Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
দু’দিন পরে অার গুজব তৈরি করারও দরকার হবে না

পিটিয়ে মারার ব্যস্ত শ্মশানে

দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে এক ধরনের বিপন্নতার সঙ্কটের সলতে পাকিয়ে এই জনতাকে তাতিয়ে রাখা হয়েছে। হোয়াটসঅ্যাপ ফরওয়ার্ড-এর অজুহাতের আড়ালে ধীরে ধীরে এই উন্মত্ত জনতাকে প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রশ্রয় জোগানো হয়েছে। এক সেকেন্ড আগেই হয়তো আপনি স্রেফ ভালবেসে কিছু শিশুকে চকোলেট বিলিয়েছেন। তার কয়েক মিনিটের মধ্যেই এই জনতার রোষে ঠাঁই পেলেন লাশকাটা ঘরে। অথবা ভাবুন, বন্ধুর সঙ্গে রোড ট্রিপে বেরিয়েছেন। স্রেফ সন্দেহের বশে ওরা আপনাকে ভাগিয়ে ভাগিয়ে মারবে। আপনি হয়তো রক্তমাখা দু’হাত তুলে কোনও রকমে বলে উঠেছেন, ‘‘দোহাই করো বিসমিল্লাহ্…।’’ আপনার সেই করুণ আর্তি শেষ হওয়ার আগেই মিলিয়ে যাবেন আপনি। হাজার হাজার স্মার্টফোনের আঁধারে ক্রমেই মিলিয়ে গিয়ে আরও একটি হোয়াটসঅ্যাপ ফরওয়ার্ড হয়ে যাবেন।

রোহন ইসলাম
শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

চার মিনিট পাঁচ সেকেন্ডের একটি মিউজ়িক ভিডিয়ো। সেই ভিডিয়োর পশ্চাৎপট জুড়ে লাগাতার উচ্ছৃঙ্খল হিংসা। আর সামনে এক দল কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেমেয়ের উদ্দাম নৃত্য। ‘উই জাস্ট ওয়ানা পার্টি’। দর্শককে যেন মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে সেই নৃত্য। চার পাশে কী ঘটে চলেছে, সে দিকে তার কোনও হুঁশ নেই। উনিশ শতকের কুখ্যাত জিম ক্রো ল’ থেকে সাম্প্রতিক ফ্লরিডার স্কুলে মাস শুটিং— এমন অজস্র রেফারেন্সে, এক নিপুণ পরাবাস্তব মিউজ়িক ভিডিয়ো ‘দিস ইজ় আমেরিকা’ গড়ে নিজের প্রতিবাদ লিপিবদ্ধ করেছেন মার্কিন গায়ক-অভিনেতা ডোনাল্ড গ্রোভার ওরফে চাইল্ডিশ গ্যাম্বিনো।

কাট টু ইন্ডিয়া।

গণপ্রহারের তাণ্ডবনৃত্যে উন্মত্ত দেশ। তারও আর কোনও কিছুতেই হুঁশ নেই। দেশে চাকরি নেই? চাষিরা না খেতে পেয়ে আত্মহত্যা করছে? মেয়েরা সুরক্ষিত নয়? কুছ পরোয়া নেই। ‘মন্দির ওহি বানেগা’। ‘হিন্দু খতরে মে হে’! এক দল উন্মত্ত জনতা প্রায় প্রতিটি পাড়ায় প্রস্তুত রয়েছে। ‘অপর’কে চিহ্নিত করে কেবল ‘সবক’ শেখানোটুকুই বাকি। কখনও গোমাংসের অজুহাতে। কখনও শিশু অপহরণের। আখলাক থেকে আজ়ম— অজ্ঞাতপরিচয় মহান ভিড়তন্ত্রের জয়! ভিনধর্মই হোক বা জাতি, ‘অপর’-এর প্রতি বিদ্বেষের এই গর্বিত প্রকাশই এখন ‘নিউ নর্মাল’। গণপিটুনির এই রক্তমাখা জয়োল্লাসে আপনাদের প্রত্যেককে স্বাগত।

‘দিস ইজ় ইন্ডিয়া’। নিউ ইন্ডিয়া।

না, এর একটিও কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে এক ধরনের বিপন্নতার সঙ্কটের সলতে পাকিয়ে এই জনতাকে তাতিয়ে রাখা হয়েছে। হোয়াটসঅ্যাপ ফরওয়ার্ড-এর অজুহাতের আড়ালে ধীরে ধীরে এই উন্মত্ত জনতাকে প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রশ্রয় জোগানো হয়েছে। এক সেকেন্ড আগেই হয়তো আপনি স্রেফ ভালবেসে কিছু শিশুকে চকোলেট বিলিয়েছেন। তার কয়েক মিনিটের মধ্যেই এই জনতার রোষে ঠাঁই পেলেন লাশকাটা ঘরে। অথবা ভাবুন, বন্ধুর সঙ্গে রোড ট্রিপে বেরিয়েছেন। স্রেফ সন্দেহের বশে ওরা আপনাকে ভাগিয়ে ভাগিয়ে মারবে। আপনি হয়তো রক্তমাখা দু’হাত তুলে কোনও রকমে বলে উঠেছেন, ‘‘দোহাই করো বিসমিল্লাহ্…।’’ আপনার সেই করুণ আর্তি শেষ হওয়ার আগেই মিলিয়ে যাবেন আপনি। হাজার হাজার স্মার্টফোনের আঁধারে ক্রমেই মিলিয়ে গিয়ে আরও একটি হোয়াটসঅ্যাপ ফরওয়ার্ড হয়ে যাবেন।

এত দিন আপনি কেবল এই নয়া মিউজ়িক ভিডিয়োয় মজে থাকা দর্শক ছিলেন। ঠান্ডা ঘরে নিজেকে ভেবেছিলেন— ‘সেফ’। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আপনার ভুল ভেঙেছে। এই ঘৃণার আগুন আজ আর কেবল ‘আক্রমণকারী’, ‘দেশদ্রোহী’ মুসলমানেই সীমাবদ্ধ নেই। মহিলা, দলিত, ট্রান্সজেন্ডার, দিনমজুর, টিউশন পড়িয়ে বেঁচে থাকা যুবক, গুজবের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া সমাজকর্মী— পুড়ছে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া প্রায় প্রতিটি গোষ্ঠীই। আপনার, আমার, সবার দিকে লেলিয়ে দেওয়া এই উন্মত্ত জনতা জানে একটাই কথা: ‘আই ওয়ান্ট টু হেট।’ সেই ঘৃণায় পুড়ে যাওয়া আপনিও, এই নয়া ভারতের পরিকল্পিত রাজনীতির কাছে কেবল ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’।

পিটুনি তো আগেও হয়েছে। কিন্তু তার মধ্যে কি এ রকম পরিকল্পনার ছাপ দেখেছেন? আপনি যা খেতে চান, সেই কারণে কারও আক্রোশের শিকার হয়েছেন? আপনার প্রিয়জন ভিনধর্মের বলে জনতার তাড়া খেয়েছেন? প্রীতির উপহার দিতে গিয়ে হতাহত হয়েছেন? না, এখন যা ঘটছে, তার কোনওটিই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এ নিতান্ত বিদ্বেষের গল্প। পরিকল্পিত এক রাজনৈতিক ন্যারেটিভের মধ্য দিয়ে গোটা সমাজে তা খুব সহজেই সংক্রামিত হয়েছে। সেই সমাজই একজোট হয়ে এই ভিড়তন্ত্রের জন্ম দিয়েছে। সেই রাজনীতিই এই ভিড়তন্ত্রকে ‘জাস্টিফাই’ করেছে। কাঠুয়ায় ধর্ষণে অভিযুক্তদের সমর্থনে আপনাকে-আমাকে পথে নামিয়েছে। আলিমুদ্দিনের খুনিদের বিজয়মাল্য দিয়ে বরণ করিয়েছে। আর রাষ্ট্র? সে তখন খুনিদের ধরার বদলে আপনার হেঁশেলে ঢুকে নমুনা সংগ্রহে ব্যস্ত থেকেছে। গোমাংস ভক্ষণের অভিযোগই হোক বা শিশু অপহরণের— ‘অপর’কে দেখে এই বানানো ‘জ়েনোফোবিক’ বিপন্নতার সঙ্কটের গল্পটা একই।

এই বিপন্নতাই পাড়ায় পাড়ায়, মোড়ে মোড়ে আটঘাট বেঁধে ওত পেতে আছে। সেখানে ‘সকলেই আড়চোখে সকলকে দেখে’। এখন পারস্পরিক অবিশ্বাসের জোর এতটাই যে সেই বিপন্নতা হিংসায় বদলে যেতে দু’মিনিটও লাগবে না। অপরকে, অচেনাকে কেন্দ্র করে এই সন্দেহ, এই অবিশ্বাস ক্রমশ গোটা সমাজটাকেই কয়েকটি বিচ্ছিন্ন বদ্বীপে পরিণত করে ফেলছে। এই আশঙ্কা অমূলক নয়। গণপিটুনির মতোই আমাদের সেই টুকরো বেঁচে থাকাও এক দিন সহজে ‘নর্মাল’ হয়ে যাবে। রাজনীতির রং বদলাবে। কিন্তু তত দিনে যে বিরাট ক্ষতিটা সে করে দিয়ে যাবে, তার ক্ষত নিরাময় করা সহজ হবে না। আর আমরা যত দিন এই নিধনযজ্ঞের নেপথ্যে কেবল ফেসবুক আর হোয়াটসঅ্যাপ-এর গুজবকে দুষব, তত দিন এই বর্বরতা এক প্রকার সামাজিক বৈধতার নিরাপত্তাতেই মোড়া থাকবে। তাই প্রযুক্তিকে না দুষে মানুষগুলোকে আয়নার সামনে দাঁড় করান। রাজনীতির এই মারণখেলার অসুখ সারানোর সময় এসেছে। আসুন, পাড়ায় পাড়ায়, মোড়ে মোড়ে গগনদীপ সিংহ হয়ে দাঁড়াই। (গত মে মাসে উত্তরাখণ্ডের পুলিশ অফিসার গগনদীপ সিংহ উন্মত্ত জনতার আক্রমণ থেকে এক মুসলিম তরুণকে বাঁচিয়ে সমাজমাধ্যমে প্রচণ্ড গালিগালাজের শিকার হয়েছেন।)

তা না হলে আপনি আমি, আমরা কেউই ঘরে বাইরে কোথাওই সুরক্ষিত নই। আমাদের এই ‘নিরাপদ’ বেঁচে থাকা টলে যাবে যে কোনও মুহূর্তে। আজ গুজবের অজুহাতে মার খাচ্ছেন। দু’দিন পরে সেই গুজবেরও প্রয়োজন হবে না। স্রেফ আপনাকে দেখতে পছন্দ হয়নি বলে রড-লাঠি-বাঁশ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে এই জনতা। এমন এক দুর্ভাগা সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা, কেউই আর কাউকে ভরসা করতে পারছি না। কে কখন কার উপরে চড়াও হয়ে বসে, সেই আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি। এক দিন তালিবান আফগানিস্তানে কোরান নষ্ট করার অজুহাতে এক মহিলাকে পিটিয়ে, খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারার ভিডিয়ো দেখে শিউরে উঠেছিলাম। প্রায় প্রতি দিন তেমনই দৃশ্যের জন্ম দেবে গণতান্ত্রিক ভারত, এ কথা কি কখনও ভেবেছিলাম!

সে দিন দুই ভাইকে নিয়ে দেশের বাড়ির কাছে ঝাড়খণ্ডের টেরাকোটার মন্দিরের গ্রাম মলুটি ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। সারা ক্ষণ তাড়া করে বেড়িয়েছে এক দল অ-বিশ্বাসী জনতার হাতে আক্রান্ত হওয়ার আতঙ্ক। নাগরিকের এই আতঙ্ক দূর করার দায় কার? এই সাজানো ভিড়তন্ত্রের হাতে আক্রান্ত ভারতের তিলে তিলে গড়ে তোলা গণতন্ত্র। দেশের গর্বের গণতন্ত্রের হাতে যে দিন ঝাড়খণ্ডেরই পাকুড়ে প্রায় ‘লিঞ্চড্‌’ হতে হতে প্রাণে বাঁচলেন স্বামী অগ্নিবেশ, ঠিক সে দিনই ফের ভরসা জোগাল সর্বোচ্চ আদালত। রাষ্ট্রকে মনে করিয়ে দিল তার দায়। পরিকল্পিত জ়েনোফোবিয়ায় আক্রান্ত ভিড়ের অপরাধকে আর পাঁচটা অপরাধের সঙ্গে এক করে দেখার বিপদ সম্বন্ধে সচেতন করল। এই ভিড়তন্ত্রকে ঠেকাতে পৃথক আইন গড়ার দাওয়াই বলে দিল।

উনিশ শতকের মার্কিন ইতিহাসে গণপিটুনিকে স্বতন্ত্র অপরাধ বলে চিহ্নিত করার দাবির লড়াইয়ের মুখ ছিলেন অ্যান্টি-লিঞ্চিং ক্রুসেডার আইডা বি ওয়েলস। ঘটনাচক্রে তাঁর জন্মদিনের ঠিক পরের দিনই সুপ্রিম কোর্ট থেকে এল এমন ভরসার বার্তা। এই নয়া ‘লিঞ্চিন্ডিয়া’য় এ বড় আশার কথা।

ফলতা সাধনচন্দ্র মহাবিদ্যালয়ে বাংলার শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rumour Death Lynching
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE