E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: অবহেলার কুম্ভমেলা

এ বার ছিল মহাকুম্ভ। তিথি-নক্ষত্র অনুসারে আবার ১৪৪ বছর পরে এমন মাহাত্ম্যযুক্ত কুম্ভস্নানের সুযোগ মিলবে। তাই ধর্মপ্রাণ ভারতীয়রা পুণ্যস্নানের জন্য আসতে চেয়েছিলেন প্রয়াগরাজে। এসেও ছিলেন সমগ্র দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নাগরিক।

শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০২৫ ০৪:১২

‘পরমায়ুপ্রার্থী’ (১৯-২) শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রসঙ্গে এই চিঠি। কুম্ভমেলা ফেরত আমার পরিচিতদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সম্পাদকীয় বক্তব্য সাযুজ্যপূর্ণ। ভারতভূমিতে সুপ্রাচীন কাল থেকে চলে আসা কুম্ভমেলায় প্রতি বারই অল্পবিস্তর দুর্ঘটনা ঘটেছে। প্রতি বারই বিপুল সংখ্যক পুণ্যার্থীর মধ্যে ছোটবড় দুর্ঘটনায় কিছু জন আহত হয়েছেন, কখনও প্রাণহানিও ঘটেছে। কিন্তু ২০২৫-এর প্রয়াগরাজে পুণ্যার্থীদের নাজেহাল ও দুর্দশাগ্রস্ত হওয়ার ক্ষেত্রে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

এ বার ছিল মহাকুম্ভ। তিথি-নক্ষত্র অনুসারে আবার ১৪৪ বছর পরে এমন মাহাত্ম্যযুক্ত কুম্ভস্নানের সুযোগ মিলবে। তাই ধর্মপ্রাণ ভারতীয়রা পুণ্যস্নানের জন্য আসতে চেয়েছিলেন প্রয়াগরাজে। এসেও ছিলেন সমগ্র দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নাগরিক। কিন্তু সরকারি প্রচারে জনগণকে কুম্ভমেলায় আহ্বান করার ক্ষেত্রে যে বিপুল উৎসাহ দেখা গিয়েছিল, তার সাপেক্ষে মেলায় আগত যাত্রী ও পুণ্যার্থীদের স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে ততটা নজর ছিল না। বিশেষত প্রয়াগরাজ যাতায়াতের ট্রেন ব্যবস্থাপনায় ছিল চূড়ান্ত গাফিলতি। প্রতিটি স্টেশনে প্রতি দিন ট্রেনের অব্যবস্থার শিকার হয়েছেন অগণিত অসহায় মানুষ। খাস দিল্লি স্টেশনেই অন্তত ১৮ জন কুম্ভযাত্রী অকালে প্রাণ হারিয়েছেন। কুম্ভ চলাকালীন তাই বার বার জনতার ক্ষোভ আছড়ে পড়েছে ওই ট্রেনের উপরেই। তাঁরা প্রকাশ্যে ভাঙচুর করেছেন ট্রেনের মতো এক গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পত্তি। আর বড়সড় বিক্ষোভের আশঙ্কায় রেলের নিরাপত্তা রক্ষীরা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে বাধ্য হয়েছেন। ভুক্তভোগীরা বলেছেন, রেল স্টেশনগুলিতে বিপুলসংখ্যক যাত্রীকে সামাল দেওয়ার পরিকল্পনা ও উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার অভাব এতটাই ছিল যে, আরও বড় কোনও দুর্ঘটনা ঘটতেই পারত। সৌভাগ্যের যে, তা ঘটেনি।

সেই সঙ্গে কুম্ভে আগত যাত্রীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিষয়টিও ভীষণ উপেক্ষিত ছিল। খোদ কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ফেব্রুয়ারির রিপোর্টে ছিল, কুম্ভের জল স্নানযোগ্য নয়। মেলা সন্নিহিত নদীর জলে কলিফর্ম জীবাণুর উপস্থিতিও মানবস্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক বলে রিপোর্ট পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু ‘সব কিছু ঠিক আছে’— বলে যোগী আদিত্যনাথের প্রশাসন বার বার ন্যায়সঙ্গত অভিযোগগুলিকেও খারিজ করেছে। জানি না, কালকূট বেঁচে থাকলে এমন বিভীষিকাময় যাত্রাপথে অমৃত কুম্ভের সন্ধানে ঝোলা কাঁধে বার হওয়া ঝুঁকি আবার নিতেন কি না।

কৌশিক চিনা, মুন্সিরহাট, হাওড়া

প্রাণের মূল্য

দিল্লি স্টেশনে পদপিষ্ট হয়ে ১৮ জনের মৃত্যুর ঘটনার কথা স্বীকার করতেই ১৭ ঘণ্টা পার করে দেয় রেল মন্ত্রক। এত বড় ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও স্বয়ং রেলমন্ত্রী টুইট করেছিলেন যে, পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আছে। তা হলে পুরো বিষয়টি কি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টায় ছিল কেন্দ্রীয় সরকার! স্পষ্টতই রেলের পরিচালন ব্যবস্থার অপদার্থতার জন্যই ১৮ জনকে প্রাণ দিতে হল। এ বারের কুম্ভমেলায় যে কোটি কোটি মানুষের সমাগম হবে, সেটা জানাই ছিল। কেন্দ্রীয় সরকারও ধারাবাহিক প্রচার চালিয়েছিল মানুষকে আসার ব্যাপারে উৎসাহ দিতে । অথচ, বাস্তবে সেই ভিড় সামলানোর মতো কোনও পরিকাঠামো সরকারের জানা ছিল না। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়ে গেল। প্রাণহানি এড়ানো গেল না। কুম্ভমেলায় দেশের বহু ভিআইপি-কে স্নান করতে দেখা গেছে। এঁদের মধ্যে আছে যেমন রাজনৈতিক নেতানেত্রী, তেমনই বলিউডের নায়ক-নায়িকা শিল্পপতি খেলোয়াড়— আরও কত! তাঁদের জন্য কত নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা। অথচ, এর পাশাপাশি সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার ন্যূনতম আয়োজনটুকু করা হল না। যার জন্য অকালে ঝরে গেল বেশ কিছু প্রাণ। প্রমাণ হল, দেশে সাধারণ মানুষের প্রাণের মূল্য না থাকলেও ভিআইপি-দের প্রাণের মূল্য অপরিসীম।

রতন চক্রবর্তী, উত্তর হাবড়া, উত্তর ২৪ পরগনা

দায়িত্বজ্ঞানহীন

প্রয়াগরাজের মহাকুম্ভে এ বার যাঁরা ডুব দিয়ে এলেন, তাঁরা আবার আগামী দিনের অর্ধকুম্ভ বা পূর্ণকুম্ভে আদৌ ডুব দিতে পারবেন কি না, তা অনিশ্চিত অনিত্য এই জীবনে। সুতরাং, এই পুণ্যতীর্থে যোগদানের জন্য ছিল প্রচারের বিপুল ঢক্কানিনাদ। পুণ্যডুব দেওয়ার জন্য পুণ্যার্থীরাও পাগলপারা হয়ে ছুটেছেন। ঘুচে গিয়েছে হতদরিদ্র থেকে ভিআইপি পদমর্যাদার ভক্তবৃন্দের ফারাক।

মহাকুম্ভে যে বিপুল জনসমাগম হতে চলেছে, তার জন্য যে আগাম প্রস্তুতি লাগবে, সেই আন্দাজ নিশ্চয়ই উত্তরপ্রদেশ প্রশাসন করতে পেরেছিল। তা হলে রেলপথে কুম্ভযাত্রা এমন বিভীষিকাময় কেন হল? ট্রেনের সময়সারণি, ঘোষণা, এবং ক্রমাগত নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মে ট্রেন আগমনের ঘোষণা বদলে বিভ্রান্ত যাত্রীদের বাঁধাভাঙা বন্যাস্রোতের মতো হুড়মুড়িয়ে ট্রেনে ওঠা এবং কামরায় প্রবেশের জন্য প্রাণপণ সচেষ্ট হওয়াতেই সৃষ্টি হয় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। যাত্রীর চাপ এমন বাড়তে থাকে যে, নয়াদিল্লি স্টেশনের সামনের মেট্রো স্টেশনের গেট পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তাতেও রেহাই পাওয়া যায়নি। মৃত হতভাগ্য পুণ্যার্থীদের চটি, ব্যাগ স্তূপীকৃত হয়ে থাকতে দেখা যায়, যা নিমেষে সাফ করা হচ্ছিল, যাতে পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর সঠিক সংখ্যা জানা না যায়। এই ঘটনায় ভারতীয় রেল নিয়ে গর্বের ফানুসটি ফুটো হয়ে গিয়েছে। নয়াদিল্লি স্টেশনকে ‘মৃত্যু-স্টেশন’ বলার মধ্যে কোনও ব্যঙ্গ নেই। বরং বিস্ময়— এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে তা কেন অনুমান করতে পারেননি রেলের কর্তাব্যক্তিরা?

অথচ, এই পরিস্থিতির জন্য জনগণকে দুষছেন নেতা-মন্ত্রীরা। কোন পরিস্থিতিতে পুণ্যার্থীরা কুম্ভগামী ট্রেনে ওঠার জন্য রেলের সম্পত্তি ভাঙচুর করেছেন? কেন রেলের সম্পত্তি ভাঙচুর করতে তাঁরা বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি— সেই ভাবনা কি প্রশাসন ভেবেছে? লোকাল ট্রেনে যাঁরা নিত্য যাতায়াত করেন, তাঁদের অসহনীয় যাত্রাপথ সম্পর্কে অবহিত রেলের কর্তাব্যক্তিরা? ন্যূনতম পরিষেবাটুকুও অমিল লোকাল ট্রেনের অফিস-সময়ের যাত্রাপথে। ভিড়ের সেই মহাকাব্যই রচিত হল মহাকুম্ভ-রেল পরিষেবায়। মাঝে-মাঝেই রেল অবরোধের খবর এখন গা-সহা হয়ে গেলেও তার গভীরে গিয়ে ভাবনাচিন্তা করা হয়? দুর্ঘটনা, রেলযাত্রায় নিরাপত্তাহীনতা এখন এমন বিভীষিকাময় যে, দু’-একটি রাজ্যের উপর দিয়ে রাতের যাত্রা আশঙ্কা জাগায়। কেন সংরক্ষিত কামরায় উঠবে অসংরক্ষিত কামরার মানুষজন, চালাবে দাদাগিরি? কোথায় রেল-নিরাপত্তা কর্মীদের তদারকি? ভুক্তভোগীরা লিখিত অভিযোগ করেন। কিন্তু দোষীরা ধরা পড়ে কি?

১৪৪ বছর অন্তর মহাকুম্ভের যোগ যে পূর্বের সব রেকর্ড ছাপিয়ে যাবে, তার আন্দাজ করার জন্য সুবিশাল পরিকাঠামোগত আয়োজন অবশ্যই প্রয়োজন ছিল। পুণ্যার্থীরা গবাদি পশুর মতো তীর্থস্থানে যাবেন, তার যথাযথ পরিকাঠামো থাকবে না? সুতরাং ক্ষিপ্ত জনগণ নির্বিচারে ভাঙচুর চালিয়েছেন ট্রেনে। নিজেদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতাকে ধামাচাপা দিতে ‘ভিড়ের উন্মত্ততা’কে দুষেছে উত্তরপ্রদেশ প্রশাসন।

সব শেষে থাকে ক্ষতিপূরণের গল্প। কত পরিমাণ অর্থ পূরণ করতে পারে মাতৃ-পিতৃহারা, স্ত্রী-স্বামী-সন্তানহারাদের শোক? চোলাই মদ খেয়ে মৃত্যুতেও ক্ষতিপূরণ পায় পরিবার, নাবালিকা ধর্ষণে মৃত্যু হলেও আছে ক্ষতিপূরণ। আর আছে রাজনীতির চাপানউতোর। কোন রেলমন্ত্রীর আমলে কত দুর্ঘটনা ঘটেছে, চলে তার হাস্যকর হিসাবনিকাশ। আর জমা হতে থাকে মহাকুম্ভে পুণ্যডুব দিয়ে পরমায়ুপ্রার্থীদের হাহুতাশ।

ধ্রুবজ্যোতি বাগচী, কলকাতা-১২৫

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Maha Kumbh Mela 2025 Pilgrims Deaths

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy