দুইয়ের বেশি সন্তান থাকলে সরকারি চাকরি মিলিবে না, পঞ্চায়েত বা পুরসভার নির্বাচনে প্রার্থী হওয়াও চলিবে না। খসড়া জনসংখ্যা নীতিতে এমনই প্রস্তাব দিল অসম সরকার। এক কথায়, এই প্রস্তাব নৈতিক দৃষ্টির দিক দিয়া অন্যায়, প্রশাসনিক বিবেচনায় অকারণ উৎপীড়ন। সত্তরের দশকে কংগ্রেস সরকার জন্মনিয়ন্ত্রণ নীতি জোর করিয়া আরোপ করিবার ফলে দেশের মানুষ উপযুক্ত রাজনৈতিক উত্তর দিয়াছিল। নীতির উদ্দেশ্য যতই মহৎ হউক, তাহার প্রয়োজন যতই তীব্র হউক, নাগরিককে শাস্তি দিবার, অধিকার হইতে বঞ্চনা করিবার উদ্দেশ্যে সরকারি নীতি ব্যবহার করা অগণতান্ত্রিক। নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার সকল নাগরিককে সংবিধান দিয়াছে। এক একটি রাজ্যের সরকার এক এক রকম শর্ত চাপাইয়া তাহাকে সীমিত করিবে কেন? সরকারি চাকরি পাইবার যে সকল শর্ত, তাহা মেধা ও দক্ষতা যাচাই করিবার জন্য। সেখানে সন্তানসংখ্যা বিচার্য হইতে পারে না। আক্ষেপের বিষয়, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রসঙ্গটি উঠিলে প্রায়ই চিনের ‘এক-সন্তান নীতি’-র দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়। চিন যে দ্রুত জনসংখ্যা কমাইয়াছে, তাহা অমানবিক, উৎপীড়ক নীতির সাফল্য বলিয়া দাবি করা হয়, এবং তদনুরূপ কোনও কঠোর নীতির পক্ষে সওয়াল করা হয়।
ঘটনা হইল, চিন গণতন্ত্র নহে। সেখানে নাগরিকের জীবনে ও জীবিকায় রাষ্ট্রের প্রায় সর্বময় কর্তৃত্ব। ফলত চিন যাহা করিয়াছে, ভারতের জন্য তাহাই দিগদর্শন হইতে পারে না। আর চিনই তো কেবল জনসংখ্যা কমায় নাই। বিশ্বের প্রায় সকল উন্নত দেশ, এমনকী ভারতেরও অনেকগুলি রাজ্য দ্রুত জন্মহার কমাইয়াছে। সেই সকল স্থানে সন্তানসংখ্যা কমাইতে শাস্তির প্রয়োজন হয় নাই। নারীশিক্ষায় বৃদ্ধি, শিশুমৃত্যু হারে হ্রাস এবং উন্নত স্বাস্থ্য পরিষেবা, জন্মহার কমাইতে এইগুলি যে সর্বাপেক্ষা কার্যকর, তাহা আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য। অথচ সাম্প্রতিকতম জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা অনুসারে, মেয়েদের স্কুলশিক্ষা সম্পূর্ণ করিবার হার হইতে আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবহারের হার, সকল বিষয়েই জাতীয় গড়ের চাইতে অনেকটা পিছাইয়া আছে অসম। গ্রামীণ এলাকায় অর্ধেক শিশুরও টিকাকরণ সম্পূর্ণ হয় নাই। অনাবশ্যক পীড়ন না করিয়া অসম সরকার বরং আবশ্যিক কর্তব্যগুলি করুক। জনসংখ্যা কমাইবার পরীক্ষাসিদ্ধ উপায়গুলি গ্রহণ করুক।
অসমে পৃথক জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নীতির প্রয়োজন কী, সে প্রশ্নও থাকিয়া যায়। ভারতের জাতীয় জনসংখ্যা নীতি রহিয়াছে। অপর একটিই রাজ্য নিজস্ব নীতি গ্রহণ করিয়াছে, তাহা রাজস্থান। অসমে জন্মহার ২.২, যাহা জাতীয় গড়ের সমান, প্রার্থিত হারের (২.১) কাছাকাছি। অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করিয়াছেন, অসমে নীতির পশ্চাতে আসলে রাজনীতি। মুসলিম পরিবারে সন্তান অধিক, এই ধারণা হইতে অসমের বিজেপি সরকারের এই পীড়নমূলক নীতি। প্রস্তাবিত নীতিটি নারী-উন্নতির দিক দিয়াও অন্যায়। সন্তানসংখ্যা বিষয়ে মেয়েদের সিদ্ধান্ত লইবার সুযোগ আজও সীমিত। যাহা মেয়েদের ‘দোষ’ নহে, তাহার জন্য রাজনীতি ও সরকারি চাকরির মেয়েদের সুযোগ মিলিবে না, ইহা কেমন নীতি? বরং মেয়েদের কর্মক্ষেত্রে যোগদান এবং রাজনীতিতে অংশগ্রহণ বাড়াইবার জন্য নীতি জরুরি। দুই-সন্তান নীতির প্রস্তাব দিয়া অসম সরকার বিপরীতমুখে হাঁটিতেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy