Advertisement
E-Paper

শুধু পুষ্টি নয়, শিক্ষাতেও উন্নতি

যখন আমরা ভারতে মিড ডে মিলের মূল্যায়ন শুরু করি, তত দিনে পূর্ববর্তী গবেষণায় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, এই প্রকল্পের জন্য স্কুলে ভর্তির হার বেড়েছে। বর্তমানে প্রায় একশো শতাংশ শিশু নাম লেখাচ্ছে স্কুলে।

তনিকা চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৯ ০০:০১

মিড ডে মিল শিশুর পুষ্টি বাড়াচ্ছে বটে, কিন্তু লেখাপড়ায় তেমন উন্নতি আনছে না— এমন একটি মত চালু রয়েছে। নানা দেশের স্কুলে মধ্যাহ্নভোজের মূল্যায়ন করে গবেষকদের নানা দল এমনই ফল পেয়েছেন। সম্প্রতি ভারতে একটি গবেষণা কিন্তু ভিন্ন এক সিদ্ধান্ত নিয়ে এল সামনে। দীর্ঘমেয়াদি এই সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, মিড ডে মিল শিক্ষার মানও বাড়াচ্ছে।

যখন আমরা ভারতে মিড ডে মিলের মূল্যায়ন শুরু করি, তত দিনে পূর্ববর্তী গবেষণায় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, এই প্রকল্পের জন্য স্কুলে ভর্তির হার বেড়েছে। বর্তমানে প্রায় একশো শতাংশ শিশু নাম লেখাচ্ছে স্কুলে। পুষ্টির উন্নতি হয়েছে, তারও প্রমাণ মিলেছে অন্যান্য গবেষণায়। তবে, শিশুদের শেখার মানে মিড ডে মিলের প্রভাব রয়েছে, এমন প্রমাণ মেলেনি। বরং জানা গিয়েছে, ভারতে স্কুলশিক্ষার চিত্রটি করুণ। একটি সমীক্ষা বলছে, সাত থেকে বারো বছরের শিশুদের মধ্যে চুয়াল্লিশ শতাংশ মাতৃভাষায় একটা অনুচ্ছেদ পড়তে পারে না। অর্ধেক পড়ুয়া সাধারণ বিয়োগ করতে পারে না। দ্বিতীয়ত, বেশ কিছু সমীক্ষা থেকে ইঙ্গিত মিলেছে যে, মিড ডে মিলের ব্যবস্থাপনায় শিক্ষকদের অনেকটা সময় দিতে হচ্ছে। তার বিরূপ প্রভাব পড়ছে পঠনপাঠনে। অর্থাৎ, মিড ডে মিল এক দিকে স্কুলে ভর্তির সংখ্যা বাড়িয়েছে, অন্য দিকে পড়ানোর সময় কেড়ে নিয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, মিড ডে মিল কি শিক্ষার অবনতির কারণ?

এর উত্তর খুঁজতে আমরা ভারতের প্রাথমিক স্কুলপড়ুয়াদের বয়সি এক লক্ষেরও বেশি শিশুর পরিসংখ্যান খতিয়ে দেখি। তাদের পাঠের অভ্যাস ও অঙ্কের ব্যুৎপত্তি নিরীক্ষণ করি। এগুলি বিশ্লেষণ করে যে ফল মেলে, তা পূর্বের নানা গবেষণার ফলের সম্পূর্ণ বিপরীত। দেখা গিয়েছে, একটি শিশু যখন দু’বছরের জন্য বিদ্যালয়ে খাবার পায়, তার পাঠের অভ্যাস এবং অঙ্কের দক্ষতার বেশ কিছুটা উন্নতি হয়। আবার, তিন বছর নিয়মিত স্কুলে খাবার পেলে শেখার ক্ষেত্রে প্রভাব আরও বেশি হয়। কিন্তু মাত্র এক বছর বিদ্যালয়ের খাবার পেলে শেখার ক্ষেত্রে তার প্রভাব অতটা পড়ে না। পূর্বের গবেষণাগুলি স্বল্প সময়ের মধ্যে, এবং ছোট ছোট নমুনার ওপর ভিত্তি করে, শিক্ষার মানে উন্নতি ধরতে চেয়েছিল। সেই কারণে পরিবর্তন ধরা পড়েনি।

তবে আমাদের সমীক্ষায় এ-ও দেখা গিয়েছে যে, শেখার উন্নতির হার বরাবর একই ভাবে বজায় থাকে না। তিন বছর নিয়মিত মিড ডে মিলের সুবিধে পাওয়ার পরবর্তী বছরগুলিতে মিড ডে মিল চালু থাকলেও পড়ুয়াদের শিক্ষার মান এক নাগাড়ে বাড়ে না, তাতে স্থিতাবস্থা দেখা দেয়।

কেউ ভাবতে পারেন, শিশুদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাঠের অভ্যাস আর অঙ্কের দক্ষতা বাড়বে, এটাই তো স্বাভাবিক। এতে মিড ডে মিলের কৃতিত্ব কোথায়? আমাদের সমীক্ষা কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে মাথায় রেখেই শিক্ষার মানের উন্নতির হিসেব করেছে। যেমন, রাজস্থান মিড ডে মিল শুরু করেছে ২০০২ সালে। প‌শ্চিমবঙ্গ শুরু করেছে ২০০৫ সালে। তাই জয়পুরে ২০০২ সালে বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিশুটি প্রথম শ্রেণি থেকেই স্কুলে দুপুরের খাবার পেয়েছে। কিন্তু ওই একই বছরে কলকাতার স্কুলে ভর্তি-হওয়া শিশুটি নিখরচায় স্কুলের খাবার পেয়েছে তৃতীয় শ্রেণি থেকে। জয়পুরের শিশুর ক্ষেত্রে শিক্ষার মানে উন্নতি লক্ষ করা যাচ্ছে তৃতীয় শ্রেণি থেকে, কলকাতার শিশুর পঞ্চম শ্রেণি থেকে। তবে আমাদের গবেষণার সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি হল, স্কুলে আহার প্রকল্পের সুফলটি মেয়ে এবং ছেলেরা সমান ভাবে পায়।

এটা বলা চলে না যে, শেখার মান বৃদ্ধির জন্য মিড ডে মিলই যথেষ্ট। পেট ভর্তি থাকলে আপনা থেকেই শেখা হয়ে যায়, এমন নয়। আমরা দেখেছি, পাঠে স্বাচ্ছন্দ্য এবং অঙ্কের দক্ষতা তখনই বাড়ে, যখন শিক্ষকদের উপস্থিতির হার বাড়ে, পাশাপাশি আরও বেশি বছর ধরে মিড ডে মিলের সুবিধে পাওয়া যায়। একই ভাবে, বই সহজলভ্য হলে, এবং স্কুলের খাবার একই সঙ্গে পাওয়া গেলে তা শিশুর শেখার মান বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে।

নিখরচায় স্কুলে খাবার পাওয়ার ক্ষেত্রে একটা উদ্বেগের কথা হামেশাই শোনা যায়— অতি দরিদ্র পরিবারে অভিভাবকরা স্কুলের খাবারকে শিশুর বাড়ির খাবারের বিকল্প হিসেবে দেখতে পারেন। তাঁরা হয়তো শিশুর জন্য বাড়িতে যথেষ্ট খাবার রাখবেন না। যদি তা-ই হয়, তা হলে শিশুরা হয়তো মিড ডে মিলের বাড়তি সুফল পাবে না। তাদের পুষ্টি আগের মতোই রয়ে যাবে। সৌভাগ্যবশত আমরা দেখেছি যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্কুলের মিড ডে মিল বাড়ির খাবারের বিকল্প বলে গণ্য করা হয় না। অতিরিক্ত হিসেবেই তাকে গণ্য করছে পরিবার।

ভারতে দীর্ঘ দিন শিশুদের স্কুলে ভর্তি করার বিষয়টিই প্রাধান্য পেয়েছে। এখন কিন্তু ‘শিশু কী শিখল’ সেই দিকেও নজর দেওয়া হচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কী ভাবে শিশুরা আরও ভাল শিখতে পারে, সেই রাস্তাগুলি খুঁজে বার করার জন্য নানা ধরনের গবেষণা চলছে। অতিরিক্ত শিক্ষক, প্রশিক্ষক নিয়োগ করলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুর শিক্ষার মান বাড়ে কি না, সেই পরীক্ষা চালানো হচ্ছে। তা থেকে বোঝা গিয়েছে, শিশুর পাঠের স্বাচ্ছন্দ্য এবং অঙ্কের দক্ষতা বৃদ্ধিতে অতিরিক্ত শিক্ষক এবং প্রশিক্ষক নিয়োগ যতটা কার্যকর, মিড ডে মিল প্রকল্পও ততটাই। অবশ্য, বিদ্যালয়ে মিড ডে মিল দেওয়ার আর্থিক ব্যয় অতিরিক্ত শিক্ষক বা প্রশিক্ষক নিয়োগের তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু মিড ডে মিলের ক্ষেত্রে শিশুর পুষ্টির বৃদ্ধি এবং স্কুলে ভর্তির হারে বৃদ্ধির উপর শিক্ষার মানে উন্নতি একটি উপরি পাওনা।

এই উন্নতির হাত ধরেই আগামী দিনে হয়তো এই প্রকল্পকে মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা যাবে। আর স্কুলে পরিবেশিত খাবারের গুণমাণ বৃদ্ধির দিকেও নজর দেওয়া যাবে।

আইআইএম (কলকাতা)-এ অর্থনীতির শিক্ষক

Nutrition Mid Day Meal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy