Advertisement
২৫ জানুয়ারি ২০২৫
একা এবং কয়েক জন

সেই ‘এক্সট্রা’ জিনিসটির ভরসায় বিজেপি

শুনে তাচ্ছিল্যের সুরে দোকানি ছেলেটা বলল, আরে শুধু ‘উন্নয়ন’ নয়, আমাদের আরও একটা জিনিস ‘এক্সট্রা’ আছে, সেটা জোরে বলা যাবে না! 

বিক্ষিপ্ত: রাফাল যুদ্ধবিমান বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন যুব কংগ্রেস সমর্থকরা, দিল্লি, ২ নভেম্বর। পিটিআই

বিক্ষিপ্ত: রাফাল যুদ্ধবিমান বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন যুব কংগ্রেস সমর্থকরা, দিল্লি, ২ নভেম্বর। পিটিআই

শিবাজীপ্রতিম বসু
শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

এনএইচ সিক্স ধরে কলকাতায় ফিরছিলাম। হাসিখুশি ড্রাইভারটি ‘দিদি’র অন্ধ ভক্ত। কন্যাশ্রী থেকে সবুজসাথীর সাইকেল, দু’টাকা কিলোর চাল, গ্রামে ‘টাইম কলের জল’— প্রশংসা থামতেই চায় না। কোলাঘাট পেরিয়ে চেনা চায়ের দোকানে চা খাওয়ার ফাঁকে দোকানির সঙ্গে দিব্যি ভাব জমিয়ে ফেলল। তার কাছেও ‘দিদি’ প্রসঙ্গ। খানিক শুনে দোকানি বলে, তোদের ‘দিদি’ আর আমাদের ‘দাদা’, ‘দিল্লির দাদা’, ছাপান্ন ইঞ্চি ছাতি! ড্রাইভার বলল, তোদের ‘দাদা’ কি গ্রামে এর চেয়েও বেশি উন্নতি করবে? শুনে তাচ্ছিল্যের সুরে দোকানি ছেলেটা বলল, আরে শুধু ‘উন্নয়ন’ নয়, আমাদের আরও একটা জিনিস ‘এক্সট্রা’ আছে, সেটা জোরে বলা যাবে না!

দোকানি ছেলেটা ‘এক্সট্রা’ জিনিসটার কথা জোরে বলতে পারল না, কিন্তু এই রাজ্য তথা গোটা দেশের মানুষ একবারেই বুঝে যান, সেই জিনিসটা হল সংখ্যালঘু (মূলত, মুসলিম) ‘তোষণ’-এর অভিযোগ তুলে, তাকেই সব সমস্যার ‘মূল’ বলে চিহ্নিত করে, তার বিরোধিতার সুর চড়িয়ে সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও বিদ্বেষ জনমনে গেঁথে দেওয়া। উন্নয়ন-টুন্নয়ন নয়, সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও তার ভিত্তিতে তৈরি হওয়া সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সমর্থন জোটানোর ‘এক্সট্রা’র ওপরেই এ বার কেন্দ্রের শাসক দলটি বেপরোয়া ভাবে নির্ভরশীল।

অনেকে বলতে পারেন, এ রাজ্যে বাম ও কংগ্রেস (বা, একই সঙ্গে বাম-ও-কংগ্রেস) বিরোধী পক্ষ হিসেবে ক্রমশ রক্তাল্পতায় ভোগায়, বিশেষত গাঁ-গঞ্জে নিচু তলার বাম সমর্থকরা তৃণমূলের বিরোধিতা করতে গিয়ে ‘রাম’-এর দলে চলে যাওয়ায় বিজেপির এই বাড়বাড়ন্ত। কিন্তু এ রাজ্যে বিজেপি কেবল তৃণমূলের রাজনৈতিক প্রতিস্পর্ধী হিসেবে নয়, সঙ্গে ওই ‘এক্সট্রা’ উপাদানটিও হাতে নিয়ে এগোচ্ছে, যা এই রাজ্যের রাজনীতি-সর্বস্ব (যা অন্য রাজ্যের মতো জাতপাত বা আঞ্চলিকতা-নির্ভর নয়) দলীয় চিত্রে একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে, যে উপাদান কংগ্রেস বা বাম, কারও নেই।

এই ভিন্ন মাত্রাটি ফের গাঢ় করতে চতুর্দিকে স্থান-নাম বদলের প্রতিযোগিতা, কোথাও পুরনো ইতিহাসের দোহাই দিয়ে, কোথাও ঐতিহাসিকতার তোয়াক্কা না করে। যেমন, ইলাহাবাদের নাম ‘প্রয়াগরাজ’, ফৈজ়াবাদের নাম ‘অযোধ্যা’ বা আমদাবাদের নাম ‘কর্ণাবতী’ করার প্রস্তাব যদি প্রাচীন ইতিহাস/ঐতিহ্যের কথা তুলে করা হয় তবে মুঘলসরাই পাল্টে দীনদয়াল করার যুক্তিটি নিশ্চয়ই রাজনৈতিক। ১৯৬৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মুঘলসরাই স্টেশনের কাছে লাইনের ধার থেকে সাবেক জনসঙ্ঘের সভাপতি ও তাত্ত্বিক নেতা দীনদয়াল উপাধ্যায়ের নিহত শরীর উদ্ধার হয়। বিজেপি একে রাজনৈতিক চক্রান্ত ভাবতে পারে, নতুন তদন্তও চালানো যেতে পারে, কিন্তু সেটা স্টেশনের নাম বদলের যুক্তি হতে পারে না। সে ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক চক্রান্তে নিহত মহাত্মা গাঁধী বা ইন্দিরা গাঁধীর নামে দিল্লির নামও তো বদলে গাঁধীধাম বা ইন্দিরাপুরী করা যায়! আসলে, তথাকথিত ‘ঐতিহাসিকতা’র পিছনেও সেই এক্সট্রা উপাদান— বেছে বেছে আরবি-ফারসি স্থাননামগুলোই বদলানোর কথা বলা হচ্ছে।

একই ভাবে ‘কংগ্রেস-মুক্ত’ ভারতের সঙ্কল্পের কথা বললেও আসলে শাসক দলের কাছে এটা ‘গাঁধী-নেহরু পরিবার’মুক্ত ভারত নির্মাণের প্রচেষ্টা। কংগ্রেস-মুক্তির কথা বললে স্বাধীনতা সংগ্রামে কংগ্রেসের সবচেয়ে বড় আইকন মহাত্মা গাঁধীর ঝাড়ু-হাতে ছবি নিয়ে ‘স্বচ্ছ ভারত’ কার্যক্রম চলে কী ভাবে? কী ভাবেই বা গাঁধীর পদপ্রান্তে আজীবন রাজনীতি করা বল্লভভাই পটেলের (যাঁর ‘সর্দার’ উপাধিও বরদৌলি সত্যাগ্রহের পর গাঁধীরই দেওয়া) মূর্তি অন্য সব মূর্তিকে ছোট করে উচ্চতম হয়ে ওঠে! স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ও স্বাধীন ভারতে (যে বছর তিনেক তিনি উপপ্রধানমন্ত্রী ছিলেন) প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সঙ্গে তাঁর কিছু বিষয়ে মতভেদ সর্বজনবিদিত, কিন্তু সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে তো সে বিরোধ আরও প্রবল। ত্রিপুরী কংগ্রেসে সুভাষবাবুর সভাপতিত্বের বিরোধিতা যদি গাঁধী করে থাকেন, পটেল কিছু কম করেননি।

কেবল নেহরুর সুভাষ-বিরোধিতার ওপরেই জোর দেওয়া হয়, যদিও গোড়ায় কংগ্রেসের ‘রক্ষণশীল’দের মধ্যে সুভাষচন্দ্রের সঙ্গেই নেহরু ‘সমাজবাদ’, ‘দ্রত শিল্পায়ন’ প্রভৃতি বিষয়ে একজোট ছিলেন। পরে, ব্রিটিশ-বিরোধিতায় ফ্যাসিবাদের সমর্থনের প্রশ্নে নেহরু সুভাষচন্দ্রের তীক্ষ্ণ সমালোচক হয়ে ওঠেন। কিন্তু নেতাজির দেশত্যাগের সময় কি পটেল তাঁকে সমর্থন জানিয়েছিলেন? শাসক দল বার্তা দিতে চাইছে যে নেহরুর ‘নরম’ বা ‘দ্বিধাগ্রস্ত’ ব্যক্তিত্বের বিপ্রতীপে তারা পটেলের শক্তপোক্ত ভাবমূর্তিরই (যা সবচেয়ে প্রতিভাত হয়েছিল স্বাধীনতার পরে বিভিন্ন দেশীয় রাজ্যের ভারতভুক্তির সময়— হায়দরাবাদ ও জুনাগড়ের ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগেও তিনি পিছপা হননি) ধারক ও বাহক। কিন্তু সে ক্ষেত্রে তো বাংলাদেশের যুদ্ধে জয়লাভ আর পোখরানে প্রথম পরমাণু পরীক্ষার জন্য ইন্দিরা গাঁধীরও সুউচ্চ মূর্তি বানাতে হয়!

কিন্তু কেবল কড়া জাতীয়তাবাদের ভাষ্যে বোধ হয় ভোটের চিঁড়ে ভিজবে না, তাই ঝুলি ঝেড়ে আবার ‘রামমন্দির’ নির্মাণের ‘এক্সট্রা’ বিষয়টি ভোটের আগে বার করা হয়েছে। আদালতের ভিতরে বা বাইরে যে ভাবে হোক, ‘মন্দির ওহি বনায়েঙ্গে’! বিজেপির হিসেব, এর জেরে জাতপাতের বেড়া ভেঙে, আর্থসামাজিক সমস্যা ভুলে ফের ‘হিন্দু ভোট’ সংগঠিত হবে, আর সেই ঝড়ে, বিশেষত উত্তর ও মধ্য ভারতে (যেখানকার বেশির ভাগ রাজ্যেই শাসক বিজেপি বেশ ‘চাপ’-এ) সব প্রতিরোধ খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে। হিসেবটায় যে কিছু সারবত্তা আছে, তা বোঝা যাচ্ছে ‘পৈতেধারী শিব-ভক্ত’ হিসেবে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধী ও তাঁর নরম হিন্দুত্বের অকস্মাৎ প্রকাশে। অবস্থা এমনই যে কংগ্রেসকেও বলতে হচ্ছে, তারা মন্দির-বিরোধী নয়! কিন্তু রামমন্দির নির্মাণের দাবি তো বিজেপির ‘পেটেন্ট’ নেওয়া, ফলে এই প্রশ্নে ভোট হলে তারাই ফসল ঘরে তুলবে।

বিভাজনের ‘এক্সট্রা’র পাশাপাশি বর্তমান শাসক দল, যুগে যুগে পরীক্ষিত অব্যর্থ অস্ত্র, সিবিআইয়ের ব্যবহার শুরু করেছে। এই ব্যাপারে অবশ্য শুধু বিজেপি দায়ী নয়, অতীতে কংগ্রেস প্রধানমন্ত্রীর দফতরের অধীন এই প্রতিষ্ঠানটির এতই অপব্যবহার করেছিল যে আদালত তাকে ‘খাঁচাবন্দি তোতা’ আখ্যা দিয়েছিল। এখন অবশ্য খাঁচাটিই ভেঙে পড়ার জোগাড়। কিন্তু তাতে চিদম্বরম তেমন ভয় না পেলেও মায়াবতী নিশ্চয়ই বেশ কিছুটা পেয়েছেন— ছত্তীসগঢ় ও মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রার্থী দিয়েছেন তিনি। সমাজবাদী দলের অখিলেশও এই সব রাজ্যে কংগ্রেসের ধার মাড়াচ্ছেন না। এমন অবস্থায় দিল্লিতে লোকসভায় বিজেপি-বিরোধী সর্বদলীয় সম্মেলনটি মাটি হওয়ার পথে। চন্দ্রবাবু নাইডু আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলকাতা বৈঠকের এটাই সারমর্ম।

অথচ, নোটবন্দির কুফল থেকে কৃষকদের বেহাল অবস্থা, রাফাল বিমান কেনাবেচায় ‘দুর্নীতি’র অভিযোগ থেকে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের বিবাদ: ২০১৯-এ ‘বিষয়’-এর অভাব ছিল না। কিন্তু টুকরোগুলো নিয়ে মালা গাঁথার সূত্রধরের দেখা এখনও মিলল না। চন্দ্রবাবুর ভাষায়, নির্বাচনের পর নেতৃত্ব দেওয়ার বিরোধীদের মধ্যে ‘অনেক’ যোগ্য নেতা আছেন। অনেক আশা নিয়ে কংগ্রেসের ‘রাগা’ এই ‘অনেক’-এর ভিড়ে ‘একা’ দাঁড়িয়ে। বিরোধীদের অবস্থা অনেকটা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাসের শিরোনামের মতো— ‘একা এবং কয়েক জন’!

বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক

অন্য বিষয়গুলি:

BJP Narendra Modi Rahul Gandhi Minority Issue Minority Community Polarization
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy