Advertisement
E-Paper

একদা যা ছিল পাড়ার চায়ের দোকানের আলোচ্য, তা এখন ভার্চুয়াল

ইভিএম গোটানো থেকে রেজাল্ট— এই কালপর্বে গুজবের ক্রিয়াও যে ক্রমশ গতি সঞ্চয় করবে, সে বিষয়েও কোনও সন্দেহ নেই।আর তো ক’টা দিন! নতুন সরকার গঠন হলেই আবার যে কে সেই। তদ্দিনে মনেও থাকবে না ভোটের বাজারে কে কী করেছিলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়।

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৯ ১৪:৪৮
বুথফেরত সমীক্ষার মতে, ভয়ানক দুর্দিন ধেয়ে আসছে।

বুথফেরত সমীক্ষার মতে, ভয়ানক দুর্দিন ধেয়ে আসছে।

ফেসবুক জুড়ে কেবল তর্জনী আর তর্জনী। ভিনদেশিরা দেখলে চমকে যেতে পারেন। ঠিক কার বা কীসের প্রতি অভিযোগ-অঙ্গুলির এই বিপুল পরিমাণ উত্থান, তা বিভ্রান্ত করতেই পারে তাঁদের। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ভোট হয়। কিন্তু কোন দেশের ভোটদাতারা এই ভাবে আঙুল তুলে কলাগাছ দর্শান, তা বলতে পারেন? ১৯ তারিখ দুপুরের পর থেকেই শুরু হয়েছে এই অঙ্গুলিমাল-মার্কা পোস্টিংয়ের ঢল। পোস্ট-কারীদের বক্তব্য— আমি দিয়েছি, আপনিও দিন। এখানেই খটকা। এই অঙ্গুলি উত্তোলনকারীদের ধারণা কি এই প্রকার যে, ভোটদান করে তিনি এমন এক মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, যা অন্যরা করেনি বা পারেনি? অথবা এই বিশেষ কাজটি কি এই দিকে ইন্ডিকেশন দেয় যে, এ দেশের বেশির ভাগ মানুষই ভোটদানে অনাগ্রহী। তাই ভোটদানকারীরা তাঁদের কালিমালিপ্ত আঙুল ঊর্ধ্বে তুলে ইন্সপায়ার করছেন বাকিদের? কে জানে! ভোট এ দেশে নৈমিত্তিক। যাঁরা দেওয়ার, তাঁরা দিয়েই থাকেন। আলাদা করে অনুপ্রেরণা সঞ্চারের অর্থ ও ব্যঞ্জনা মোটেই বোঝা গেল না।

বাঙালির আদেখলেপনার এক অনুপম উদাহরণ হয়ে থাকল এই আঙুল-পোস্টিং। সোশ্যাল মিডিয়া না থাকলে এই কাণ্ড দেখতে হতো না। চিন্তাশীলরা অবশ্য এই সব আঙুল-চালনার বাইরে। বুথ ফেরত সমীক্ষা থেকে তাঁরা কোন কোন সিঁদুরে মেঘ দেখছেন, তাই নিয়ে সারগর্ভ সব লিখন সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়ালে সাঁটছেন। অমুক জিতলে দেশের সমূহ বিপদ—এই জাতীয় বার্তা দলীয় স্তর থেকে ব্যক্তিগত লেভেল পর্যন্ত হিলিবিলি কাটছে। চিন্তার এই প্রবাহে কমেন্টের বান ডেকেছে। ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে এমন সব পুরনো কাসুন্দি উথলে উঠছে যে, এক নজরে দেখলে মনে হতে পারে, ভারতীয় রাজনীতির সিক্রেট হিস্ট্রি চিন্তাশীলদের নখদর্পণে। ভাগ্যিস এ দেশের সংস্কৃতিতে কন্সপিরেসি তত্ত্ব বিশেষ আমল পায় না। নইলে, মনে হতেই পারত, ইভিএম-এর গভীর কানাচে পাকিয়ে উঠছে এমন কোনও ষড়যন্ত্র, যার ধাক্কা ভারতবর্ষ সামলে উঠতে পারবে না।

ভোটের আগের দিন থেকেই ভোটকর্মীরা অবশ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় সচিত্র আপডেট দিয়ে গিয়েছেন। ভোটকেন্দ্রের ছবি থেকে ইন্ডোর স্টেডিয়ামে গিয়ে বাক্স জমা দেওয়া পর্যন্ত কর্মকাণ্ড ধারাবাহিক ভাবে উঠে এসেছে অসংখ্য পোস্টে। এতে আর কিছু না হোক, বাকিদের জ্ঞানভাণ্ডার যে উচক্কা রকমের বেড়ে গিয়েছে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এই জ্ঞান পরবর্তী ভোটে কাজে আসবে নিশ্চয়। জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা। ফেসবুকই মনে করিয়ে দেবে পাঁচ বছর আগে আপনি এই প্রকার পোস্টিয়েছিলেন। পাঁচ বছর পরে আবার সেই পোস্ট শোভা পাবে দেওয়ালে।

সোশ্যাল মিডিয়া না থাকলে এই কাণ্ড দেখতে হতো না।

আরও পড়ুন: ক্ষুদ্রতম প্রশ্নচিহ্নের সামনেও যেন দাঁড়াতে না হয় আমাদের গণতন্ত্রকে​

এ সবই বাহ্য। ফেবু-র তলায় হোয়াটসঅ্যাপ। সেখানে ভোটরঙ্গ ক্রমশ ক্ষীয়মাণ। গত দু’মাসে যেখানে দাপিয়ে বেরিয়েছে মোদী-দিদির মিম আর কার্টুনের, ব্যান্টারিং ভিডিয়োর জলতরঙ্গ, এবার সেখানে ক্রমাগত চেতাবনি। বুথফেরত সমীক্ষার মতে, ওই ধেয়ে আসছে ভয়ানক দুর্দিন। সাধু সাবধান! সাধু সাবধান!! বলাই বাহুল্য, এই সব চেতাবনির অধিকাংশই ফরওয়ার্ড করা। কোন গহীন উৎস থেকে এরা উঠে এসেছে, বলা কঠিন। তবে, এই সব পোস্টের তলদেশে যে ভয়ানক সব মতলব পাক খাচ্ছে, তা অনুমান করা মোটেই কঠিন নয়।

রেজাল্ট পর্যন্ত এই সব ধানাই-পানাই বহমান থাকবে। একদা যা ছিল পাড়ার চায়ের দোকানের আলোচ্য, তা এই মুহূর্তে ভারচুয়াল। কানে কানে নয়, মনে মনে ফিসির ফিসির ভাইরাল। ইভিএম গোটানো থেকে রেজাল্ট— এই কালপর্বে গুজবের ক্রিয়াও যে ক্রমশ গতি সঞ্চয় করবে, সে বিষয়েও কোনও সন্দেহ নেই। না, পুরোটাই যে গোলমাল পাকানোর জন্য, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। এর বেশির ভাগটাই নান্দনিক। হলিউডি উৎকণ্ঠা-ছবির কিসিমে টেনশন বিল্ড আপ। স্টেল হয়ে যাওয়া জীবনে সামান্য নমকের আমদানি।

নমকের সবথেকে বেশি প্রয়োগ অবশ্য টিভি চ্যানেলগুলোয়। খামোখা স্নায়ুসূত্রে উত্তেজনাপ্রবাহ সৃষ্টি করতে তারা নজিরবিহীন। ফাঁকা মাঠে দুটো পেটো আবিষ্কার করে লোক জুটিয়ে তারা আসর জমিয়েছিল ভোটের আগে। ভোটের দিন সামান্য জটলাকেই তুমুল হেঙ্গাম বলে চালিয়েছে। ভোট মিটতেই এই সব বালখিল্যপনায় ইতি। সকলেই শান্ত। সময়োচিত গাম্ভীর্য বজায় রেখে শুরু করে দিয়েছে স্পেকুলেশন। কে জিতবে, কে হারবে-র চাইতেও বড় কথা— কে জিতলে কতটা বিপদ ঘনিয়ে উঠবে। বিপদের বার্তায় চ্যানেলের টিআরপি উঠল কি নামল, বলা যায় না। তবে চ্যানেলকর্তা আর সংবাদ পরিবেশকদের ইগো যে ফুলে ফেঁপে পাকা পেঁপে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

আরও পড়ুন: যে দিকে ঢিল ছুড়ছে সবাই​

আর তো ক’টা দিন! নতুন সরকার গঠন হলেই আবার যে কে সেই। তদ্দিনে মনেও থাকবে না ভোটের বাজারে কে কী করেছিলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। ফেসবুক অবশ্য সেই সব পোস্ট জাবর কাটতে শুরু করবে এক বছর পর থেকে। তখন কি লজ্জা হবে এই সব ছেলেমানুষি দেখে? মনে হয় না। কারণ, লোকসভা ফুরলে বিধানসভা রয়েছে। বিধানসভা কাটলে আবার লোকসভা। গণতন্ত্রে ভোটপর্ব তো মেটার নয়! গণতন্ত্রীরা একথা তাঁদের অন্তর দিয়েই জানেন। তবু প্রতি বার ভোটের বাজারে এই গরম হাওয়া তুলে ধরে তাঁরা শেষমেশ কী প্রমাণ করতে চান? না, নাগরিক সচেতনতা বা ‘শুভবুদ্ধি’র জাঁক এ দিয়ে অবশ্যই প্রমাণিত হয় না। যা হয়, তা নিজের অস্তিত্ব জাহির।

তেনারা থাকবেনই। আগামীর কুম্ভীপাকে-রৌরবে-সোশ্যাল মিডিয়ার ঘোর অলাতচক্রে তেনারা থাকবেনই। তেনারা না থাকলে গণতন্ত্রের লীলা পোস্টাই হয় না যে! তা হলে কি গণতন্ত্রের অন্তঃস্থলে ঘাই মারছে অগণিত লোকের আত্ম-বিজ্ঞাপনের খায়েশ? সোশ্যাল মিডিয়া না থাকলে এই ভাবে বোঝা যেত না। অবশ্য বোঝা বা না-বোঝাতেই বা কী এসে যায়! খেলা এই প্রকারই বহমান থাকবে। অন্তত তদ্দিন, যত দিন না অধিকতর শক্তিশালী কোনও আত্ম-বিজ্ঞাপনের যন্ত্র একে রিপ্লেস না করে।

Lok Sabha Election 2019 লোকসভা নির্বাচন ২০১৯ Social Media Facebook Narendra Modi Mamata Banerjee
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy