Advertisement
১৬ মে ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

পরিণতি

বাঙালি হয়তো ভুলিয়াছে, কিন্তু ভারতে নির্বাচনী গণতন্ত্র পড়িয়া পাওয়া নহে। যাঁহারা দেশ গড়িয়াছিলেন, এই ব্যবস্থাটিও তাঁহাদেরই অনেক যত্নে অনেক সাধনায় গড়া।

শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০১৮ ০০:২৫
Share: Save:

গোপালকৃষ্ণ গোখলে বাঙালির নিকট গুরুত্বপূর্ণ কেন, সেই প্রশ্নের একটিই উত্তর সম্ভব। গোখলে বাঙালিদের সম্বন্ধে এমন একটি কথা বলিয়াছিলেন, শতবর্ষ অতিক্রম করিয়াও বাঙালি যাহার গন্ধ শুঁকিয়া চলিতেছে। বাংলা আজ যাহা ভাবে, ভারত আগামিকাল ভাবিবে— এই প্রশংসাবাক্যটি বাঙালির নিকট যতখানি দামি, তাহারও অধিক দামি এই সত্যটি যে কথাটি বলিয়াছিলেন এক অবাঙালি, ভিন রাজ্যের বাসিন্দা। বাঙালি শুধু অন্যদের তুলনায় নিজের বিশিষ্টতা লইয়া গর্বিতই নহে, অন্যদের চক্ষে সেই বিশিষ্টতা ধরা পড়িল কি না, তাহা জানিতে সতত উদ্‌গ্রীব। অন্যরা তাহার সংস্কৃতিমনস্কতাকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে দেখে, তাহার বিদ্যাচর্চার গরিমাকে গুরুত্ব দেয়— অন্তত দেয় বলিয়াই বাঙালির ধারণা— এবং, তাহা বাঙালির জাতিগত গর্বের অন্যতম কারণ। মহামতি অ্যাডাম স্মিথ কথিত দূরবর্তী এবং ‘নিষ্পক্ষ পর্যবেক্ষক’-এর মতামত যে মূল্যবান, বাঙালি তাহা জানে। না, জানিত। দিন বদলাইয়াছে। এতটাই বদলাইয়াছে যে, বাঙালি ১৫ মে সকালেও চা খাইয়া থলি হাতে বাজারে চলিয়া গেল, আত্মধিক্কারে স্তব্ধ হইল না। ভাবিল না, কর্নাটক যাহা পারে, অসম যাহা পারে, এমনকী এখন বিহারও যাহা পারে, বাংলা তাহা পারে না। নির্বাচনের প্রহসনে পরিণত হওয়া ঠেকাইবার কোনও উপায় বাংলার নয় কোটি মানুষের জানা নাই। গোটা দেশ পশ্চিমবঙ্গকে কী চোখে দেখিতেছে, তাহা ভাবিয়া লজ্জায় অধোবদন হইল না বাঙালি। সংস্কৃতিমান, বুদ্ধিজীবী, অন্য রাজ্যের মানুষকে অনুকম্পার চোখে দেখা বাঙালি আজ মানিয়া লইয়াছে, নির্বাচন মানেই রক্তস্নান, বোমা আর বন্দুকের অবাধ দাপাদাপি, ব্যালট লুট। নির্বাচন মানেই বর্বরের উল্লাস। সর্বভারতীয় ধিক্কারেও আজ আর বাঙালির লজ্জা হয় না।

বাঙালি হয়তো ভুলিয়াছে, কিন্তু ভারতে নির্বাচনী গণতন্ত্র পড়িয়া পাওয়া নহে। যাঁহারা দেশ গড়িয়াছিলেন, এই ব্যবস্থাটিও তাঁহাদেরই অনেক যত্নে অনেক সাধনায় গড়া। এক অর্থে, স্বাধীন ভারতের প্রথম এবং সর্ববৃহৎ কৃতিত্ব এই নির্বাচনী ব্যবস্থাটিকে গড়িয়া তুলিতে পারা। পশ্চিমবঙ্গের যে গুন্ডাবাহিনী বন্দুকের নলে, বোমার টুকরায় ভোট করাইল, ব্যালট লুট করিয়া নিল, মানুষকে বুথে পৌঁছাইতে দিল না, তাহারা না-হয় নিতান্ত পদাতিক সৈন্য, বোড়ে। তাহাদের যে পৃষ্ঠপোষকরা এই অবিশ্বাস্য হিংস্রতাকে ছাড়পত্র দিলেন, তাঁহারাও কি বুঝিলেন না, তিলে তিলে গড়িয়া তোলা অতি গর্বের গণতন্ত্রের প্রতিমাটির অঙ্গচ্ছেদ করিতেছেন তাঁহারা? এক অসাধারণ অতীতের মুখে অনপনেয় কালিমা লেপন করিতেছেন? ১৪ মে তারিখটি সুগভীর লজ্জার। এই লজ্জাই তবে বঙ্গজননীর প্রাপ্য ছিল?

এবং এই লজ্জাই কি তাঁহাকে ক্রমাগত ভোগ করিয়া চলিতে হইবে? তাহার আশঙ্কা প্রবল। কারণ, এই রাজ্যে রাজনীতি এখন বিপজ্জনকতম পেশা। ‘পেশা’ কথাটি লক্ষণীয়, কারণ বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতির মাধ্যমের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মিলাইয়া সর্বোচ্চ কর্মসংস্থান হয় বলিয়া অনেকের দাবি। সেই পেশায় আসিতে হইলে যদি জীবনের এতখানি ঝুঁকি থাকে, তবে অনুমান করা চলে, যাঁহাদের আর কোনও পেশায় যাওয়ার পথ নাই, একমাত্র তাঁহারাই রাজনীতিতে আসিবেন। দুর্বৃত্ত হইয়া উঠা যাহাদের স্বাভাবিক গতি, রাজনীতি শুধুমাত্র তাহাদেরই অভয়ারণ্য হইবে। অর্থাৎ, ক্রমেই রাজনীতির আরও দুর্বৃত্তায়ন হইবে, শিক্ষিত ভদ্রজনেরা রাজনীতি হইতে আরও দূরে সরিয়া যাইবেন। একদা দেশের অন্য কিছু রাজ্যের রাজনীতি যেমন ছিল, ভবিষ্যতের পশ্চিমবঙ্গ হয়তো সেই অতলেই পৌঁছাইবে। তখন আর লজ্জা বা আত্মধিক্কারের বোধটুকুও রাজ্যবাসীর থাকিবে না। বঙ্গজননী বিস্তরে পাথর হইবেন। আপাতত তাহারই প্রতীক্ষা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

barbarism Panchayat Election Violence
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE