Advertisement
E-Paper

জনগণকেই বেছে নিতে হবে আগামীর পথ

কোথাও ভোট আছে, ‘জনগণ’ নেই। কোথাও আবার জনগণ আছে , ভোট নেই। গণতন্ত্রের এই বৃহত্তম ভোটতন্ত্রে জনগণের এই অনুপস্থিতি আর কত দিন থাকবে? লিখছেন সাইদুর রহমানপ্রাচীন কাল থেকে আজ পর্যন্ত মানুষের সামাজিক জীবনধারা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত।

শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৯ ০২:২৪

বিশ্বের বৃহত্তম ‘গণতন্ত্রে’ ‘ভোটতন্ত্রে’র বৃহত্তম উৎসব চলছে। এই উৎসবে গলি থেকে রাজপথ, কুঁড়েঘর থেকে আকাশছোঁয়া বহুতলের রঙিন আলোয় পতপত করছে নানা দলের পতাকা। এক কিংবা বহুবর্ণে সজ্জিত রঙিন নাট্যমঞ্চে ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’র সফল মঞ্চায়ন। অভিনেতা অভিনেত্রীদের মুষ্টিবদ্ধ হাত, স্লোগান আর প্রতিশ্রুতির বন্যায় নাটকীয় টানটান উত্তেজনা। ‘পুতুলনাচের’ তালে তালে বদলে যায় অভিনেতা অভিনেত্রীদের চরিত্র, সংলাপ আর পোশাকও। গত বছরের পালায় যিনি ‘সাজাহানে’র চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, তিনি এ বার ঔরঙ্গজেব। আর যিনি ঔরঙ্গজেব হয়েছিলেন তিনি এ বার শিবাজি। গত বছর যিনি ‘গণতন্ত্র হত্যা’ পালায় ভিলেনের অভিনয় করেছিলেন, এ বার তিনি ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার’ পালার নায়ক। পরিবর্তন আসে নাট্যকারের সংলাপেও। নাট্যকার তো যুগস্রষ্টা! তাঁর থেকে যুগের পরিবর্তন আর কে ভাল বোঝেন! শুধু দূর থেকে দর্শকাসনে বসে নাট্যমঞ্চের পুতুলনাচের ‘তামাসা’ দেখে যান রাম আর রহিম। তাঁরা অভিনয় দেখে যান, আর নানা আশা, হতাশা, নিরাশা আর ক্ষণিক উত্তেজনার আবহে ‘এ বার উন্নয়ন হবেই’— এই আশাতে দুটো ডালভাত খেয়ে স্বপ্ন দেখেন। শুধু দেখতে পান না সেই পুতুলনাচের পিছনের সুতোটিকে। দেখতে পান না, কারণ দেখা যায় না। কারণ, সুতো অতি সূক্ষ্ম। যে চোখে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ‘নাচন’ দেখা যায়, সেই চোখে সুতো দেখা যায় না, দেখা যায়না সুতোর কেন্দ্রীয় চরিত্র গুলিকেও। এমনই সুতোর যাদু!

আব্রাহাম লিঙ্কন নাকি বলেছিলেন, জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা জনগণের মঙ্গলের জন্য যে শাসন ব্যবস্থা তাই হচ্ছে গণতন্ত্র। আব্রাহাম লিঙ্কনের মৃত্যুর শতাধিক বৎসর পার হয়ে গিয়েছে। পৃথিবীর বহু দেশ, রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। এই অবস্থায় কি পুঁজিতান্ত্রিক, কি সমাজতান্ত্রিক সকল দেশে রাষ্ট্র ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেতে শুরু করে। ‘গণতন্ত্র’ যেন জলের মতো, যখন যে পাত্রে তখন সেই পাত্রের আকার ধারন করে। ক্যাপিটালিস্টের কাছে গণতন্ত্র ক্যপিটালের রক্ষাকবচ, সোশ্যালিজমের কাছে গণতন্ত্র আত্মরক্ষার নিরাপদ ব্যবস্থা।

ভোট গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। গণতন্ত্রে জনগণের মতামত এখন সরাসরি প্রয়োগের ব্যবস্থা সীমাবদ্ধ হওয়ায় তা ভোট নামক ব্যালট পেপারের প্রতীকী মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। গণতন্ত্রে যখন ‘ভোট’ জবাবদিহির অংশ হয়ে ওঠে, রাষ্ট্র পরিচালনায় শাসকগোষ্ঠীও জবাবদিহির বাইরে থাকতে পারে না। কখনও কখনও শাসকগোষ্ঠী অনেক ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের পোশাক বদলে নগ্ন স্বৈরাচারীর বেশে খড়্গহাতে দেশ শাসনে মত্ত হয়। কোথাও কোথাও ‘জনপ্রিয়’ শাসক ভোট নামক ‘ভোটতন্ত্রে’র সুযোগ কাজে লাগিয়ে জনগণের মতামতকে নিজের দিকে টানার চেষ্টা করে। কখনও জোর করে, কখনও বুথ দখল করে, কখনও ছাপ্পা মেরে। অর্থাৎ ‘ভোটে’র মাধ্যমে মতামত দিতে হবে ঠিকই, তবে তা শাসক যে ভাবে চাইছে, সে ভাবেই। ‘শাসকরেই শ্রেষ্ঠ, এই সত্য বুঝে নিয়ে দেশ, জাতি, তথা জনগণের গণতন্ত্র বুঝে নিতে হবে। এই ভোট ব্যক্তির চাওয়া পাওয়ার মূল্যকে বিবেচনায় না নিয়ে শাসকের চাওয়াতেই হবে। সেখানেই নিহিত থাকবে ব্যক্তির চাওয়া পাওয়া। ব্যক্তির বা নাগরিকের ভোট এ ভাবে চিহ্নিত হবে। আর তার ভোটই হবে গণতন্ত্রের পরিবর্তে ‘ভোটতন্ত্র’।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

ভারতের প্রায় ১৩০ কোটি জনসংখ্যার প্রায় ৬৫ শতাংশ ভোট দানের অধিকারী। অর্থাৎ, ১৩০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ৪০ থকে ৪২ কোটি মানুষ ভোট দিয়ে থাকেন যা মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশের মতো। ভোটতন্ত্রের গণতন্ত্রে পাটিগণিতের হিসেবে এই ৪০ শতাংশের মধ্যে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ভোট পেয়েও কেউ দেশের শাসক হতে পারেন। এমনকি সংখ্যাতত্ত্বের হিসেবে এর চেয়ে কম শতাংশ ভোট পেয়েও বিভিন্ন কোয়ালিশন সরকার দেশের সমস্ত দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হন । প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে’র এই সংখ্যালঘুর ভোটের জোরে দেশবাসীর উপর শাসনের অধিকার গণতন্ত্রের সূতিকাগার ফ্রান্স এবং আমেরিকা থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। আমেরিকায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ১৩২ বছর পরে ১৯২০ সালে মহিলাদের ভোট দেওয়ার অধিকার প্রথম স্বীকৃতি পায়। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত দক্ষিণের প্রদেশগুলিতে আফ্রিকান আমেরিকানদের ভোটাধিকারই ছিল না। ফলে বিংশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত মাত্র ১০ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান নাগরিকের ভোটের ভিত্তিতে সমগ্র আমেরিকা বিশ্বে ছড়ি ঘুরিয়েছে। আর ফ্রান্সের মহিলারা প্রথম ভোটাধিকার পান এই সবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে, ১৯৪৪ সালে। দেশের অর্ধেক জনসংখ্যক নাগরিকদের মতামতের তোয়াক্কা না করেই প্রায় দুশো বছর ধরে গণতন্ত্রের রথ গড়গড়িয়ে চলেছে ফ্রান্সে। গণতন্ত্রের এই যে ‘আধা পবিত্র স্টেটাস’, তার উপর ভিত্তি করেই গণতন্ত্র ‘জনপ্রিয়’ হয়ে এগিয়ে গিয়েছে।

প্রাচীন কাল থেকে আজ পর্যন্ত মানুষের সামাজিক জীবনধারা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত। যখন রাষ্ট্র গঠিত হয়নি তখনও তার প্রাথমিক দৃষ্টি ছিল যে কোনও উপায়ে নিজের ক্ষুধা, তৃষ্ণা নিবারণ করা। ক্ষুধা, তৃষ্ণা আর বেঁচে থাকার জীবন সংগ্রাম নিয়েই মানব জীবনে বিবর্তন শুরু হয়েছিল। সেই বিবর্তনের পথেই এক দিন মানুষ প্রয়োজন থেকে সমাজ গঠন করেছে, সমাজ থেকে গঠন করেছে রাষ্ট্র। তাই মানুষের প্রয়োজনে রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে মানুষ নয়। রাষ্ট্র যদি মানুষের প্রয়োজন মেটাতে না পারে, তবে রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়। ভোট সর্বস্ব রাজনীতির ঘেরাটোপে বন্দি আজকের রাষ্ট্র মিথ্যে প্রতিশ্রুতি আর জোর করে ছাপ্পা ভোটদানের মাধ্যম হয়ে উঠেছে। গণতন্ত্রের এই বৃহত্তম ‘ভোটতন্ত্রে’র উৎসবে ‘ভোটদাতা জনগণ’, ‘ভোটকর্মী’ এমনকি ভোটবাক্স ‘ইভিএম’ রক্ষাকারী পুলিশকেও ভয়ে কাঁপতে দেখা যায়। অবাধ নির্বাচনের এই আনন্দযজ্ঞে জনগণকে আশ্রয় নিতে হয় সেই বুলেটের নীচেই। অথচ এই বুলেট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যম হিসেবে ‘ভোটদান’ পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছিল। মানুষের সেই মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার চাবিকাঠি আজ হুমকি আর অস্তিত্বরক্ষার সম্মুখীন। কখনও জোর করে ভোটদান, কখনও নির্বাচন হতে না দেওয়া, কখনও ছাপ্পা, কখনও বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া— এর মধ্যেই আজকের ‘ভোটতন্ত্র’ বেঁচে আছে। আজ কোথাও ‘ভোট’ আছে, কিন্তু সেখানে ‘জনগণ’ নেই, আবার কোথাও ‘জনগণ আছে , ‘ভোট’ নেই। ‘গণতন্ত্রে’র এই বৃহত্তম ‘ভোটতন্ত্রে’ জনগণের এই অনুপস্থিতি আর কত দিন থাকবে, আজ তার সময় এসেছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। তার পরে জনগণকেই বেছে নিতে হবে আগামী দিনের গণতান্ত্রিক পথ।

Lok Sabha Election 2019 Narendra Modi BJP Congress লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy