Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

বিকৃত সত্যের যুগ

সঙ্গে আরও কিছু মন্তব্য তিনি যোগ করিয়াছেন। যেমন, মহাত্মা গাঁধী সমাজের শ্রেণিভিত্তিক জাতভিত্তিক বিভাজনের বিপক্ষে ছিলেন, কিন্তু কংগ্রেস সমাজকে বিভক্ত করিতে চাহে বলিয়াই ভয়ঙ্করতম দলিতবিরোধী কাজকর্ম কংগ্রেসের শাসনকালেই ঘটিয়াছে।

শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০১৯ ০০:০৩
Share: Save:

অশিক্ষা আর অল্পশিক্ষা, দুইটির মধ্যে কোনটি বেশি ভয়ঙ্করী? বিবেচনাসাপেক্ষ। এবং সেই বিবেচনার টেবিলে প্রধানমন্ত্রী মোদীর সাম্প্রতিক মহাত্মা গাঁধী বিষয় মন্তব্যটি দৃষ্টান্তযোগ্য। গাঁধী সম্পর্কে আদৌ না জানিলে এমন কথা বলা সম্ভব, না কি গাঁধীর বক্তব্য ঠিক ভাবে বুঝিতে না পারিলে, না কি অন্য কোনও কারণে— ইহা একটি কূট তর্কের বিষয়বস্তু।

প্রধানমন্ত্রী মোদী সেই দিন বলিলেন, কংগ্রেস যে নিষ্কর্মা তাহা বুঝিয়াই মহাত্মা গাঁধী কংগ্রেসকে ভাঙিয়া দিতে চাহিয়াছিলেন। সঙ্গে আরও কিছু মন্তব্য তিনি যোগ করিয়াছেন। যেমন, মহাত্মা গাঁধী সমাজের শ্রেণিভিত্তিক জাতভিত্তিক বিভাজনের বিপক্ষে ছিলেন, কিন্তু কংগ্রেস সমাজকে বিভক্ত করিতে চাহে বলিয়াই ভয়ঙ্করতম দলিতবিরোধী কাজকর্ম কংগ্রেসের শাসনকালেই ঘটিয়াছে। যেমন, গাঁধীজি ধনসম্পদ এড়াইয়া চলিতেন কিন্তু কংগ্রেস কেবলই বিলাসী ধনীদের লালন করিয়া দেশের দরিদ্র-দুঃখী জনসাধারণকে বঞ্চিত করিয়া রাখে। ইত্যাকার বক্তব্য-শেষে তাঁহার সিদ্ধান্ত: সর্বার্থে এবং পূর্ণার্থে, কংগ্রেস হইল গাঁধীর ‘অ্যান্টি-থিসিস’।

কংগ্রেস বিষয়ে মোদী যাহা ভাবিতেছেন এবং বলিতেছেন, সে বিষয়ে বাগ্‌বিস্তার নিষ্প্রয়োজন। তাঁহার নিজস্ব রাজনীতির চলনবলনে এত দিনে দেশবাসী অভ্যস্ত। কিন্তু গাঁধী বিষয়ে তিনি যাহা বলিতেছেন, তাহা ইতিহাসের এমন একটি ভ্রান্ত ও বিপজ্জনক খণ্ডদর্শন েয সে বিষয়ে সতর্কবার্তা অত্যন্ত জরুরি। তবে বার্তার আগে একটি স্বস্তি-বচন। মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী ভাগ্যবান পুরুষ, তাই সঙ্ঘীয় হিন্দুর হাতে তাঁহার কর্ম ও বাণীর এই রূপ নিধনের আগেই সঙ্ঘীয় হিন্দুর হাতে তাঁহার শারীরিক নিধন ঘটিয়াছিল। জীবনের শেষ দিকে তাই হয়তো তিনি বলিয়া গিয়াছিলেন, উত্তরসূরিরা যেন দেশকে বুঝাইবার চেষ্টা করে কোন কোন আদর্শে তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করিয়াছিলেন।

স্বাধীনতা লাভের পর কংগ্রেসের আর থাকিবার দরকার নাই, এমন কথা মহাত্মা বলিয়াছিলেন বটে। কিন্তু, নিন্দক হিসাবে নহে, সেই কথা তাঁহার মুখে ধ্বনিত হইয়াছিল এক জন প্রকৃত অভিভাবকের বিচারের ন্যায়। যে অভিভাবক দলকে প্রথম হইতে নিজের হাতে লালন করিয়া আসিয়াছেন, যে অভিভাবক দলের ভুলত্রুটি সংশোধনের দায় নিজে গ্রহণ করেন, এবং দলকে পথ দেখাইবার দায়িত্ব পালন করেন। সেই দায়িত্ববোধ তাঁহাকে বলিয়া দিয়াছিল যে, কংগ্রেস প্রতিষ্ঠান হিসাবে অন্যান্য দলের মতো নহে, তাহার স্থান অনেক উচ্চে, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই দলই প্রধান নেতৃত্ব দিয়াছে। এই অবস্থানগত উচ্চতার কারণেই কংগ্রেস স্বাধীন ভারতে অন্যান্য দলের সহিত কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া প্রতিযোগিতামূলক গণতন্ত্রের মঞ্চে নামিলে তাহা কংগ্রেসের প্রতি, এবং দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তরাধিকারের প্রতি অসম্মান হইবে। তাই কংগ্রেসের পক্ষে উচিত কাজ— প্রত্যক্ষ রাজনীতির ময়দান ছাড়িয়া দিয়া সমাজসংস্কারের কাজে আত্মনিবেদন। তিনি একটি নামও দিয়াছিলেন দলের সেই সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ রূপটির: লোকসেবক সঙ্ঘ। নরেন্দ্র মোদী কি বুঝিতে পারিতেছেন, তিনি কত ভয়ানক ভাবে মহাত্মার বক্তব্যটিকে বিকৃত করিয়াছেন?

বাস্তবিক, গাঁধীজি এমনও মনে করিয়াছিলেন যে গণতন্ত্রের মঞ্চে ক্ষমতার যুদ্ধে নামিলে কংগ্রেসের নেতা ও মন্ত্রীরাও অন্য দলের নেতাদের মতোই ক্ষমতা দখলের সহজ পথ ও দুর্নীতির সহজতর পথে ধাবিত হইবেন। গাঁধীর আশঙ্কা সত্যে প্রমাণিত হইয়াছে: কংগ্রেস নিজের উচ্চতা ধরিয়া রাখিতে পারে নাই। কিন্তু ইহার অর্থ এমন নহে যে কংগ্রেসের প্রতি গাঁধীজির অনাস্থা ছিল। বরং অর্থটি ইহাই যে, ক্ষমতার রাজনীতিতে গাঁধী এক চুলও বিশ্বাস করিতেন না। অর্থাৎ বিজেপির দাক্ষিণ্যে আরও অসংখ্য বারের মতোই ইতিহাস পরিণত হইতেছে মিথ্যার বেসাতিতে। সত্য-উত্তর দুনিয়ায় সত্যবিমুখ নেতার শাসনে ঠিক যেমনটি ঘটিবার কথা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Politics Narendra Modi Mahatma Gandhi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE