা বিচারের অপেক্ষায় দেশের বিভিন্ন আদালতে জমে রয়েছে। অন্য দিকে ২১ হাজার বিচারক পদে আপাতত আসীন ১৬ হাজার বিচারক। অর্থাৎ ৫ হাজার বিচারক পদ খালি পড়ে আছে। সুপ্রিম কোর্টের দু’টি সাম্প্রতিক রিপোর্ট জানাচ্ছে, দেশের আইনি ব্যবস্থাকে সুষ্ঠু ভাবে চালাতে গেলে খালি পদগুলি ভর্তি করা ছাড়াও বাড়তি অন্তত ১৫ হাজার বিচারক নিয়োগ করা দরকার। প্রতি ১০ লক্ষ দেশবাসীর জন্য দরকার অন্তত ৫০ জন বিচারক।

কিন্তু বিচারক বা আদালতের সংখ্যা বাড়ালেই কি আমাদের আইনি ব্যবস্থার উন্নতি ঘটবে? বছরে কত দিন খোলা থাকে আদালত, মামলা এজলাসে উঠলেও কত দ্রুত তার নিষ্পত্তি ঘটে, এ সব প্রশ্ন অবশ্যই জরুরি, কিন্তু আরও জরুরি আইনি ব্যবস্থার জটিলতাগুলো বোঝা। বিচারক বা আদালতের সংখ্যা বাড়ানোর তুলনায় বিচারব্যবস্থার অন্তর্নিহিত দক্ষতা বাড়ানোটা কোনও অংশে কম জরুরি নয়।

জনসংখ্যার তুলনায় বা বকেয়া মামলার তুলনায় বিচারকের সংখ্যা কম কি না, কম হলে কতটা কম, এ সব বোঝার জন্য জানা দরকার, অন্যান্য দেশে এই অনুপাতগুলো কেমন। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রক জানিয়েছে, এ দেশে এখন প্রতি ১০ লক্ষ মানুষ পিছু ১৮ জন বিচারক আছেন। রাষ্ট্রপুঞ্জের এক সূত্র থেকে দেখছি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংখ্যাটা ৭, সিঙ্গাপুরে ২১, জাপানে ২৯। অর্থাৎ এই উন্নত দেশগুলোর মধ্যে আমেরিকায় মানুষ পিছু বিচারকের সংখ্যা ভারতের তুলনায় কম, অন্যগুলোতে খানিকটা বেশি হলেও মারাত্মক রকমের বেশি নয়। উল্টো দিকে চিলিতে সংখ্যাটা ১০৪, ইকোয়েডরে ১০০, আফ্রিকার অনুন্নত দেশ বুরুন্ডিতে ৪৩, টোগোতে ৩৪। পাশাপাশি জার্মানি ও ফ্রান্সে প্রতি ১০ লক্ষ মানুষের জন্য রয়েছেন যথাক্রমে ২৪৬ ও ৯০ জন বিচারক। তথ্যগুলি ২০১৫ সালের। স্পষ্টতই, উন্নয়ন কিংবা আইনি ব্যবস্থার দক্ষতার সঙ্গে জন-প্রতি বিচারকের সংখ্যার তেমন জোরালো কোনও সম্পর্ক নেই।

একই ধরনের গোলমেলে চিত্র দেখতে পাই বিচারক প্রতি জমে থাকা মামলার দিকে তাকালে। ভারতে এই মুহূর্তে বিচারক প্রতি জমে থাকা মামলার সংখ্যা ১৮৩। আমেরিকার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের মানব অধিকার ও উন্নয়ন সংক্রান্ত এক জার্নালে একটি প্রবন্ধে (২০১৪) মারিয়া ডাকোলিয়াস জানাচ্ছেন, চিলি ও ইকোয়েডরে বিচারক প্রতি জমে থাকা মামলা যথাক্রমে ৮১৮৭ ও ৭৭৬৮। আবার জার্মানি, ফ্রান্স ও সিঙ্গাপুরে সংখ্যাগুলো ১০০, ৭৯ ও ৫৬। জন-প্রতি বিচারকের সংখ্যার সঙ্গে জমে থাকা মামলারও তেমন একটা সম্পর্ক দেখছি না।

অতএব, শুধু বিচারকের সংখ্যা দিয়ে দেশের আইনি ব্যবস্থার উৎকর্ষ বা সীমাবদ্ধতার ব্যাপারটা বোঝা যাবে না। বুঝতে হবে দেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ইতিহাস, যার মধ্যে দিয়ে বিবর্তিত হয় দেশের আইন। ভারতীয় আইন ব্যবস্থার জটিলতাগুলো বুঝতে ব্রিটিশ আমলের ঔপনিবেশিক আইন বা তারও আগেকার হিন্দু এবং মুসলিম আইনগুলোর দিকে দৃষ্টি দেওয়া দরকার।

লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স-এর তীর্থঙ্কর রায় এবং উইলিয়ামস কলেজের আনন্দ স্বামী সম্প্রতি ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের আইনি বির্বতন নিয়ে একটি চমৎকার গবেষণা গ্রন্থ লিখেছেন। আইন প্রণয়নের ব্যাপারে ঔপনিবেশিক ইতিহাস কেন গুরুত্বপূর্ণ তার একটা হদিশ লেখকরা দিয়েছেন। ইংরেজরা যখন প্রথম এ দেশে আসে তখন ধর্মভিত্তিক কিছু আইন দেশে চালু ছিল। হিন্দুদের জন্য ছিল এক রকম আইন, মুসলিমদের জন্য আর এক রকম। তা ছাড়া এক-একটা অঞ্চলে এক-এক ধরনের রীতিনীতি, সামাজিক প্রথা যুগ যুগ ধরে চলে আসছিল। প্রথা-রীতিনীতি-ধর্মকে একেবারে বাদ দিয়ে ব্রিটিশদের পক্ষে আইন প্রণয়ন সম্ভব ছিল না। আবার প্রশাসনের স্বার্থে কিছু নতুন আইনেরও প্রয়োজন ছিল। তাই আমাদের ঔপনিবেশিক প্রভুরা পুরনো আইনগুলো মোটামুটি বজায় রেখে তার ওপরে যখন যেমন দরকার সেই রকম ব্রিটিশ কমন ল-র কিছু কিছু অধ্যায় চাপিয়ে দিলেন। ফলে বিভিন্ন আইনের মধ্যে সামঞ্জস্য রইল না, কিছু ক্ষেত্রে স্ববিরোধ তৈরি হল, কোনও কোনও বিষয় চলে এল একাধিক আইনের আওতায় এবং এক-একটি প্রদেশ তাদের স্থানীয় রীতিনীতি অনুযায়ী এক-এক রকম আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করতে থাকল। বাদী বা বিবাদীর কপালে, কোনও একটি আইনের কারণে নিম্ন আদালতে বিরূপ রায় জুটলে, তাঁরা অন্য কোনও আইনের আশ্রয় নিয়ে আবার লড়াই করার সুযোগ পেয়ে গেলেন। আপিলের প্রবণতা বাড়ল, আদালতে মামলা জমতে থাকল। অপরিকল্পিত ও অসতর্ক আইন প্রণয়নের একটা উদাহরণ চুক্তি আইন। এ-আইনকে শুধু যে ১৮৭২ সালের ইন্ডিয়ান কন্ট্র্যাক্ট অ্যাক্ট-এর ছত্রছায়ায় আনা হল তা-ই নয়, চুক্তির ওপর সিভিল প্রসিডিয়োর, নেগোশিয়েবল ইন্সট্রুমেন্টস, ল অন ওয়েজার অ্যান্ড গেম ইত্যাদি অন্য নানা রকম আইন প্রয়োগের কারণে চুক্তি আইন ক্রমশ জটিল হয়ে উঠল।

সনাতন রীতিনীতির ওপর বাইরে থেকে আইন চাপিয়ে দেওয়ার ফল সব সময় ভাল হয় না, প্রমাণ উনিশ শতকে পুণে ও আহমেদনগরের দাঙ্গা। প্রাক্-ব্রিটিশ যুগে ভারতের অন্য অঞ্চলের মতো এখানেও কৃষকরা ঋণের জন্য স্থানীয় মহাজনের ওপর নির্ভর করতেন। মহাজন চড়া সুদ নিতেন, কিন্তু ফসল খারাপ হলে ঋণশোধের জন্য পরের বছর অবধি অপেক্ষা করতেন। এতে মহাজন সুদটাও বেশি পেতেন আবার কৃষক মহাজনের কাছ থেকে এক রকম বিমা ও নিরাপত্তা উপভোগ করতেন, যার মূল্য বা প্রিমিয়াম ছিল চড়া সুদ। ইংরেজরা আসার পর ঋণদাতাদের দেওয়ানি আদালতে মামলা করে ঋণ ফেরত পাওয়ার সুযোগ হল, ঋণদাতার সংখ্যা বাড়ল, তাঁদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়ল। কিন্তু কৃষক-মহাজনের ব্যক্তিগত সম্পর্কটা ভেঙে গেল। যে নিরাপত্তাটা কৃষক উপভোগ করতেন সেটাও আর রইল না। ১৮৮৫ সালে কৃষিপণ্যের দাম মারাত্মক পড়ে যাওয়ার পর অসংখ্য কৃষক আইনের চোখে ঋণখেলাপি হয়ে গেল, তাদের নামে আদালতে মামলা রুজু হল। শেষে কৃষকদের অসন্তোষ একটা ভয়াবহ দাঙ্গার চেহারা নেয়।

ঔপনিবেশিক আইনের সব থেকে বড় সীমাবদ্ধতা ভূমি সংক্রান্ত আইন যার কুফল আজও চলছে। ইংরেজদের প্রধান লক্ষ্য ছিল ভূমি থেকে রাজস্ব আদায় করা। এই লক্ষ্য পূরণের স্বার্থে বিশেষ স্বচ্ছতা ও নির্মমতার সঙ্গে রাজস্ব জমা দেওয়ার আইনটি তৈরি করা হয়েছিল। অর্থাৎ রাজস্ব জমা দেওয়ার ব্যাপারে ভূস্বামীর দায়বদ্ধতা নিয়ে আইনে কোনও জটিলতা বা অস্পষ্টতা ছিল না। কিন্তু এর বেশি গভীরে ইংরেজরা ঢুকতে চায়নি। জমি সংক্রান্ত জটিলতাগুলো, বিশেষ করে জমির স্বত্ব ও উত্তরাধিকার নিয়ে, ভাগচাষির অধিকার ও দায়িত্ব নিয়ে, জমিদারর-প্রজা-র বিরোধ নিয়ে নানা আইনি অস্পষ্টতা ঔপনিবেশিক আইনে থেকে গিয়েছিল যার প্রভাব থেকে ভারতীয় আইন আজও মুক্ত নয়।

ঔপনিবেশিক আইনের কুপ্রভাব থেকে ভারতীয় আইন ব্যবস্থা কীভাবে বেরিয়ে আসতে পারে সেটা আইনজ্ঞরা ঠিক করবেন। আমরা শুধু বলছি, আইনি সংস্কার মানে কেবল আদালত বা বিচারকের সংখ্যা বাড়ানো নয়, আইনের ভিতরে ঢুকে তাকে স্বচ্ছ, স্ববিরোধহীন, নির্ভার ও যুক্তিসংগত করে তোলা। এমনটা ঘটলে আদালতের গতি বাড়বেই।

সূত্র: Law and the Economy in Colonial India, Tirthankar Roy and Anand V Swami, University of Chicago Press, 2016.

The Hazards of Piecemeal Reform, Rachel Kranton and Anand V Swami, Journal of Development Economics, 1999.

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Supreme Court Verdict Judgement legal system
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE