রুশতী সেনের লেখা ‘রতনের থেকে বহু দূরে’ (১৭-৭) প্রবন্ধটি খুবই প্রাসঙ্গিক। শেখার পরিবেশের সঙ্গে জানার ইচ্ছে গভীর ভাবে সম্পর্কযুক্ত। অথচ, শিক্ষাঙ্গনে সেই পরিবেশ কী ভাবে ক্রমাগত নষ্ট হয়েছে, হচ্ছে, সে বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই। স্কুলে পড়াশোনার পরিবেশ এই একুশ শতকেও নানা ভাবে বিপর্যস্ত। একটা সময় পড়ুয়াদের বেশির ভাগ সময় কাটত খেলাধুলা এবং পড়াশোনার মধ্যে। বিনোদনের জন্য থাকত বাড়ির রেডিয়োতে গান শোনা কিংবা পাড়ায়, গ্ৰামের কোনও বাড়িতে গিয়ে একটু টিভি দেখা। পড়ুয়াদের চিন্তা, ভাবনা, কল্পনার অবকাশ ছিল বিস্তর। কিন্তু সেই দিন আর নেই। কারণ, সমাজমাধ্যমের বিপুল রমরমা বর্তমান শিক্ষার্থীদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। সারা পৃথিবীর বিনোদনের উপকরণ আজ তাদের হাতের মুঠোয়। উঁচু ক্লাসে উঠলেই পড়ুয়ারা সরকারি আনুকূল্যে স্মার্টফোন হাতে পেয়ে যাচ্ছে। স্কুল, কলেজ চত্বরে তাদের হাতে বইয়ের পরিবর্তে স্মার্টফোন। বইয়ের জগৎ, খেলার মাঠ ভুলে এই কৃত্রিম জগতে তাদের মন ডুবে আছে সর্বক্ষণ। দেড় দশকের শিক্ষকতা জীবনে দেখেছি, প্রযুক্তি এবং বিভিন্ন সমাজমাধ্যম শিক্ষার্থীদের হাতের মুঠোয় আসার পর তাদের মানসিকতায় পরিবর্তন এসেছে। প্রবন্ধকারও নিশ্চিত ভাবেই সেই পরিবর্তন লক্ষ করেছেন।
এর সঙ্গে আর একটি উদাহরণ দিই। আমার স্কুলে প্রাক্-মাধ্যমিক শ্রেণির ক্লাসে নাম, ঠিকানা ইংরেজিতে লিখতে বলার কিছু ক্ষণ পর এক ছাত্রী সহাস্যে বলল, এ সব লিখতে তার বাড়ির লোকেরাও বলে। তার এই হাসির কারণ খুবই অর্থবহ। আজও, কনে নির্বাচনের মাপকাঠি হিসেবে নিজের নাম, ঠিকানা লেখা এক রকম ডিগ্ৰি স্বরূপ। পড়াশোনায় তার জ্ঞান অর্জন কতটা হয়েছে, তা জানতে চায় না কেউ। এক শ্রেণির শিক্ষকের উন্নাসিক মানসিকতা পড়াশোনার পরিবেশকে বন্ধুত্বপূর্ণ হতে দেয়নি ঠিকই, কিন্তু পাশাপাশি শিক্ষাব্যবস্থায় ভুল শিক্ষানীতির প্রয়োগ এর জন্যে কি দায়ী নয়? এক সময় শহর কলকাতা থেকে বহু ছাত্রছাত্রী সুন্দরবনের কয়েকটি নামী প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতে যেত। সর্বভারতীয় বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় এই সব স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা মেধাতালিকায় স্থান লাভ করত। শুধু তা-ই নয়, স্কুলগুলিতে আনন্দময় পরিবেশে, শৃঙ্খলায় পাঠ চলত। সেই সব স্কুল আজ শিক্ষকের অভাবে ভুগছে, হস্টেলগুলি চালু রাখা দায় হয়ে পড়েছে।
কেন এই হাল? শিক্ষক বদলি করতে গিয়ে এক সময় গ্ৰামের স্কুলগুলি ফাঁকা হয়ে গেল। প্রচুর শিক্ষক শহরমুখী হয়ে গেলেন। অথচ, এত শিক্ষকের শূন্যস্থান কবে পূরণ হবে, কেউ জানে না। এই বৈষম্য দূর করা না গেলে আজকের রতনরাও চেয়ে থাকবে পোস্টমাস্টারের (শিক্ষকের) আশায়।