Advertisement
E-Paper

ভোট প্রচারের নামে অশালীনতা আর কত দিন?

রাজনীতির কারবারিরা প্রচারে ব্যক্তি কুৎসার খেউড় গাইবেন নাকি যুক্তি নির্ভর মতাদর্শের প্রচার করবেন, সেটাও নির্ভর করছে দৈনন্দিন রাজনৈতিকযাপনের উপরেই। লিখছেন অনল আবেদিনরাজনীতির কারবারিরা প্রচারে ব্যক্তি কুৎসার খেউড় গাইবেন নাকি যুক্তি নির্ভর মতাদর্শের প্রচার করবেন, সেটাও নির্ভর করছে দৈনন্দিন রাজনৈতিকযাপনের উপরেই। লিখছেন অনল আবেদিন

শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৯ ০২:০৬
প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

সালটা ১৯৯৬। দেশ জুড়ে লোকসভা নির্বাচনের আয়োজন চলছে। সঙ্গে রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনও। বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রে বামফ্রন্টের আরএসপি প্রার্থী প্রমথেশ মুখোপাধ্যায়। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেসের বহু আলোচিত প্রার্থী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। সে বার প্রমথেশ মুখোপাধ্যায়ের নির্বাচনী সভায় মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেন, “খুব সামান্য ব্যাপারেও সিদ্ধার্থের ডাহা মিথ্যে কথা বলার অভ্যাসটা এখনও যায়নি। কাগজে দেখলাম, সিদ্ধার্থ বলেছে ও নাকি একটা অন্যায় করেছে। আমার ছেলেকে পড়ানোর ব্যবস্থা করে। এই সামান্য ব্যাপারেও ও মিথ্যা কথা বলছে। কাশ্মীরের মন্ত্রী সাদিক সাহেব আমার পরিচিত। কাশ্মীরে গিয়ে আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। সাদিক সাহেবই আমার ছেলেকে পড়ানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। এই ব্যাপারের সঙ্গে সিদ্ধার্থের কোনও সম্পর্কই নেই।”

তার ১৪ দিন পরে বহরমপুরের নির্বাচনী জনসভায় মুখ্যমন্ত্রীর জ্যোতি বসুর ‘বুজম ফ্রেন্ড’ প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় বলেন, “যত দিন যাচ্ছে, জ্যোতি ততই ভাষার উপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। জ্যোতি যে ভাষায় মমতাকে (যুব কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপধ্যায়) আক্রমণ করেছে, তাতে বাঙালি নিশ্চয় বিস্মিত ও ব্যথিত। যতই সম্ভাব্য পরাজয়ের খবর চারদিক থেকে আসছে, ততই ওর মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ও যে সব ভাষা প্রয়োগ করছে, তাতে সুস্থ রুচিবোধের বা মানসিক ভারসাম্যের পরিচয় নেই। কংগ্রেসের পক্ষে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন তা নিয়ে জ্যোতির মাথাব্যথা কেন? জ্যোতির এখন নিজের মুখ্যমন্ত্রিত্ব নিয়ে ভাবা উচিত।” রাজনৈতিক ভাষ্য ক্রমে ব্যক্তি আক্রমণের দিকে নামতে শুরু করল।

রাজনৈতিক সংস্কৃতির পচন শুরু হলে সমাজদেহও অক্ষত থাকে না। দৃষ্টান্ত ২০০৪ সালের ওল্ড কালেক্টরেড মোড়ের আর একটি জনসভা। তখন মুর্শিদাবাদ জেলার পুলিশ সুপার জ্ঞানবন্ত সিংহ। জ্ঞানবন্তের ছক অনুসারে দলীয় কর্মীদের মিথ্যা মামলায় লাগাতার গ্রেফতার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে জনসভার আয়োজন করা হয়েছে। সভায় পুলিশ সুপার জ্ঞানবন্তের নাম করে মহিলা কংগ্রেসের জেলা সভানেত্রী মৌসুমি বেগমের হুমকি, ‘‘সাজানো মিথ্যা মামলায় কংগ্রেস কর্মীদের ফাঁসানো বন্ধ না হলে আপনার স্ত্রীর জন্য সাদা থান কিনে রাখুন।’’

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

পচনশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে এ জেলায় অধঃপতনের চূড়ান্ত সীমায় নিয়ে গিয়েছিলেন এক বামমন্ত্রী। ২০০৯ সালে লোকসভার নিবার্চনী জনসভায় ওই মন্ত্রী অত্যন্ত অশালীন মন্তব্য করেছিলেন। মন্ত্রীর মুখ নিঃসৃত ওই বচন শুনে নির্বাচনী জনসভায় উপস্থিত এক মহিলার প্রতিক্রিয়া, ‘‘ছিঃ! মন্ত্রী মেয়েদেরও মান-সম্মান রাখল না!’’

এ বারেও মুর্শিদাবাদ জেলার ভোট প্রচারে বিরোধী পক্ষের এক সাংসদের বিরুদ্ধে রাজ্যের এক মন্ত্রী নিয়ম করে ‘অবৈধ’ শব্দটি প্রতিটি জনসভায় নামতার মতো মুখস্থ বলছেন। রাজনৈতিক বক্তব্যের বদলে ব্যক্তিগত খেউড় এখন নেতাদের একমাত্র ভোট-হাতিয়ার। অবিভক্ত জঙ্গিপুর বিধানসভার কয়েক বারের বিধায়ক ছিলেন প্রয়াত কংগ্রেস নেতা হাবিবুর রহমান। বার দুয়েক তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিলেন এসইউসিআই নেতা অচিন্ত্য সিংহ। হাবিবুর রহমান তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, অচিন্ত্য সিংহের ভাষণ শুনতে নির্বাচনী জনসভা থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতেন।

তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কয়েক বছর আগে হাবিবুর রহমান নিজেই বলেছিলেন, ‘‘আমার থেকে বয়সে ছোট হলে হবে কী! তিনি সুবক্তা। কিছু শেখার জন্যই অচিন্ত্যবাবুর ভাষণ শুনতাম। তিনি খুব ভাল বলেন।’’

হাবিবুর রহমানদের প্রজন্মের প্রয়াণে সঙ্গেই বুঝি গত হয়েছে এসইউসি নেতা শিবদাস ঘোষ কথিত ‘উচ্চতর হৃদয়বৃত্তি’র রাজনীতি। জেলার মানবাধিকার সংগঠনের এক নেতার আক্ষেপ, “একুশ শতকের ভোট রাজনীতির সাংস্কৃতিক অধঃপতন আমাদের বংশধরদের কোথায় টেনে নামাবে সেই আতঙ্কে হাড় হিম হয়ে যায়! সন্তানদের সামনে বাড়িতে টিভি খুলতেও ভয় হয়।” যে জেলায় নিজের নির্বাচনী জনসভা থেকে রেজাউল করিম তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ত্রিদিব চৌধুরীর প্রশংসা করেন, ত্রিদিববাবু জিতলে তিনি খুশি হবেন বলেও নিজের নির্বাচনী জনসভা থেকেই জানিয়ে দেন, সেই জেলায় আজ ভোট প্রচারের নামে এই নোংরামির চর্চা কেন?
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত এক অধ্যাপকের মতে, ‘‘রুচি-সংস্কৃতি-মূল্যবোধের সার্বিক অবক্ষয় এই অধঃপতনের মূল কারণ। তা ছাড়া এক পক্ষ দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকলে দম্ভ, অহঙ্কার ও ‘কুছ পরোয়া নেহি’ ভাব জন্ম নেয়। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সম্ভবনায় বিকার সৃষ্টি হয়। অন্য পক্ষ ক্ষমতায় যেতে না পেরে হতাশায় ভোগে। আক্রোশ তৈরি হয়। বিকার জন্ম নেয়।” তিনি মনে করেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আজ প্রকৃত অর্থে মতাদর্শগত ফারাক নেই। আদর্শের জন্য আবেগও নেই। রয়েছে কেবল ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত ও দলগত স্বার্থবোধ। অনৈতিক ওই স্বার্থবোধের কারণে নৈতিক অধঃপতন ও রুচির বিকার ঘটছে।”

পরিবারের প্রধানের রুচি-সংস্কৃতি-মূল্যবোধের উপর নির্ভর করে পরিবারের অন্যদের মানসিক গড়ন। একই ভাবে দেশ, সমাজ, গোষ্ঠী ও ব্যক্তির মানসিক গড়ন নির্ভর করে শাসক ও বিরোধী রাজনৈতিক দল গুলোর নীতি, আদর্শ ও তার প্রয়োগের উপর। অ্যারিস্টটলের কথা অনুসারে, ‘‘Man is by natute a political animal.’’ ফলে আমরা চাই বা না চাই আমাদেরকে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকতেই হবে। অ্যারিস্টটল কথিত ‘political animal’, জর্জ বার্নাড শ কথিত ‘scoundrel’, নাকি শিবদাস ঘোষ কথিত ‘উচ্চতর হৃদয়বৃত্তি’—কোন চর্চা চলবে তা নির্ণীত হবে রাজনৈতিকযাপনের উপর।
রাজনীতির কারবারিরাও প্রচারের ময়দানে ব্যক্তি কুৎসার খেউড় গাইবেন না কি যুক্তি নির্ভর মতাদর্শের প্রচার করবেন, সেটাও নির্ভর করছে দৈনন্দিন রাজনৈতিকযাপনের উপরেই। সেখানে ভুল হয়ে গেলে কিন্তু সবটাই ভুল হয়ে যাবে।

Lok Sabha Election 2019 Election Commission
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy