Advertisement
১৬ জানুয়ারি ২০২৫

অস্ত্র জমেছে, ফুলকির অপেক্ষা

অর্জুন শেষ পর্যন্ত অস্ত্র তুলেছিলেন। নিউ মেক্সিকোর পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের পরেও, মাস না ঘুরতেই, হিরোশিমায় আর নাগাসাকিতে সেই সহস্রাধিক সূর্যের সমান শক্তি প্রয়োগের নজির দেখেছিল পৃথিবী। তার পর পরমাণু বোমা আর কোথাও প্রয়োগ করা হয়নি। এখনও পর্যন্ত।

হাল্লা: ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কিম জং উন

হাল্লা: ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কিম জং উন

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

ছোটবেলায় সিনেমা হলে সিনেমা শুরু হওয়ার আগে একটা ছোট্ট ছবি দেখতাম। সৌরশক্তি নিয়ে। একটা গম্ভীর গলা বলত: সূর্য সকল শক্তির উৎস। তখন কি জানতাম, ১৯৪৫ সালে ১৬ জুলাই নিউ মেক্সিকোর মরুভূমিতে ‘সহস্র সূর্যের চেয়েও বেশি উজ্জ্বল’ শক্তির জন্ম দিয়েছে মানুষ, প্রথম পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের যে দৃশ্য দেখে সেই মারণাস্ত্রের অন্যতম স্রষ্টা, বিজ্ঞানী ওপেনহাইমার ভগবদ্গীতা উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ‘আমি মৃত্যু হয়ে উঠলাম, বিশ্বজগতের সংহারক’। উক্তিটি কৃষ্ণের। বিশ্বরূপ দর্শন করানোর সময় কেন তাঁকে এ-কথা বলতে হয়েছিল, আমরা জানি— অর্জুন প্রিয়জনদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলতে চাননি।

অর্জুন শেষ পর্যন্ত অস্ত্র তুলেছিলেন। নিউ মেক্সিকোর পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের পরেও, মাস না ঘুরতেই, হিরোশিমায় আর নাগাসাকিতে সেই সহস্রাধিক সূর্যের সমান শক্তি প্রয়োগের নজির দেখেছিল পৃথিবী। তার পর পরমাণু বোমা আর কোথাও প্রয়োগ করা হয়নি। এখনও পর্যন্ত।

সম্প্রতি উত্তর কোরিয়া একটি নয়া ব্যালিস্টিক মিসাইল ছুড়ে ক্ষমতা যাচাই করেছে। তার মস্তানি নাকি এত দূর যে, সেটিকে ছেড়ে দিলে আমেরিকার আলাস্কায় গিয়ে তাণ্ডব করতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়া অবশ্য এই দাবি মিথ্যে বলে উড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু তবু পিলে চমকেই থাকে, কারণ উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানের নাম কিম জং উন। তিনি কারও ধার ধারেন না। এমনকী তাঁর শুকিয়ে যাওয়া, ফুরিয়ে আসা অসম্ভব গরিব দেশটিরও ধার ধারেন না। তিনি পারমাণবিক শক্তির উপাসক। ইনি হাল্লা।

অন্য দিকে আরও এক জন প্রতাপশালী রয়েছেন। তাঁর ভাণ্ডারেও পারমাণবিক বিবিধ রতন। এ ব্যাপারে সবচেয়ে শক্তিধর তিনিই। তাঁর নাম ডোনাল্ড ট্রাম্প। এবং, ইনিও হাল্লা। উত্তর কোরিয়া ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার পরেই, ট্রাম্প হাতা গুটিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে যৌথ মহড়া করছেন। খেপে উঠেছে উত্তর কোরিয়া। তাদের সংবাদপত্রে লেখা হয়েছে, ‘বারুদের স্তূপে বসে আগুন নিয়ে খেলবেন না।’ আসলে মৌখিক বা কূটনৈতিক কুস্তি করেই ক্ষান্ত নন এই দুই লড়াই-খ্যাপা। এঁরা পারমাণবিক অস্ত্র দিয়ে দান ও পাল্টা দান শানাচ্ছেন।

ঠিক এই কারণেই এঁদের দু’জনকে নিয়ে এত তরাস জাগে। এঁরা, দৃশ্যত, নিয়ন্ত্রণের বাইরে, বিবেচনাবোধের বাইরে। সেই ঠান্ডা যুদ্ধের সময় থেকে জানা ছিল যে পারমাণবিক অস্ত্র শুধু ভয় দেখানোর জন্য, শক্তি প্রদর্শনের জন্য, ব্যবহারের জন্য নয়। অর্থাৎ কিনা, আমার কাছে এমন অস্ত্র আছে, যা ছুড়লে তোমার দেশ বাঁচবে না এবং উল্টোটাও সত্যি। তাই ঠান্ডা যুদ্ধের কালে, এবং তার পরেও, ভরসা ছিল, যাদের হাতে পরমাণু বোমা আছে, তারা সে অস্ত্র প্রয়োগ করবে না। কিন্তু এখন যিনি ‘দ্য’ শক্তিশালী দেশটির মসনদে, তিনিও যে এই ধারাই মেনে চলবেন, এমনটা হলফ করে বলা যায় না। পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের কথা তিনি এখনও বলেননি ঠিকই, কিন্তু অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তাঁর বেপরোয়া অবস্থান ছ’মাসের মধ্যেই সন্ত্রস্ত করে তুলছে পৃথিবীকে। এবং কিম জং উন তাঁর যোগ্য শাগরেদ। নিজের দেশের মানুষেরই পরোয়া করেন না, তিনি অন্য দেশের লোকেদের বিপর্যয় নিয়ে মাথা ঘামাবেন কেন?

কিন্তু ট্রাম্প বা কিম দুটি স্ফুলিঙ্গমাত্র। আসল ভয় তো চাপ চাপ অস্ত্র। পতঙ্গ যেমন আগুন খুঁজে নেয়, অস্ত্রও তেমন স্ফুলিঙ্গের গন্ধ পেয়ে যায়। আজ না হোক, কাল। টাকা, পয়সা, পাপ, পুণ্য, জল, মিথ্যে, বারুদ— কেবল জমা হয়েই চলবে, তা হয় না। প্রকৃতি, অর্থনীতি, কূটনীতি বা হিংসের নিয়ম মেনে এক দিন না এক দিন খরচ হবেই। মানুষকে উদ্ধারের জন্য জন্ম নেয় অবতার, আর রসাতলে পাঠাতে তৈরি হয় অস্ত্রভাণ্ডার। অপেক্ষা শুধু সময়ের।

মহাভারত সাক্ষাৎ প্রমাণ। কুরু আর পাণ্ডব পক্ষে যত অস্ত্র সঞ্চিত হয়েছিল, তা তো ব্যবহৃত হওয়ার জন্যই। দু’পক্ষের মহাবীরদের কাছেই ছিল এক একটি চরম অস্ত্র। যেমন, অর্জুন মহাদেবের সাধনা করে পেলেন পাশুপত, আর দেবরাজ ইন্দ্রের সাধনা করে কর্ণ পেলেন একাঘ্নী। এমন দুই অস্ত্র, যা শত্রুকে ধ্বংস করে দিতে পারে। কর্ণ এবং অর্জুন দু’জনেরই সে বিষয়ে সম্যক জ্ঞান ছিল। যেমন ছিল দু’পক্ষেরই অন্য সব মহারথীদেরও, যাঁদের কেউ কেউ আবার মহাজ্ঞানীও। তবু, যুদ্ধ হল, অস্ত্র ছোড়া হল। হয়তো এই সব আয়ুধ স্বমহিমায় প্রকাশিত হবে বলেই যুদ্ধ হল, না হলে আর তূণীরে এমন সব ব্রহ্মাস্ত্র থেকে লাভ কী? তা ছাড়া, কখনও ব্যবহৃত না হলে পশুপতি বা ইন্দ্রের ক্ষমতা সম্পর্কেও তো প্রশ্ন উঠতে পারে— তাঁরা আদৌ ব্রহ্মাস্ত্র দিয়েছিলেন তো? মোদ্দা কথা হল, অস্ত্র জমালে যুদ্ধ হবেই।

সুতরাং, হে মহামানব! সংযম। পারমাণবিক অস্ত্রে সংযম, চিনে সংযম, পাকিস্তানে সংযম, কাশ্মীরে সংযম, গো-মাতার নামে প্রাণ হরণে সংযম, দাঙ্গায় সংযম, ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপে সংযম, ঘৃণায় সংযম, মন্তব্যে সংযম, প্ররোচনায় সংযম। না হলে, যে দেশের জাতীয়তাবাদী পরমাত্মা নির্মাণে এমন মরণপণ অভিযান, তার অভিজ্ঞান স্থাপন করতে শেষে ব্যালিস্টিক মিসাইলের মুখে নিজেকে বেঁধে না প্রমাণ করতে হয়— আমিও আছি, আমিই আছি।

অন্য বিষয়গুলি:

Nuclear weapons US Republic of Korea ডোনাল্ড ট্রাম্প Donald Trump Kim Jong-un
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy