Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Lok Sabha Election 2019

নির্বাচন হল সম্ভাবনার শিল্প

২০ বছর পর এ বারের লোকসভা ভোটের পরেও কি ১৯৯৯-এর গ্রীষ্মের পুনরাবৃত্তি হতে পারে?

প্রেমাংশু চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০১৯ ০০:০২
Share: Save:

রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে বেরিয়ে আসা সনিয়া গাঁধীর মুখে সে দিন পরিচিত আত্মবিশ্বাসী হাসিটা ঝিলিক দিয়েছিল। সবেমাত্র রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বে সরকার গঠনের দাবি জানিয়েছেন। কে আর নারায়ণন তাঁকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের সময়ও দিয়েছেন। তার পরেই সনিয়া সাংবাদিকদের মুখোমুখি। এবং সেই বিখ্যাত মন্তব্য, ‘‘আমাদের কাছে ২৭২ জনের সমর্থন রয়েছে এবং আরও অনেকে আসছেন।’’

ক্যালেন্ডারে দিনটা ২১ এপ্রিল, ১৯৯৯। তার ঠিক চার দিন আগে অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকার লোকসভার আস্থাভোটে মাত্র এক ভোটে হেরে গিয়েছে। প্রবীণ কমিউনিস্ট হরকিষেণ সিংহ সুরজিৎ সনিয়াকে রাজি করিয়েছিলেন, ‘‘আপনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার একটা চেষ্টা করুন। রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়ে সরকার গঠনের দাবি জানান।’’ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের জন্য ২৭২ জন সাংসদের সমর্থন জোগাড় হয়ে যাবে। মুলায়ম সিংহ যাদব কথা দিয়েছেন, ‘সাম্প্রদায়িক শক্তি’ বিজেপিকে দিল্লির গদি থেকে দূরে রাখতে তিনি কংগ্রেসকে সমর্থন করে ‘আত্মত্যাগ’ করতে রাজি। অর্জুন সিংহের মতো প্রবীণ কংগ্রেস নেতারাও ‘ম্যাডাম’-কে বলেছিলেন, সংখ্যা জোগাড় হয়ে যাবে। সেই আত্মবিশ্বাসে ভর করেই রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেছিলেন সনিয়া।

প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রকুমার গুজরাল তাঁর আত্মজীবনী ‘ম্যাটারস অব ডিসক্রিশন’-এ লিখেছেন, রাষ্ট্রপতির কাছে দরবারের আগের দিন গুজরালের সঙ্গে দেখা করেছিলেন সনিয়া। কিন্তু কফিতে চুমুক দিতে দিতে গুজরাল তাঁকে সাবধান করেছিলেন, সনিয়ার ‘হিতৈষী’-রাই তাঁকে হতাশ করবে।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

গুজরালের কথাই মিলেছিল। টানা ৪৮ ঘণ্টার চেষ্টার পরে সনিয়া মাত্র ২৩৩ জনের সমর্থন জোগাড় করতে পেরেছিলেন। মুলায়ম সিংহ যাদব ডিগবাজি খান। নিজে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নে বুঁদ সমাজবাদী পার্টির সুপ্রিমো প্রশ্ন তোলেন, ইটালীয় মহিলা কেন দেশের শীর্ষপদে বসবেন? বরঞ্চ কংগ্রেস তৃতীয় ফ্রন্টকে সমর্থন করুক। ১৯৯৬-র ‘ঐতিহাসিক ভুল’ শোধরাতে আবার জ্যোতি বসুর নাম টেবিলে আসে।

প্রধানমন্ত্রীর গদির দিকে পা বাড়িয়েও হোঁচট খেয়ে সনিয়া গাঁধী তখন বাক্রুদ্ধ। তিনি জানিয়ে দেন, কংগ্রেস তৃতীয় ফ্রন্টের সরকারকে সমর্থন করবে না। তার থেকে ফের ভোট হোক। ফলে অটলবিহারী বাজপেয়ীর ‘কেয়ারটেকার সরকার’-ই গদিতে থেকে যায়। তার পরই মে মাসে কার্গিল। সেই যুদ্ধ জয় করে ১৯৯৯-এর সেপ্টেম্বরে বাজপেয়ীর নেতৃত্বে এনডিএ-র নির্বাচন জয়।

২০ বছর পর এ বারের লোকসভা ভোটের পরেও কি ১৯৯৯-এর গ্রীষ্মের পুনরাবৃত্তি হতে পারে?

নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি একাই ফের সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় আসছে— এমন ভবিষ্যদ্বাণী কোনও রাজনৈতিক পণ্ডিতই নিশ্চিত ভাবে করতে চাইছেন না। এমনকি এনডিএ-শরিকদের নিয়েও বিজেপি ২৭২-এর গণ্ডি পার হবেন, তার পক্ষেও খুব কম লোকেই বাজি ধরছেন। উল্টো দিকে রাহুল গাঁধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস তথা ইউপিএ ক্ষমতায় অনায়াসে আসবে, এ কথা কংগ্রেসের নেতারাও বুক ঠুকে বলছেন না। বরং যে বিকল্পের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি জোরালো, তা হল নতুন এক তৃতীয় ফ্রন্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চলেছে। যার প্রধান চরিত্ররা এখন খাতায়-কলমে ইউপিএ বা এনডিএ, কোনও শিবিরেই নেই— পূর্বে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, নবীন পট্টনায়ক, দক্ষিণে কে চন্দ্রশেখর রাও, জগনমোহন রেড্ডি এবং অবশ্যই উত্তরপ্রদেশ থেকে মায়াবতী ও অখিলেশ যাদব। নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের নেতৃত্বে বিজেপি-এনডিএ ‘ম্যাজিক সংখ্যা’ ২৭২-এ পৌঁছতে না পারলে এই আধ ডজন দলই নির্ণায়ক ভূমিকা নেবে।

কিন্তু কী ভাবে? সেটাই প্রশ্ন। বিশ বছর আগের, ১৯৯৯-এর প্রেক্ষাপট সেখানেই গুরুত্বপূর্ণ।

কংগ্রেস চাইতে পারে, মায়াবতী-মমতা-জগনরা কংগ্রেসকে বাইরে থেকে সমর্থন করুন। উল্টো দিকে কে চন্দ্রশেখর রাও, মায়াবতী, মমতারা চাইতে পারেন, কংগ্রেস তাঁদের কাউকে প্রধানমন্ত্রী মেনে নিয়ে বাইরে থেকে সমর্থন করুন অথবা সরকারের শরিক হয়ে যোগ দিক।

১৯৯৯-এ এই প্রশ্নের ফয়সালা হয়নি। সনিয়া গাঁধী অনড় অবস্থান নিয়েছিলেন। রাহুল গাঁধী কী করবেন? তিনি কি নমনীয় হবেন? কংগ্রেস সভাপতি বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে বলে এসেছেন, তাঁর পাখির চোখ নরেন্দ্র মোদীকে ক্ষমতা থেকে সরানো। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, তা জনতা ঠিক করবে। আর জনতা কী চাইছে, তা ২৩ মে-তেই স্পষ্ট হয়ে যাবে।

২৩ মে-র সেই ফলপ্রকাশের আগে মায়াবতী বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে চোখ বুজে রাহুল গাঁধীকে সমর্থন করতে নারাজ, তা তাঁরা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়ে‌ছেন। কংগ্রেসের হয়ে দৌত্য করছেন অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নায়ডু। তেলুগু দেশম নেতা ১৯৯৯-এ বিজেপির হয়ে দৌত্য করেছিলেন। এখন তিনি ঠিক উল্টো ভূমিকায়। মমতা তাঁকে জানিয়ে দিয়েছেন, ভোটের আগে তিনি কোনও জোটে নাম লেখাতে রাজি নন। মায়াবতী, অখিলেশ যাদবও এখনই কংগ্রেসের সঙ্গে দূরত্ব কমাতে রাজি নন।

মায়াবতী, মমতা, চন্দ্রশেখর রাও— তিন জনের অনুগামীরাই তাঁদের প্রধানমন্ত্রী পদে দেখতে চান। ইউপিএ-র শরিকদের মধ্যে শরদ পওয়ার, কর্নাটকের এইচ ডি দেবগৌড়া, এমনকি তাঁর পুত্র কুমারস্বামীরও প্রধানমন্ত্রীর পদের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। সূত্রধরের ভূমিকা থেকে প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার হতে চন্দ্রবাবুও দেরি করবেন না।

এর অন্য একটি দিকও রয়েছে। গদি নিয়ে এই কাড়াকাড়ি দেখে ভোটারদের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে। প্রশ্ন উঠতে পারে, মোদী সরে গেলে দিল্লিতে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে না তো? সরকার নড়বড়ে হলে স্বাভাবিক নিয়মে অর্থনীতিও নড়বড়ে হবে। ভোটারদের মধ্যে এই আশঙ্কা যত তৈরি হবে, তত নরেন্দ্র মোদীর লাভ। তিনি তাই বিরোধীদের জোটকে ‘মহাভেজাল’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

এ বারের লোকসভা ভোটের ফলাফল নিয়ে কোনও রাজনৈতিক পণ্ডিতই ভবিষ্যদ্বাণী করতে চাইছেন না। কিন্তু একটা বিষয়ে সকলেই এক মত। ২০১৪-র মতো নরেন্দ্র মোদীর পক্ষে কোনও ‘ঢেউ’ নেই। বিরোধীদের দিকেও ঢেউ নেই। বিজেপি তাই গুঞ্জন তুলতে চাইছে, ঢেউ থাক বা না থাক, নরেন্দ্র মোদীই ক্ষমতায় আসছেন। যেন তেন প্রকারেণ ২৭২-এর অঙ্ক মেলাতে তাঁরা দাবি করছেন, বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ২৩টি আসন পাবে। সংগঠন না থাক, চোরাস্রোতেই কাজ হাসিল হয়ে যাবে বলে তাঁদের দাবি। এ হেন দাবি করার পিছনে কারণও স্পষ্ট। তা হল, উত্তরপ্রদেশ মহারাষ্ট্র মধ্যপ্রদেশ রাজস্থান ছত্তীসগঢ় পঞ্জাব হরিয়ানা এবং ছোট রাজ্যগুলি মিলিয়ে বিজেপি ও তার শরিকদের বিপুল সংখ্যক আসন কমার সম্ভাবনা। পশ্চিমবঙ্গ-ওড়িশা থেকে সেই ক্ষতির অনেকখানিই পূরণ হয়ে যাবে বলে অনুমান না করলে, ২৭২-এর হিসেব মেলে না।

মোদীই ক্ষমতায় আসছেন, কানাঘুষোয় এই কথা ছড়িয়ে দেওয়ার পিছনে বিজেপির লক্ষ্য একটাই। যাঁরা জয়ীদের দিকেই থাকতে ভালবাসেন, সেই ভোটাররা ওই কানাঘুষোয় বিশ্বাস করে পদ্মফুলেই বোতাম টিপবেন। ‘ফির এক বার, মোদী সরকার’-এর স্লোগানই রাজনৈতিক বাস্তবে পরিণত হবে।

এর বাইরে আর একটি সম্ভাবনা থেকে যায়। তা হল, মায়াবতী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা চন্দ্রবাবু নায়ডুর মতো কেউ এনডিএ-সরকারকে সমর্থনে রাজি হলেন। কিন্তু শর্ত রাখলেন, নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রী করা চলবে না। তাঁর বদলে নিতিন গডকড়ী বা রাজনাথ সিংহর মতো কাউকে প্রধানমন্ত্রী করতে হবে। নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহর দাপটে স্বেচ্ছা অবসরে যেতে বাধ্য হওয়া লালকৃষ্ণ আডবাণীর নামও ভেসে উঠবে কি না, কে জানে।

মোদী ও শাহ এমন দাবি মেনে নেবেন কি না, অন্য প্রশ্ন। নিন্দুকরা বলবেন, মোদী-বিহীন বিজেপি সরকারকে সমর্থনের বিনিময়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে সিবিআইয়ের তদন্তে তালা ঝুলিয়ে দিতে চাইবেন। কিন্তু তৃণমূল নেত্রীর সামনে অন্য রাজনৈতিক অঙ্কের হিসেবও রয়েছে।

কী সেটা? কেন্দ্রে বিজেপির সঙ্গে হাত মেলালে বাংলার রাজনৈতিক সমীকরণই বদলে যাবে। মুকুল রায় ও দিলীপ ঘোষদের যাবতীয় মমতা-বিরোধী আক্রমণ নিমেষে ভোঁতা হবে। বাংলার মাটিতে ফণা তুলতে উদ্যত বিজেপির বিষদাঁতটাই এক ঝটকায় উপড়ে ফেলবেন মমতা। ২০২১-এর বাংলার বিধানসভা ভোট ও নবান্নর উঁচুতলা তৃণমূলের নাগালের মধ্যে এসে যাবে। ২৩ মে-র ফল তাই শুধু দিল্লির মসনদ নয়, নবান্নর জন্যও তাৎপর্যপূর্ণ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE