শেষ অবধি মহারাষ্ট্রের প্রেক্ষাগৃহেও ‘টাইগার জিন্দা হ্যায়’ চলিতেছে। অভিজ্ঞ জনেরা বলিবেন, সিনেমাটির নির্মাতারা শিবসেনা ও মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনার সহিত যথার্থ পথে সমঝোতা করিয়া লইতে পারিয়াছেন। তবে, প্রশ্ন কোনও একটি সিনেমার মুক্তি পাওয়া অথবা না পাওয়া লইয়া নহে। এমনকী, বলিউড বনাম স্থানীয় সিনেমার বাজার দখলের লড়াইয়ে রাজনৈতিক দলের জড়াইয়া পড়া লইয়াও নহে। তেমন ঘটনা এই প্রথম ঘটে নাই— গোটা দেশেই বলিউডের ছবি কোনও না কোনও সময় এই গোত্রের রাজনৈতিক বিরোধিতার মুখে প়়ড়িয়াছে। বিচ্ছিন্ন ভাবে দেখিলে, অতএব, বর্তমান ঘটনাটিতে নূতন কিছু নাই। কিন্তু, সেই দেখা নেহাতই খণ্ডদর্শন হইবে। ঠিক কোন পরিস্থিতিতে ‘টাইগার জিন্দা হ্যায়’-কে হুমকি দেওয়া হইল, তাহা খেয়াল না করিলেই নহে। দিন কয়েক পূর্বে বেঙ্গালুরুতে সানি লিওন-এর অনুষ্ঠান বাতিল করিতে হইয়াছে, কারণ তাহা ‘ভারতীয় সংস্কৃতি’র পরিপন্থী। আবার, দিন কতক পরে হিন্দুত্ববাদীরা হুমকি দিল, বড়দিন উদ্যাপন করিলে মার খাইতে হইবে। রাজস্থানে অভিবাসী শ্রমিককে পুড়াইয়া মারিয়া সেই ভিডিয়ো ইন্টারনেটে ছড়াইয়া দেওয়া হইল। ঘটনাগুলি আপাতদৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন, কর্নাটকের সহিত রাজস্থানের, অথবা মহারাষ্ট্রের সহিত উত্তরপ্রদেশের ভৌগোলিক দূরত্ব কম নহে। কিন্তু, বিনা সুতার মালা যাহা দিয়া গাঁথা, তাহার নাম অসহিষ্ণুতার আগ্রাসন। সেই আগ্রাসন নূতন দিগন্ত জয়ে উদ্যত। হিন্দুত্ববাদী উগ্র জাতীয়তাকে ভারতের মানুষ যতখানি জায়গা ছাড়িয়াছে, সেই পরিসরটি ক্রমে বাড়াইয়া লইতে চাওয়াই এখন এই আগ্রসনের লক্ষ্য। ইহাই নূতন। এবং, ইহাই মারাত্মক।
‘টাইগার জিন্দা হ্যায়’ ছবিটির নায়ক সলমন খান না হইয়া কোনও হিন্দু হইলেও ঠিক এতখানিই বাধা তৈরি করা হইত কি না, সেই প্রশ্ন উঠিতেছে। প্রশ্নটি অমূলক নহে। ভারতের ন্যায় দেশে, যেখানে বলিউড কার্যত ধর্মের মর্যাদা পাইয়া থাকে, সেখানেও চলচ্চিত্রের নায়ককে তাহার ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে নাকাল হইতে হয়। কিন্তু, এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয়, আক্রমণটি ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে আসে নাই— আঞ্চলিকতা ও ভাষার ছদ্মবেশে আসিয়াছে। প্রবণতাটি দ্বিঘাত বিপজ্জনক। এক, যাঁহারা শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের রাজনীতি হইতে দূরত্ব রাখিতে চাহেন, তাঁহাদেরও অনেককে এই রাজনীতিতে জড়াইয়া লওয়া যাইবে। দুই, ধর্মের চোরা উসকানিতে আঞ্চলিকতার বিষও তীব্রতর হইয়া উঠিবে, এবং তাহা শেষ অবধি বিভেদের খেলাকেই উত্তরোত্তর শক্তি জোগাইবে।
সম্প্রতি অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু এক ভাষণে বলিলেন, এই মুহূর্তে ভারতের বৃহত্তম দুশ্চিন্তার কারণ এই অসহিষ্ণুতা। ‘অপর’-কে তিলমাত্র না ছাড়িবার এই প্রবণতাটিই ভারতকে ক্রমে হিংস্র, ভয়াবহ করিয়া তুলিতেছে। দুর্ভাগ্য, প্যারিসে সন্ত্রাসবাদী হানার ঘটনায় যিনি নিমেষের মধ্যে নিজের প্রতিক্রিয়া জানাইয়া দিতে পারেন, সেই নরেন্দ্র মোদী দেশের ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতার প্রশ্নে চর্চিত নীরবতা বজায় রাখেন। বস্তুত, এই অসহিষ্ণুতায় যে তাঁহার সম্মতি আছে, কেহ তেমনটি অনুমান করিতেই পারেন। অতএব, রুখিয়া দাঁড়াইবার দায়িত্বটি মূলত সমাজের, এবং বিরোধী রাজনীতির। কিন্তু, প্রতিরোধ করিতে হইলে সর্ব ক্ষেত্রেই করিতে হইবে। গৌরী লঙ্কেশকে হত্যা করা হইলে প্রতিবাদ করিব, কিন্তু সানি লিওন-এর অনুষ্ঠান বাতিল করিতে বাধ্য করা হইলে অন্য দিকে চাহিয়া থাকিব— এই দ্বিচারিতার নীতিতে লাভ হইবে না। স্মরণে রাখিতে হইবে, এক একটি ঘটনায় এক এক জন আক্রান্ত হইতে পারেন, কিন্তু প্রতিটি আক্রমণই ভারতীয় গণতন্ত্রের মূলে আঘাত করিতেছে। এবং, সেই কারণেই প্রতি ক্ষেত্রে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ জরুরি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy