Advertisement
১৯ মে ২০২৪

কাকে বলে নৈতিকতা?

বাস্তবিক তিনি যদি নৈতিকতার প্রহরী হতেন তা হলে দেশের এই ঘোর দুর্দিনে, রাজনৈতিক মূল্যবোধের চরম অবনমনের কালে নিজেকে প্রতিরোধের প্রতীক করে তুলতে পারতেন।

ফেরা: শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বিহারের থেকে-যাওয়া মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার ও ফিরে-আসা উপমুখ্যমন্ত্রী সুশীল মোদী। পটনা, ২৭ জুলাই। ছবি: পিটিআই

ফেরা: শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বিহারের থেকে-যাওয়া মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার ও ফিরে-আসা উপমুখ্যমন্ত্রী সুশীল মোদী। পটনা, ২৭ জুলাই। ছবি: পিটিআই

কুমার রাণা
শেষ আপডেট: ২৮ জুলাই ২০১৭ ০৭:১০
Share: Save:

অবগুণ্ঠনটাও অপসৃত। যে নীতীশ কুমার বার বার নৈতিকতার প্রতিমূর্তি হিসেবে আত্মমুগ্ধ, তিনিই ক্ষমতার মোহে বিজেপির কাছে আত্মসমর্পিত। নৈতিকতার প্রশ্ন তুলে, দুর্নীতিমুক্ত সরকার গড়ার দায়বোধে, তাঁর পদত্যাগ। রাজনীতির পরিহাস, তেজস্বী যাদব ও তাঁর পিতা লালু যাদবকে তিনি দুর্নীতিপরায়ণতা ও ক্ষমতালিপ্সার অভিযোগে অভিযুক্ত করে বিহারে মহাজোট ভেঙে দিলেন, কিন্তু সেই ক্ষমতার টানে নীতীশ কুমার নিজেই বিজেপির পাতা ফাঁদে বন্দি। পিচ্ছিল পথে পা তিনি আগেই বাড়িয়েছিলেন, গত নভেম্বরে মোদী সরকারের বিমুদ্রাকরণ পদক্ষেপ যখন স্বদেশে-বিদেশে, রাজনৈতিক-আর্থনীতিক মহলে তীব্র সমালোচনার মুখে, তখন নীতীশ কুমার নোট অচল করার সমর্থনে ঊর্ধ্ববাহু। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিজেপি প্রার্থীকে সমর্থন করে বিজেপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে নেওয়া। এ বার বৃত্ত সম্পূর্ণ।

বাস্তবিক তিনি যদি নৈতিকতার প্রহরী হতেন তা হলে দেশের এই ঘোর দুর্দিনে, রাজনৈতিক মূল্যবোধের চরম অবনমনের কালে নিজেকে প্রতিরোধের প্রতীক করে তুলতে পারতেন। কিন্তু, ক্ষমতার আকর্ষণ অতি প্রবল। অতএব, যে বিজেপির রাজনীতি আজ ভারতের অন্তরাত্মাকেই হত্যা করে চলেছে তার সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকতে তাঁর বিবেক নৈতিকতার দংশন অনুভব করল না। বহুত্বের উপর আক্রমণ, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে ধ্বংস, বাক্‌স্বাধীনতা লুণ্ঠনের কথা যদি তিনি ছেড়েও দেন, বিজেপির ঘোর অনৈতিকতাগুলোও তাঁর চোখে পড়ল না? অনৈতিকতার অভিযোগ তো বিস্তর। কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। ব্যপম কেলেঙ্কারির মামলায় সিবিআই মধ্যপ্রদেশ সরকারকে অব্যাহতি দিয়েছে। বিজেপি-শাসিত মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ, অসমে বহু মামলায় সিবিআই-এর তদন্ত শম্বুকগতিতে এগোচ্ছে— মামলাগুলোতে অভিযুক্তরা হয় বিজেপির লোক, নয় তার কাছের। মধ্যপ্রদেশ সরকারের মন্ত্রী নরোত্তম মিশ্র টাকা দিয়ে খবর করানো এবং নির্বাচন কমিশনের কাছে ভুল তথ্য দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত, নির্বাচন কমিশন তাঁর নির্বাচন বাতিল করেছে, অথচ, তিনি মন্ত্রিত্বে বহাল। উমা ভারতীর বিরুদ্ধে বাবরি মসজিদ ভাঙার অভিযোগ, তিনিও বহাল তবিয়তে। সংবাদে প্রকাশ, মধ্যপ্রদেশে ব্যপম মামলায় জড়িতদের মধ্যে দু’কুড়িরও বেশি লোকের ‘রহস্যজনক’ মৃত্যু হয়েছে; খুন হয়েছেন পেশার প্রতি বিশ্বস্ত সাংবাদিক।

নীতীশ যদি সত্যই নীতিমান হতেন তা হলে বিজেপির রাজনৈতিক আদর্শের মধ্যে শেকড় গেড়ে বসে থাকা অনৈতিকতার বিরুদ্ধে সামনে দাঁড়িয়ে লড়াই করতেন। তাঁর প্রতি বিহারের জনসাধারণের যে আদেশ ছিল বিজেপি-বিরোধী সরকার গড়ার, সে আদেশকে উপেক্ষা না করে রাজনীতির দিশামুখ নৈতিকতার দিকে ঘোরানোর পথ খুঁজতেন। বিহারবাসী ভোট দিয়েছিল— নীতীশ কুমারকে নয়— বিজেপির প্রতিস্পর্ধী একটি জোটকে, সেই জোট ভেঙে যাওয়ার পর তা থেকে পাওয়া সমর্থনকে নিজের বলে দাবি করে বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার গড়ার দাবি করেন কোন নৈতিকতায়? তাঁর নীতিবোধ যদি প্রকৃতই জোরালো হত তা হলে তো তিনি জোটের সব চিহ্ন মুছে নতুন করে নির্বাচন দাবি করতেন।

তিনি বলছেন, যা করছেন, বিহারের স্বার্থে করছেন। প্রথমত, দেশ যেখানে সর্বনাশের কিনারায় সেখানে বিহারের স্বার্থের কথা বলে তিনি কী বোঝাতে চান? এটা নৈতিকতা, না সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থ? দ্বিতীয়ত, বিহারের স্বার্থ দেখার অনেক সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন, কিন্তু ভূমি সংস্কার, শিক্ষা সংস্কার, স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নতি, মিড-ডে মিল, অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্প, খাদ্য সুরক্ষা, কর্ম-নিশ্চয়তা— নানা দিক দিয়ে বিহারবাসীর জীবনমানের প্রকৃত উন্নতি ঘটানোর দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা দাবি পূরণের কর্তব্যটা পালনের ব্যাপারে যথেষ্ট দৃষ্টিপাত না করে আগাগোড়া ভোটের পাটিগণিত কষে গিয়েছেন। তথ্যপ্রমাণ স্পষ্ট জানায় যে, বিহারের নবনির্মাণের স্লোগান, আসলে ইট-সিমেন্টের জয়গান। রাজ্যের মোট উৎপাদন অনেক দিন ধরে বার্ষিক ১১ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাওয়াটা, অর্থশাস্ত্রীরা দেখিয়েছেন, আসলে সেতু, রাস্তা, বাড়ি বানাবার জন্য সরকারি ব্যয়ের ফল, মানুষের সাধারণ সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য যা যা করা দরকার, এবং করা সম্ভব ছিল, নীতীশ সে দিকে মনই দেননি।

লালুপ্রসাদ যাদবের পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি নতুন ব্যাপার নয়। দলে পারঙ্গম অনেক নেতা থাকা সত্ত্বেও তিনি ক্ষমতায় বসালেন পত্নীকে। ২০১৫-তে মহাজোট মন্ত্রিসভা গড়বার সময়ও, মানুষ বা রাজনীতি নয়, তাঁর ভাবনা জুড়ে তাঁর আত্মজরা— এক জন উপমুখ্যমন্ত্রী, অন্য জন মন্ত্রী। দেশের মানুষ যখন চাইছিলেন তাঁর পুত্র তেজস্বী পদত্যাগ করে উচ্চ নৈতিক আদর্শ বজায় রাখুন, লালু সেই কামনাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে পুত্র-পক্ষ অবলম্বন করলেন। তেজস্বীর ছন্দোবদ্ধ বিবৃতি, ‘তেজস্বী এক বহানা থা, উনকো বিজেপি মেঁ যানা থা’। সেটা মিথ্যা নয়— ঘটনাপ্রবাহ দেখায়, নীতীশ-বিজেপি সাঁট-গাঁট আগে থেকেই চলছিল। কিন্তু তা যখন জানাই ছিল, তখন তাঁর বিজেপিতে যাওয়াটাকে দুর্নীতি-বিরোধী মহিমায় মুড়ে নেওয়ার সুযোগটাই বা দেওয়া কেন? তেজস্বী নিজেই তো আগেভাগে পদত্যাগ করে নীতীশের সুযোগসন্ধানী স্বরূপটা উদ্ঘাটিত করে দিতে পারতেন।

নীতীশ সুযোগ ছাড়েননি। তিনি বুঝে গিয়েছিলেন মোদীর বিরুদ্ধে লড়বার দম তাঁর নেই। ২০১৩-তে যে মোদীর বিরোধিতা করে এনডিএ ছেড়েছিলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে’ সেই মোদীর করুণাকাঙ্ক্ষী হতেও তাঁর দ্বিধা নেই, বিবেকের কম্পন নেই। পরিবারতন্ত্র, দুর্নীতি, ইত্যাদির বিরুদ্ধে লড়বার জন্য, শিশুও জানে, বিজেপি আদৌ কোনও মঞ্চ নয়। যেখানে এক ব্যক্তির ইচ্ছা অনিচ্ছায় দল-সরকার-সমাজ-রাজনীতির ঘূর্ণন সেখানে নীতিকেন্দ্রিক রাজনীতির যে স্থান নেই সেটা কারও অজানা থাকার কথা নয়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইটা যদি লড়তেই হয় তা হলে তো সর্বপ্রথম একনায়কত্বের বিরুদ্ধে লড়তে হয়। নীতীশ সেই রণে ভঙ্গ দিয়ে স্বল্পমেয়াদি এবং ব্যক্তিগত লাভের আশায় আত্মসমর্পণের পথটাই বেছে নিলেন।

সম্ভবত এটাই হওয়ার ছিল। নীতীশ কোনও দিনই নীতি নিয়ে ভাবিত ছিলেন না। বরাবরই তাঁর সামনে ছিল বিহারের মসনদের স্বপ্ন।
২০১৩-তে তাঁর কল্পনায় দিল্লির সিংহাসনের ছায়া, সেই বিভোরতায়, এনডিএ-র সঙ্গে অনিচ্ছুক বিচ্ছেদ। অনিচ্ছুক, কারণ, তাঁর রাজনৈতিক ধ্যানধারণা, অন্তত আর্থনীতিক ক্ষেত্রে, বিজেপির সঙ্গেই মেলে। মানুষের সক্ষমতার বিকাশ নয়, তাঁর আরাধ্য জিডিপি বৃদ্ধির হার। তা সত্ত্বেও বিচ্ছেদের প্রধান বা একমাত্র কারণ, মোদীর ক্রমশ সর্বশক্তিমান হয়ে ওঠাটা সহ্য করতে না পারা, ব্যক্তিগত ঈর্ষায় কাতর হয়ে পড়া। কিন্তু স্বপ্ন ও শক্তির সংযোগ না ঘটলে যা হয়, নীতীশের ক্ষেত্রে তা-ই হল, তাঁকে বিহার রাজ্যেই নিজের রাজনৈতিক উচ্চাশা সীমাবদ্ধ রাখতে হল। সেখানেও মুশকিল— দলীয় বিধায়কের সংখ্যাল্পতা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রিত্ব করার প্রাত্যহিক ঝকমারি, লালুপ্রসাদ ও তাঁর পুত্রদ্বয়ের সব ব্যাপারে ছড়ি ঘোরানো। তা থেকে মুক্ত হওয়ার যে সুযোগটা তিনি খুঁজছিলেন, লালুপ্রসাদের পারিবারিক রাজনীতি সেটা রুপোর রেকাবিতে সাজিয়ে দিল।

নীতি নয়, সততা বা দেশসেবা নয়, ভারতীয় রাজনীতিতে ক্ষমতার অবিমিশ্র কামনার যে অবিরাম দৌরাত্ম্য, নীতীশ কুমার সেটাকেই বৈধতা দিলেন। বিহার-রাজনীতি, ভারতকে বার বার গণতন্ত্রের পথ দেখিয়েছে। ইতিহাসের পরিহাস, সে আজ নিজেই নীতীশের নীতিহীনতা এবং লালুর পরিবারতন্ত্রের হাতে বন্দি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE